হীরেন পণ্ডিত :: আর্টিফিশিয়াল ইন্টলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট অফ থিংস বা আইওটি কীভাবে একে অপরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং কীভাবে তারা একযোগে কাজ করে কোনো একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান কিংবা  অন্য সংগঠন বা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে সেদিকটা একবার ভাবা যেতে পারে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ইন্টারনেট অফ থিংস বৈচিত্রময় আইটি সিস্টেমের স্বতন্ত্র ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। তবে তাদের মধ্যে এক অন্তর্নিহিত বন্ধন সবসময়ই ছিল। আর যতদিন যাচ্ছে এদের মধ্যে পার্থক্য ততই কমে আসছে এবং এরা একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যদি আপনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে একটা সিস্টেমের ব্রেইন হিসেবে কল্পনা করেন, তাহলে আইওটিকে সেই সিস্টেমের ডিজিটাল নার্ভাস সিস্টেম কিংবা বাকি গোটা শরীর হিসেবে ভাবতেই হবে!

আগেই বলা হয়েছে, যত সময় যাচ্ছে ইন্টারনেট অফ থিংস দিন দিন ততই স্মার্ট হয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেট অফ থিংস ব্যবহার বাস্তবিকভাবে সবখানেই বিদ্যমান। হোম অটোমেশন সিস্টেম এবং ম্যানুফেকচারিং ন্যানোবোট থেকে শুরু করে সেলফ-ড্রাইভিং কার এবং হেভি ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারিজ পর্যন্ত এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে আইওটির প্রয়োগ নেই! আইওটির বিকাশ এবং প্রয়োগ এত দ্রুত ঘটছে যে ২০২০ সালের পরে প্রায় ৫০ বিলিয়নেরও বেশি ডিভাইস একে অপরের সাথে সংযুক্ত হচ্ছে! তা সত্যিই এক আশ্চর্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আপনি হয়তো ইতিমধ্যে জানেন যে, আইওটি বিশাল সংখ্যক বহনযোগ্য ডিভাইস, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, ওয়ারেবল এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে একে-অন্যের সাথে সংযুক্ত করে। এই সংযুক্ত ডিভাইসগুলো তাদের পরিবেশকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং এদেরকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করা সম্ভব হয়। কিন্তু কাগজে-কলমে এই গোটা বিষয়কে অনেক সহজে করে দেখানো সম্ভব হলেও বাস্তবে এখানে প্রচন্ড জটিল কিছু বিষয়াদি থাকে এবং সেগুলো আসলেই মারাত্মক গুরত্বপূর্ণ!

উদাহরণস্বরূপ, একটি গাড়ি উৎপাদন কোম্পানি তাদের পরবর্তী মডেলের গাড়িকে উন্নত করার জন্য হয়তো বর্তমানের প্রতিটি গাড়ির টায়ারের প্রেসার থেকে শুরু করে ফুয়েল পারফরমেন্স পর্যন্ত সবকিছুকেই মনিটর করতে চাইবে, এবং এক্ষেত্রে কী বিশাল পরিমাণ ডাটা নিয়ে কাজ করতে হবে এবং সেই ডাটাগুলোকে প্রসেস করতে হবে সেটা ভাবতেও অবাক লাগার কথা! অর্থাৎ আইওটির মাধ্যমে আপনি এই বিশাল পরিমাণ ডাটা সংগ্রহ করলেন, এবার সেই ডাটাগুলোকে দিয়ে আপনার কাজের কাজ করার জন্য বিগ ডাটা প্রসেসিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অবশ্যই লাগবে।

তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি, আধুনিক সময়ে কীভাবে এই আলাদা প্রযুক্তিগুলোকে একসাথে কাজ করতে হয়। এইগুলো একসাথে কাজ করে অসম্ভবকেও সম্ভব করে ফেলতে পারে। আর তাই যত দিন যাবে এই প্রযুক্তিগুলো স্বতন্ত্র না থেকে একে অন্যের অংশ হিসবে একটা সিস্টেমে কাজ করবে। কিন্তু এই গোটা প্রক্রিয়া যে কত বেশি জটিল সেটা নতুন করে বলার প্রয়োজন হয় না।

