মামুনূর রহমান হৃদয় :: শীত মানেই খেজুরের রস, শীত মানেই পিঠা। হেমন্তের শেষেই শীতের আগমন। হার কাপানো শীতের অবিরাম স্পর্শে বাঙালির স্মৃতিপটে ভেসে উঠে যেন খেজুর গাছের সুমিষ্ট রস।

শীতের আমেজে ঘরের দোয়ারে বসে খেজুর রসের আস্বাদন গ্রামীণ লোকজনের চিরচেনা এক রূপ। শৈশবকাল যাদের গ্রামে কেটেছে, খেজুর গাছ হতে রসের হাড়ি চুরি করে রস খাওয়া তাদের অনেকেরই একটি মূল্যবান স্মৃতি। গ্রামের মানুষ শীতের সকালে সুস্বাদু এই খেজুরের রস ও খেজুর রসের তৈরি গুড় নেওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে। যা দিয়ে তৈরি হয় মুখরোচক খাবার পায়েস ও নানা স্বাদের পিঠা।

এক যুগ আগে গ্রামাঞ্চলের মানুষ শীত মৌসুমে খেজুর গাছের রসের উপর নির্ভরশীল ছিল। শীতের সকালে চোঁখে পড়তো রসের হাড়ি ও খেজুর গাছ কাটার সরঞ্জামসহ গাছির ব্যস্ততার দৃশ্য। কেউ কেউ এই রস এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাটে-বাজারে কাঁচা রস খাওয়ার জন্য বিক্রয় করে ।আবার কেউ কেউ সকালেই এই রস দিয়ে বিভিন্ন রকমের পাটালি ও গুড় তৈরি করার কাজ শুরু করেন।

প্রকৃতির দান খেজুরগাছের অস্তিত্ব আজ বিলিনের পথে। বিপুল সংখ্যক খেজুর গাছ নিধন ও দূষণের ফলে প্রকৃতিগত সেই স্বাদ ও রস এখন আর মেলে না। মেললেও দ্বিগুণ দামের বিনিময়ে অর্জিত হয় । তাই এর অস্তিত্ব ধরে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছে পল্লী জনগোষ্ঠী। গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠো পথে এখনো কিছু সংখ্যক গাছ দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হিসেবে।

কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার কৈলাইন গ্রামের প্রয়াত আব্দুল কাদেরের ছেলে বাদশাহ বলেন, “তিনি তার বাবাকে রস সংগ্রহ করতে দেখেছে সেই ছোটবেলা থেকে। তখন প্রচুর রস আসত বাড়িতে। খেজুরের গুড়ের গন্ধে চারিদিকে আচ্ছাদিত হয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে গাছের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। একসময় ওনারা কয়েকশো খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করত কিন্তু কালের বিবর্তনে বর্তমানে ২০- ২৫টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছে। প্রতিটি গাছ থেকে দৈনিক ৪-৫ কেজি রস বের হয়। এক ঘটি খেজুরের রস বিক্রি করা হয় ৩৫০টাকায় আর এক কলসি খেজুরের রস বিক্রি হয় ৫০০টাকা পর্যন্ত ।”

এদিকে চাঁদপুরের কচুয়া থানার ইদ্রিস আলী বলেন, “বর্তমানে খেজুরগাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় আমাদের চাহিদাও কমে গেছে। আগে এই কাজ করে ভালোভাবেই সংসার চালাতে পারতাম। এতে যে আয় রোজগার হতো তাতে সংসার চালিয়ে কিছু সঞ্চয়ও করা যেতো। এখন গ্রামে যে কয়েকটা খেজুর গাছ আছে তাও বেশী বয়সের হওয়ায় তাতে তেমন রস পাওয়া যায় না।”

অন্যদিকে খেজুর গাছ সম্পর্কে মফস্বল শিক্ষার্থী রবিন আহমেদ জানান, “সাধারণত একটি খেজুর গাছের রসের উপযুক্ত হতে প্রায় ৫-১০ বছর সময় লেগে যায়। আর একটি গাছ থেকে রস পাওয়া যায় ২০-২৫ বছর পর্যন্ত। তবে প্রতিটি গাছে কী পরিমাণ রস পাওয়া যাবে, তা নির্ভর করে গাছির দক্ষতা এবং গাছের উপর।”

সচেতন মহলের মতে, খেজুর গাছ আমাদের অর্থনীতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর পরিকল্পিত ফসলি জমি তেমন নেই। উপরন্তু নির্বিচারে খেজুর গাছ নিধন হচ্ছে। যা পল্লী বাংলার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। খেজুর রস বা খেজুর গুর আহরণ কেবল আমাদের উদ্দেশ্য নয় বরং আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্য সুরক্ষায় খেজুর গাছের সম্প্রসারণ অত্যাবশ্যক। তাই খেজুরগাছের সঠিক পরিচর্যার পাশাপাশি নতুন করে খে‍জুরগাছ রোপন জরুরী বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here