স্টাফ রিপোর্টার :: রাজধানীর গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের দুই নেতা ও তাদের এক কর্মচারী এবং বন্ধুর বাসায় অভিযান চালিয়েছে র‌্যাব। এই চার বাসা থেকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা, আট কেজি স্বর্ণ এবং ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

মঙ্গলবার র‌্যাব-৩ এর সদস্যরা গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুপন ভূঁইয়ার বাসায় অভিযান চালিয়ে নগদ এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা, ৭৩০ ভরি সোনার গহনা উদ্ধার করেন।

এখানে দুটি পিস্তল, দুটি এয়ারগান ও একটি শটগান পাওয়া গেছে। পরে লালমোহন সাহা স্ট্রিটে এনামুল হকের কর্মচারী আবুল কালামের বাসার একটি লোহার সিন্দুক থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়।

ওই বাসায় একটি পিস্তলও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া শরৎগুপ্ত রোডে এনামুলের বন্ধু হারুন অর রশিদের বাসা থেকে দুই কোটি টাকা উদ্ধার করেন। অভিযানে কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। টাকা রাখার স্থান সংকুলান না হওয়ায় তারা স্বর্ণ কিনে রেখেছেন বলে জানা গেছে। এনু এবং রুপন দুই ভাই। তারা ক্যাসিনোর টাকায় অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে স্থানীয়রা জানান।

র‌্যাব জানায়, এক সপ্তাহ আগে এনামুল থাইল্যান্ডে পালিয়ে গেছেন। তার ভাই রুপনও পলাতক। কাজেই কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফিউল্লাহ বুলবুল যুগান্তরকে বলেন, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনোয় অভিযানের আগেই সেখান থেকে টাকাগুলো সরানো হয়েছিল। এর মধ্যে এক কোটি টাকা বানিয়ানগর মুরগিটোলায় এনামুল হক এনু ও তার ভাই রুপন ভূঁইয়ার বাসায় পাওয়া গেছে।

কর্মচারী আবুল কালামের বাসায় এবং এনুর বন্ধু হারুনের বাসা থেকে চার কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ক্যাসিনো ব্যবসার টাকা বাসায় রাখতে অনেক জায়গার প্রয়োজন।

এ কারণে তারা নগদ টাকায় স্বর্ণালংকার কিনে রেখেছিলেন। তাদের বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া স্বর্ণের আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৪ কোটি টাকা। ওয়ান্ডারার্র্স ক্লাবের ১৫ জন পরিচালক আছেন। যাদের বাড়ি শনাক্ত করে পর্যায়ক্রমে র‌্যাব অভিযান চালাবে।

বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনো পরিচালনাকারী নেপালিদের মধ্যে ১৫ জন র‌্যাবের নজরবন্দি। তাদের গ্রেফতার করতে আজকালের মধ্যে অভিযান চালানো হতে পারে। তারা গুলশান এলাকার একটি বাসায় অবস্থান করছেন।

র‌্যাব জানায়, সোমবার মধ্যরাত থেকে এনামুল ও রুপনের গেণ্ডারিয়ার বাসায় অভিযান শুরু হয়। মধ্যরাত থেকে তারা বাসাটি ঘিরে রাখে। সকাল ১০টার দিকে বাসায় প্রবেশ করে। সেখানে অভিযান শেষ করে মঙ্গলবার দুপুরে র‌্যাব সদস্যরা লালমোহন সাহা স্ট্রিট ও শরৎগুপ্ত রোডে অভিযানে যান। বিকাল পৌনে ৪টা পর্যন্ত অভিযান চলে।

র‌্যাব কর্মকর্তারা বলেন, গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের একজন শেয়ারহোল্ডার। তার ভাই রুপন ভূঁইয়া থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

রুপনও ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের অন্যতম শেয়ারহোল্ডার। র‌্যাব জানায়, রাজধানীতে এনামুলদের ১৫টি বাসা আছে। তবে স্থানীয়রা জানান- ওয়ারী, সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া, বংশাল, কোতোয়ালি এলাকায় এনামুল-রুপনের ৫০টি বাড়ি আছে।

র‌্যাব জানিয়েছে, ১৫টি বাসার ঠিকানা এখন পর্যন্ত তাদের হাতে নেই। জানা গেছে, ১৯৮৫ সাল থেকেই এনামুল ও রুপন ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সম্প্রতি ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও আরামবাগ ক্লাবে পরিচালিত অভিযানের সূত্র ধরে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।