বিশেষত, আইওটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে একদম ব্যবসায়িক লাভের জন্য ব্যবহার করা এক বিশাল কাজ, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইওটি ডিভাইসগুলো সর্বশেষ ব্যবহারকারীদের অভ্যাসের উপর নির্ভর করে। ফলে এই ডিভাইগুলোর তথ্যগুলো ব্যাপক বৈচিত্রময় হয়ে থাকে এবং এগুলোকে একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য সহজ আকারে আনার কাজটা প্রচন্ড জটিল হয়ে থাকে। এমনকি হেভি ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনও বিভিন্ন পরিবেশগত অবস্থার কারণে অভিন্নভাবে কাজ সম্পাদন করতে পারে না, ফলে এদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের মাঝেও বৈচিত্র দেখা যায়। সুতরাং উপরের দুটো উদাহরণেই আমরা দেখতে পাচ্ছি আলাদা আলাদা ক্ষেত্র হওয়া সত্ত্বেও উভয়ক্ষেত্রেই ব্যাপক ব্যক্তিগতকৃত (পারসোনালাইজড) ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। এভাবেই আইওটির ব্যবহারিক ক্ষেত্রগুলো কখনোই সরলরৈখিক হয় না, বরং ব্যাপক বৈচিত্রপূর্ণ হয়ে থাকে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথ্যের মাধ্যমে উন্নত এবং সমৃদ্ধ হয়। এটা পুরোপুরিভাবেই বিশাল রকমের স্ট্যাটিস্টিক্যাল এবং কম্পিউটিশনাল তথ্যের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শেখার এবং অটোমেশনের এক প্রায়োগিক পদ্ধতি।

এআই ও আইওটিকে সংমিশ্রণ করা হলে, আইওটি ডিভাইসগুলো অতিরিক্ত সক্ষমতা, যেমন- ইউজার ইন্টারঅ্যাকশন, সার্ভিস প্রোভাইডার এবং এমনকি এক ইকো-সিস্টেমের অন্যান্য ডিভাইস থেকে বিভিন্ন বিষয় শিখতে পারা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী বিভিন্ন কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করার সক্ষমতা অর্জন করে। অর্থাৎ ডিভাইসগুলো নতুন কোনো ইনপুট বা পরিবেশের যেকোনো পরিবর্তনের সাথে সাথেই কোনো রকম ম্যানুয়াল নির্দেশ ব্যতিতই নিজে থেকে যথাযথ কাজ করতে পারে।

এআই এবং আইওটির সংমিশ্রণ কেন জরুরি এই প্রশ্নের উত্তর একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়েই দেয়া যায়। যেমন- সাধারণত ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত একটা গাড়ি প্রতি ঘন্টায় মোটামুটি ২৫ গিগাবাইট ডাটা জেনারেট করে। আর স্বয়ংক্রিয়-গাড়িগুলোর ক্ষেত্রে এই পরিমাণ প্রতি সেকেন্ডে ১ গিগাবাইট পর্যন্ত হতে পারে! কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা ছাড়া প্রক্রিয়া করা ব্যতিত এই বিশাল সংখ্যক ডাটাকে কোনোভাবেই ব্যবহারোপযোগী ডাটাতে পরিণত করা সম্ভব নয়।

পূর্বে আইওটি ডিভাইসগুলোকে মূলত ডাটা সংগ্রহের জন্য ব্যবহার করা হতো। এক্ষেত্রে ধারণা ছিল- সংযুক্ত ডিভাইসগুলোর একটি মেশ (সবাই সবার সাথে সংযুক্ত) নেটওয়ার্ক তৈরি করা, যা ক্রমাগত অ্যাডমিনদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করবে। যদিও এখন আইওটির ধারণা অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত হয়েছে, তবে ইদানীং এআইওটি এক্ষেত্রে নতুন একটা মাত্রা যোগ করেছে! ডাটা প্যাটার্ন বিশ্লেষণ ও বিশাল বিশাল সাইজের ডাটা প্রক্রিয়াজাত করে সুনির্দিষ্ট তথ্য এবং সিদ্ধান্ত প্রদান করার মাধ্যমে কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা আইওটিকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে! এর ফলে আইওটি ডিভাইসগুলো শুধু তথ্য সংগ্রহই নয়, বরং সেই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, যার ফলে প্রচুর সময় এবং নেটওয়ার্কিং ও প্রসেসিংয়ের কাজ বেঁচে যায়। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে, স্মার্ট সেন্সর ও ইন্টিগ্রেটেড চিপের মাধ্যমে বৈচিত্রপূর্ণ ডাটা থেকে প্যাটার্ন রিকগনিশনের মাধ্যমে এই কাজগুলো করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটা স্বয়ংক্রিয়-গাড়ি তাপমাত্রা, চাপ, আর্দ্রতা, বাতাসের অবস্থা এবং এরকম আরো অনেক রকমের ডাটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে থাকে।

