বাল্য বিয়েসৈকত দত্ত, শরীয়তপুর প্রতিনিধি :: শরীয়তপুরে চরাঞ্চলের চাইতে শহরাঞ্চলে বাল্য বিয়ে বেশী হয় বলে প্রতিয়মান হয়েছে। তাছাড়া চরাঞ্চলের অভিভাবকগণ তার অপ্রাপ্ত বয়স্কা মেয়ের বয়স নোটারী পাবলিকের কাছ থেকে হলফ নামার মাধ্যমে বয়স বাড়িয়ে বিয়ের উপযোগী করেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর বয়স বাড়িয়ে শরীয়তপুর পৌরসভার বিবাহ রেজিষ্ট্রার কাজী মোহাম্মদ আলী, মাওলানা মোছলেহ উদ্দিন, রেজাউল করিম সহ একাধিক কাজীর মাধ্যমে বিবাহ পর্ব শেষ করে বর-কনে এলাকায় যায়। কখনও অভিভাবকগণ শিশু কন্যাকে পাশবর্তী জেলা সহ রাজধানী শহরে নিয়ে বিয়ে দিয়েছে এমন তথ্যও কম নয়।

স্থানীয় পৌর মেয়র, ইউপি চেয়ারম্যান সহ সংশ্লিষ্ঠগণ বয়স বাড়িয়ে জন্ম নিবন্ধন না দিলেও বিয়ে থেমে থাকেনি। এমনকি কাজী সাহেব তার নিজের অপ্রাপ্ত বয়সের ছেলেকেও অপ্রাপ্ত কিশোরীর সাথে নোটারী করে হলফ নামার মাধ্যমে বিয়ে দিয়েছেন।

গত ৮ জানুয়ারী শুক্রবার সকালে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে আইনানুগভাবে বিবাহ অনুষ্ঠান নিশ্চিতকরণ বিষয়ে এক অগ্রগতি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে আইনানুগভাবে বিবাহ অনুষ্ঠান নিশ্চিতকরণ সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপসি’ত ছিলেন গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোঃ আবদুল হালিম।

তৎকালীন জেলা প্রশাসক রাম চন্দ্র দাস, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ এহসান শাহ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ আব্দুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ ভিখারুদ্দৌলা চৌধুরী, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান, জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল কাদের, গোসাইরহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সগীর হোসেন, ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সোহেল আহমেদ সহ জেলায় কর্মরত সকল সরকারী দপ্তরের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সকল ইউপি চেয়ারম্যান, নোটারী পাবলিক, আইনজীবী, সকল বিবাহ রেজিষ্ট্রার, মসজিদের ইমামসহ বিবাহের সাথে সংশ্লিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ।

আর ওই দিনই সদর উপজেলার দেওভোগ গ্রামে প্রবাসী আমির হোসেন মাদবরের মেয়ে সপ্তম শ্রেনীতে পড়ুয়া কিশোরী তামান্না (১৩) কে আমির হোসেনের ভাই দেলোয়ার অভিভাবক হয়ে ২ লাখ টাকা যৌতুক দিয়ে বিবাহিত এবং বয়স্ক ছেলের সাথে তামান্নার বিয়ে দেয়। বিষয়টি সদর উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে অবহিত করা হলে পালং মডেল থানা পুলিশ উপ-পরিদর্শক আশরাফুল বিয়ে বাড়িতে গিয়ে বিয়ে বন্ধ না করে ফিরে আসেন। এখন সেই কিশোরী মেয়ে তামান্না বই-খাতা-কলম ছেড়ে আঙ্গারিয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের পাশে কামাল সরদারের বাড়িতে নুর হোসেন কাজীর ছেলে পূর্বে একাধিক বিয়ে করা নজরুল কাজীর সংসারের গৃহিনীর কাজ করছে।

আবার বিয়ের বয়স হয়নি এমন কিশোরীদের বিয়ের পদ্ধতি পরিবর্তন করে বিয়ে দেয়ার কৌশল বের হয়েছে। কাজীর সাথে আলাপ করে অভিভাবকগণ নীল কাগজে বর-কনে ও স্বাক্ষীর স্বাক্ষর নিয়ে ধর্মীয় পর্ব সেরে নেয়। পরবর্তীতে প্রাপ্ত বয়স হলে কাবিন রেজিষ্ট্রি করে নিবে বলে শর্ত থাকে। যাহা ঘটেছে মনোহর বাজারের দক্ষিন পাশে চরপাতাং এলাকায়। প্রবাসী ছালাম খান তার ১২ বছরের কিশোরী কন্যা লিজাকে পাশবর্তী রুদ্রকর এলাকায় বাল্য বিয়ে দিয়েছেন। একই এলাকার রায়হান আকন শরীয়তপুর খামার বাড়িতে চাকরি করেন তিনিও তার কলেজে পড়ুয়া ছেলে সবুজের জন্য একই এলাকার বিল্লাল হোসেনের ১৩ বছরের কিশোরীকে বউ করে ঘরে এনেছে।