অভিযান শুরুর পর এনামুল সপ্তাহখানেক আগে ভয়ে থাইল্যান্ড পালিয়ে গেছেন। তার ভাই রুপনেরও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত জাহান বলেন, এনামুল হক থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আর রুপন ভূঁইয়া যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমরা এ দু’জনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।

কর্মচারীর বাসায় এত টাকা : র‌্যাব-৩ এর সদস্যরা এনামুল হক এনুর বাসায় অভিযান শেষ করে লালমোহন সাহা স্ট্রিটে তার কর্মচারী আবুল কালামের বাসায় অভিযান চালান। তার বাসায় একটি ভল্ট পান র‌্যাব সদস্যরা। পরে সেটি তল্লাশি করে এক হাজার টাকার অনেকগুলো বান্ডিল পান। সেখানে প্রায় দুই কোটি টাকা ছিল।

র‌্যাব জানায়, এনুর বাসায় টাকা রাখার জায়গা না হওয়ায় কর্মচারী আবুল কালামের বাসায় এসব টাকা রাখা হয়েছিল।

আ’লীগ নেতার বন্ধুর বাসায় পাওয়া গেল দুই কোটি টাকা : র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, তৃতীয় অভিযানের অংশ হিসেবে আমরা নারিন্দার শরৎগুপ্ত রোডের ২২/১ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালাই। তিনতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হকের বন্ধু হারুন অর রশিদ। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি সেখানেও একটি ভল্ট আছে। ভল্টে অবৈধ টাকা রাখা আছে। হারুনের বাসায় প্রবেশ করে আমরা দেখতে পাই- খাট ও ওয়ারড্রবের মাঝামাঝি একটি সিন্দুক। সেখান থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।

যেভাবে অভিযান : অভিযানে পাঁচটি সিন্দুক পাওয়া গেছে। সবকটিই নতুন। সিন্দুকের ওপর দোকানের নাম লেখা স্টিকার জ্বলজ্বল করছিল। সবকটিই কেনা হয়েছে পুরান ঢাকার ইংলিশ রোডের মালিটোলা বিপণিবিতানের শাবনাজ স্টিল কিং নামের একটি দোকান থেকে।

শাহনাজ স্টিল কিংয়ের ম্যানেজার আবুল বাশার বলেন, দু’জন লোক শনিবার সকালে দোকানে গিয়ে ৭৮ হাজার টাকায় ওই সিন্দুকগুলো কেনেন। তারা প্রথমে দাম জিজ্ঞাসা করেন। দোকানি দাম বলার সঙ্গে সঙ্গে দরদাম না করে দ্রুত টাকা পরিশোধ করে দেন। লেবারের জন্য সাড়ে চার হাজার টাকাও তখনই দিয়ে দেন। ওই দু’জনের কাউকেই তিনি চেনেন না। মোট চারটি রসিদে তারা টাকা পরিশোধ করেন।

রসিদে ক্রেতার নাম ও মোবাইল নম্বর লিখতে চাইলে তারা বলেন, এসব লাগবে না। টাকা পরিশোধ করার পর দু’জনের একজন আগে চলে যান। অন্যজন লেবারদের সঙ্গে ভ্যানে সিন্দুকগুলো নিয়ে যান। একসঙ্গে পাঁচটি সিন্দুক কিনেছেন, এ রকম আর কারও কথা তিনি মনে করতে পারেন না। র‌্যাবের দু’জন সদস্য এসেছিলেন দোকানে। তারা ওই সিন্দুক কেনার বিষয়ে কিছু তথ্য নিয়ে গেছেন।

তারপর সেই লেবারদের সঙ্গে নিয়ে গেছেন বাসা চেনার জন্য। এরপর সোমবার মধ্যরাত থেকে র‌্যাব বাড়িটি ঘিরে রাখে। মঙ্গলবার সকাল ১০টার পর বাসায় ঢোকে। এরপর তারা ভল্টের সন্ধান করলে তা দেখিয়ে দেয়া হয়। ভল্ট খোলার পরই বেরিয়ে আসে নগদ টাকা এবং সোনার অলংকার।

অস্ত্র ও মানি লন্ডারিং আইনে মামলার প্রস্তুতি : র‌্যাব জানায়, আ’লীগ নেতা এনামুল হক এনু, রুপন ভূঁইয়া, হারুন অর রশিদ এবং এনুর অফিসের কর্মচারী আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।

উল্লেখ্য, ১৮ সেপ্টেম্বর অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে র‌্যাবের হাতে আটক হন ঢাকা দক্ষিণ মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এরপর থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে অভিযান শুরু হয়। এতে অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here