তাহলে আমরা জানতে পারছি কীভাবে এআইওটি আইওটির থেকে উন্নত বা আলাদা হলো? প্রচলিত ব্যবসায়িক সিস্টেমের কার্যক্ষমতা, লাভ-ক্ষতি প্রচুর হিসাব-নিকাশ এবং যথাযথ ভবিষ্যদ্বাণী (প্রেডিকশন) এর উপর নির্ভর করে। আর এক্ষেত্রে এআইওটি অন্যান্য যেকোনো পদ্ধতির থেকে অন্তত ২০ গুণ আগে ভবিষ্যদ্বাণী (প্রেডিকশন) করতে পারে! আইওটি বা এআই একা যদি বিপ্লব ঘটাতে পারে, তাহলে এদের সংমিশ্রণ অনেকটা মহাবিপ্লব ঘটিয়ে ফেলে!

এতক্ষণে এটা তো নিশ্চিত যে, এআইওটি যেকোনো পরিপূর্ণ ও পরিণত (ম্যাচিউর) ইকো-সিস্টেম তৈরির ক্ষেত্রে নতুন একটা দিগন্ত খুলে দিয়েছে, যেটার গুরুত্ব যেকোনো প্রতিষ্ঠান, শিল্প কিংবা এন্ড-ইউজারের কাছে অনেক অনেক বেশি। নিচে আমরা আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে এর সুবিধা ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।

আলাদা আলাদা প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর নির্ভর করে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে বিশ্লেষণ ব্যবস্থা মোতায়েন করা। বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতিভেদে, বিশ্লেষণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবায়ন কৌশল নির্বাচন ও প্রয়োগ করা যেতে পারে। যেমন- কখনও কখনও ডেটা ঘটনাস্থলেই বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন হতে পারে, আবার অন্য কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে হয়তো ডাটাকে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করার দরকার হতে পারে।

এআইওটির সাফল্য যে কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা ব্যতিত অর্জন করা সম্ভব নয় এ কথা বলাই বাহুল্য। এআইওটি বাস্তবায়নের জন্য মেশিন লার্নিং, ন্যাচারাল ল্যাংগুয়েজ প্রসেসিং এবং কম্পিউটার ভিশন নিয়ে খুব নিবিড়ভাবে কাজ করতে হয়।

গবেষণাভিত্তিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং ক্লিনিক্যাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বৃহৎ পরিমাণের ডাটা নিয়ে কাজ করতে হয় যেগুলো চিকিৎসকদেরকে যথাযথ দিক নির্দেশ করতে পারে।

এআই এবং আইওটি একসাথে এমন সব সমস্যার সমাধান করছে যা সম্পন্ন করা শুধু অত্যন্ত কঠিনই নয়, বরং বেশ ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষও বটে! এমনকি এটি অনেক সমস্যার সমাধান আগে থেকেই করে ফেলতে পারে যা হয়তো পরবর্তীতে ঘটতে পারতো! এআইওটির মাধ্যমে অসংখ্য সংযুক্ত ডিভাইস থেকে প্রাপ্ত রিয়েল-টাইম ডেটা একবারেই সংগ্রহ এবং পরিচালনা করে কোনো একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ ব্যবহার করা যায়।

এই বিষয়টি একটা সম্পূর্ণ নতুন প্রজন্মের আইওটি সিস্টেমকে সম্ভব করে তুলছে, যেটা শুধু অসামান্যই নয়, বরং মহাবৈপ্লবিকও বটে! আইওটি যেটা করতে পারে না সেটা কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা করতে পারে, এবং যেটা কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা করতে পারে না সেটা আইওটি করতে পারে। আর এই দুইয়ের সংমিশ্রণ ‘এআইওটি’ বলতে গেলে সবকিছুই করে ফেলতে পারে!

 

 

লেখক: রিসার্চ ফেলো, ইন্টারনেট অফ থিংস, বিএনএনআরসি

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here