তাছাড়া শরীয়তপুর পৌরসভার স্বর্ণঘোষ কালভার্ট এলাকার মোতালেব সরদারের মেয়ে অকেয়া আক্তার কান্তা (১৪)’র বিয়ে ঠিক হয় একই এলাকার মানিক সরকারের ছেলে রবিনের সাথে। বিয়ের বয়স না হওয়ায় মোতালেব সরদারের মেয়ে কান্তাকে ঢাকায় নিয়ে নোটারী পাবলিক এডভোকেট নাহারুল ইসলামের মাধ্যমে রবিন সরকারের সাথে বিয়ে দেন। অথচ জন্ম সনদ ও স্বর্নঘোষ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাওয়া প্রত্যয়ন পত্র অনুযায়ী কান্তার জন্ম তারিখ ১৬ ডিসেম্বর’২০০১। মেয়ের বিয়ের হলফ নামায় ১৬ ডিসেম্বর’৯৬ সালে জন্ম দেখিয়ে বিয়ে দিয়ে নিজ হাতে মেয়ের সর্বনাশ করলেন পিতা মোতালেব। অথচ মেয়েটা শরীয়তপুর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী ছিল। এমনি হাজারও বাল্য বিয়ের সাক্ষী জেলাবাসী।

জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন, পৌরসভা ও উপজেলাকে প্রশাসন কাগজপত্রে বাল্য বিবাহ মুক্ত করা হয়েছে বলে ঘোষনা করেছেন। বাল্য বিবাহ মুক্ত, কমিউনিটি পুলিশিং সভাসহ আইন শৃঙ্খলা মিটিং এ বলা হয় বাল্য বিবাহ সংগঠিত হতে দেখলে প্রশাসনকে সংবাদ দিবেন। প্রশাসনের নাকের ডগায় আদালত পাড়ায় চরাঞ্চল থেকে গিয়ে ১০ বছরের শিশুর পর্যন্ত বিয়ে হয়।

ক্ষোভ প্রকাশ করেন গোসাইরহাট উপজেলার গরিবের চর ইউপি চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন। তিনি গোসাইরহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সগীর হোসেন, গোসাইরহাট সার্কেল সহকারী পুলিশ সুপার সুমন দেব ও গোসাইরহাট উপজেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগ সাধারণ সম্পাদক মাইনুদ্দিন পেদার উপসি’তিতে তিনি বলেন, আমরা বয়স কম হলে বয়স বাড়িয়ে জন্ম নিবন্ধন দেই না। সকল অভিভাবকগণই কোর্ট থেকে মেয়ের বিয়ে দিয়ে চোখের সামনে বিয়ের আয়োজন করে। আমরা জন প্রতিনিধি আমরা যা পারিনা তা পারে কোর্টের উকিল ও নোটারী পাবলিকগণ। তাহলে আমাদের উপর চাপ কেন? আমি কাজটি করতে না পারায় আমার সমর্থন কমে গেল যা নির্বাচনে আমার উপর প্রভাব ফেলবে। শরীয়তপুর পৌরসভার কাজীদের রেজিষ্ট্রার বহি তল্লাসী করলে সত্যতা মিলবে তার চরাঞ্চলের কত মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। আর কাজী মোহাম্মদ আলী ও মোঃ রেজাউল করিমই বাল্য বিয়ের কাজ গুলো করে থাকেন।

রাজগঞ্জ বাজার এলাকার কাজী মোসলেহ উদ্দিন অনেক বেশী রেকর্ড গড়েছে। কিশোরী বিয়ের অনুষ্ঠানে বিয়ের দিন বর যাত্রী এসেছে এমন সময় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান মেয়ের বাড়িতে পুলিশ পাঠাইলে বর পালিয়ে যায়। পুলিশ মেয়ের বাবাকে গ্রেপ্তার করে আর নির্বাহী কর্মকর্তা ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে মেয়ের পিতার কাছ থেকে মেয়ের বয়স ১৮ না হলে বিয়ে দিবেনা মর্মে মুচলেকা রেখে অর্থ দন্ড প্রদান করেন। মেয়ের বাবা বাড়ি গেলেই কাজী মোসলেহ উদ্দিন বলেন এমন বিয়ে কত দিলাম বরকে ফোন করে ডেকে আনেন আমি বিয়ে রেজিষ্ট্রি করবো। আর বরকে মোবাইল ফোনে ডেকে এনে বিয়ে রেজিষ্ট্রি করেন। এতেই বুঝা যায় কাজী সাহেবগণ কত আইন মান্যকারী।

গোসাইরহাট সার্কেল সহকারী পুলিশ সুপার সুমন দেব বলেন, আমাকে তথ্য প্রদান করা হলে ব্যবস্থা নেব।

শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক মোঃ মাহমুদুল হোসাইন আইন শৃঙ্খলা মিটিং এ শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতি সভাপতি এডভোকেট আবুল কালামকে আহবান করেন বলেন, জেলায় কোন আইনজীবী ও নোটারী পাবলিকগণ কন্যা সন্তানের বয়স সংশোধন করে হলফ নামা প্রকাশ না করেন। মিটিং এ উপস্থিত সকল কর্মকর্তাগণের প্রতিও আহবান রাখেন বাল্য বিবাহ বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here