গুরুপ্রসাদ মহান্তি

গুরুপ্রসাদ মহান্তি :: মুখে মুখোশ সাঁটকে বাঁচতে গিয়ে শেষে যে মরেই যাচ্ছে! চশমায় জমাট ঝাপসা স্যানিটাইজারের অতি ব্যবহারে কনুই-তক গো-সাপের চামড়া। কম্পিউটার স্ক্রিনের উপর কাঁহাতক ঝুঁকে থাকা যায় রাত্রদিন? নিজের উপর আবিশ্ব দ্রোহ নিয়ে বিল্ব বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। কিচ্ছুটি কাউকে না বলে।

নিঝুম বটে চতুর্দিক তবু খলবলানো জ্যোৎস্নারাত। এমন রাতে নিজেকে একা লাগে না। বিল্ব হনহনিয়ে সোজা চলে এল নদীপাড়ে। ঘাসের উপর সটান শুয়ে পড়ল চিৎ হয়ে। মাথার উপর শান্ত চাঁদ, আলো ঝরিয়ে চলেছে। ছেঁড়া মেঘ মাঝেমধ্যে  ওড়নার আড়াল টানতে চাইলে কি হবে, চাঁদমুখ সেসবের বারণ মানে ছাই!

আহ, শান্তি! নিজেকে জুড়িয়ে নিতে নিতে আলোকিত আকাশ দেখছে বিল্ব। অবারিত আকাশ। কোথায় যেন পড়েছিল, কেউ যদি শুধু আকাশের তপস্যা করতে পারে, তাইতেই ব্রহ্মলাভ।

– উপলব্ধি করেছ কোনওদিন?

– অবসর কোথায়?

– বাজে কথা।

– না, না, সত্যি। খবরের কাগজের কাজে ফুরসৎই মেলে না, বিশ্বাস করুন। নিউজ কোনটা যাবে না যাবে, হেডলাইন, সেকেন্ড লিড, অ্যাঙ্কার কোনটা যাবে, সোলাসের অ্যাড কনফার্মড কিনা- ঝক্কির পর ঝক্কি। বড় কপি অ্যান্ট কপি ঝেড়েঝুড়ে সাফ করা। পলিসি ব্রেক হলেই পরেরদিন সটান গলাধাক্কা। দিনেরাতে চোখে ঘুম থাকে না মশাই।

– থামো।

– না, না শুনুন। কথাটা এখনও শেষ হয়নি। প্রুফ-রিডার, পেজ ডিজাইনার মায় সাংবাদিকেরা সব গুণধর। এককথা হাজারবার বলার পরও শুধু ভুল আর ভুল। বানানে সব দিগগজ। সামান্য ব্যাকরণটুকুর জ্ঞান নেই। বলেও ভুল, লেখার বেলায় তো কথাই নেই। আপনিই বলুন, পরিষেবায় দন্ত্যে ‘স’ আর সম্মানে দন্ত্যে ‘ন’য় ‘ম’ হয়? ওদের ব্যাকরণ…

– চাকরি ছেড়ে দাও।

– তাহলে খাব কী? বউছেলে নিয়ে বাঁচব কী করে?

– কেন, এই যে একটু আগে খুব বুলি কপচাচ্ছিলে মুখে মাস্ক নিয়ে বাঁচা যায়, ওই যে বৈপ্লবিকপন্থায় দূরে ছুঁড়ে ফেলেছ কাপড়ের মুখঢাকনি, ক’দণ্ড পর তাইই মুখে নিয়ে বাঁচনের নামে মরণের গুহায় ঢুকবে!

– মানে, আপনিও বলছেন বাঁচতে মুখোশের প্রয়োজন নেই?

– আরে করোনা তো হালের, মুখোশ তো মানুষ আগে থেকেই পরে মরে আছে।

– মানে তারা বিশ্বাসই করতে শেখেনি- মধুবাতাঋতায়তে মধুক্ষরন্তি সিন্ধবঃ…

– বিশ্বাস করতে কী লাগে?

– চিদাকাশ। আকাশের তপস্যা চাই। আকাশেই মনঃসংযোগ। চাঁদে মজে যাওয়া। একসময় তারও প্রয়োজন হবে না। তখন তোমার মধ্যেই আকাশ, তোমার মধ্যেই চাঁদ। তখনকার তুমি এখনকার এই তুমিকে একটি শবদেহ ছাড়া দ্বিতীয় কিছু ভাবতেই পারবে না।

– দেখুন, আমাদের সাংবাদিকতায় প্রথম ও প্রধান কথা হল সন্দেহ প্রকাশ। বিশ্বাসের জায়গা সেখানে নেই। যা চাই তা হল প্রমাণ। প্রমাণ দিন।

– প্রমাণই পাবে নিজেই। তবে এ মণ্ডলে প্রথম শর্ত বিশ্বাস, সন্দেহ কদাপি নয়। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু…

– কী করতে হবে?

– বন্ধ করো চোখ। তারাভরা আকাশের কথা ভাবো। ভাবো চাঁদ এসে বসেছে কপালে, দুই ভুরুর মধ্যিখানে। ছোটবেলায় চাঁদ দেখাতে গিয়ে মা যেখানে চাঁদটিপ এঁকে দিত।

– কী পাবো?

– বাঁচার মন্ত্র। ভ্রূমধ্য আলোক।

বলেই ভদ্রলোক পেছন ফিরে হাঁটা দিল।

আরে, আরে ভদ্রলোকের পরিচয়ই তো জানা হল না! ভালো করে মনে পড়ছে না মুখটিও। সে ডাকও দিল বারদুয়েক- এই যে শুনছেন, এই যে শুনছেন! ভদ্রলোক ফিরে তাকালো না, পায়ের গতিটাই যা বাড়িয়ে নিল। বিল্বর মনে হল, নিজেই তো হেঁটে যাচ্ছে সে।

এখন করণীয়? বিল্বর মনে দোলাচল। সন্দিগ্ধমনে চোখ-বন্ধ চিৎ হয়ে শুলো।

আস্তে আস্তে চারপাশ মুছে যাচ্ছে। এতক্ষণ ঝিঁঝিঁর একটানা শব্দ বাজছিলো। তাও মিটল। কানে শুধু নদীর কুলু কুলুধ্বনি।

সম্বিৎ ফিরতে বিল্ব অনুভব করে, সে এত হাল্কা ছিল না! চতুর্দিকে এত মধুস্রাবী মলয় বাতাসও তো ছিল না। এতক্ষণ তো সে নদীর কুলুধ্বনিতে বেদমন্ত্র শোনেনি- এখন শুনছে।

নিজের শবদেহটিকেই পায়ে দলে চলে গেল বিল্ব।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here