সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ, ফসলহানি, মাদকসহ অন্যান্য চোরাচালান প্রতিরোধ, নারী ও শিশু পাচার রোধ, বন্ধু প্রতীম সম্পর্ক বজায় ও উভয় দেশের সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কুষ্টিয়া সীমান্তে বিএসএফ ও বিজিবির মধ্যে প্রায়ই পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তারপরও যেন থামানো যাচ্ছে না বাংলাদেশ-ভারতীয় সীমান্তে চোরচালান। ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিনই অবাধে আসছে মাদকদ্রব্য, অস্ত্রসহ ভারতীয় পণ্য সামগ্রী।
এদিকে ঈদকে সামনে রেখে চোরাচালান সিন্ডিকেটগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে। ফলে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার চোরাচালানের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য আসছে। সীমান্ত পথে যে পরিমাণ পণ্য চোরাচালান হয়ে আসছে তার সিকি ভাগও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা আটক করতে পারছে না। শুক্রবার বিকালে কুষ্টিয়ার পোড়াদহে ট্রেন থেকে প্রায় ২ লক্ষ টাকা মূল্যের ভারতীয় শাড়ী, জিরা, এলাচ, দুধসহ অন্যান্য মালামাল আটক করে।
পোড়াদহ জিআরপি থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মঞ্জুরুল হাফিজের নেতৃত্বে পোড়াদহ জিআরপি থানা পুলিশ ও মিরপুর-৩২ বিজিবি সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী বিকাল ৩ টায় পোড়াদহ রেলওয়ে জংশনের অদূরে ময়নাগাড়ির গেটে সৈয়দপুর হতে খুলনাগামী আন্তঃনগর রূপসা ট্রেন থামিয়ে তল্লাশী করে। এ সময় ট্রেন থেকে ভারতীয় ২৩ পিচ শাড়ী, ১৩৪ কেজি জিরা, একশ ৫০ কেজি দুধ এবং ১২ কেজি এলাচ আটক করে। তবে কোনো চোরাকারবারীকে আটক করতে পারেনি যৌথবাহিনী।
পরে কুষ্টিয়া সদর সার্কেলের আইআরপি শফিকুল ইসলামের উপস্থিতিতে আটক করা মালামাল বিক্রির জন্য পোড়াদহ জিআরপি থানার সামনে নিলাম ডাকা হয়। স্থানীয় ৭ ব্যক্তি এই নিলামে অংশ নেয়। এতে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৭১ হাজার টাকায় আটক করা মাল কিনে নেন ইসলাম আলী।
মিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মঞ্জুরুল হাফিজ সাংবাদিকদের জানান, ট্রেনে ফেনসিডিল, শাড়ী, দুধসহ বিভিন্ন ভারতীয় পণ্য আসছে। চোরাচালান প্রতিরোধে অভিযান চলছে এবং অব্যাহত থাকবে।
অপরদিকে সীমান্ত সূত্র জানায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত জেলা হিসেবে পরিচিত কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর রুটে পণ্য চোরাচালান নতুন কোন ঘটনা নয়। যে কোন উৎসবেই সিন্ডিকেটগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। চোরাচালান ঘাট হিসেবে পরিচিত কুষ্টিয়ার মহিষকুণ্ডি, চুয়াডাঙ্গার জগন্নাথপুর ও মেহেরপুরের কাতলি সীমান্ত দিয়ে বিভিন্ন পণ্যের চালান আসে। পরে সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই তা সড়ক পথে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া হয়। অবৈধ মালামাল বহনের ক্ষেত্রে কয়েকটি রুট ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারতের এমন কোন পণ্য নেই যা এসব রুটে না আসছে।
জানা গেছে, দৌলতপুর উপজেলায় ভারতীয় সীমান্ত রয়েছে প্রায় ৪৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৮ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া আছে। বাকি ২৮ কিলোমিটার ‘অরক্ষিত’। শুষ্ক মৌসুমে পায়ে হেঁটে সীমান্ত পার হওয়া যায়। বর্ষায় লোকজনের ভরসা নৌকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘অরক্ষিত’ সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রতিদিনই ভারতীয় শাড়ি থ্রিপিচ, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন ও ‘বলবর্ধক’ বড়িসহ নানা নেশাদ্রব্য অবাধে প্রবেশ করছে। এসব মাদক পাচারের কাজে শিশু থেকে শুরু করে নানা বয়সী নারীরা জড়িয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, প্রাগপুর, ধর্মদহ, চিলমারি, জামালপুর, বগমারি, ঠোটারপাড়া, রামকৃষ্ণপুর, মহিষকুণ্ডি, মরিচা, ফিলিপনগর, আবেদেরঘাট, বৈরাগিরচর, মথুরাপুর, হোসেনাবাদ, তারাগুনিয়া, কল্যাণপুর, আল্লারদর্গা, রিফায়েতপুর, বড়গাংদিয়া, খলিসাকুন্ডিসহ প্রায় দৌলতপুর উপজেলায় প্রায় অর্ধশত স্থানে মাদকদ্রব্য কেনাবেচা হয়। এর সাথে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চিলমারী এলাকার এক কৃষক বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের প্রতিদিনই নৌকা ও সাইকেলে করে ফেনসিডিল ও গাঁজা আনতে দেখা যায়। ওদের কাছে অস্ত্রও থাকে। কিছু বললে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। এমনকি পরে জানলে এলাকায় থাকা দায় হয়ে পড়ে। এ জন্য ভয়ে কিছু বলি না। এখানকার বেশির ভাগ মানুষই এ পেশার সঙ্গে জড়িত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দৌলতপুর উপজেলায় ১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে রামকৃষ্ণপুর, চিলমারী, প্রাগপুর ও মরিচা এই চারটি ইউনিয়ন চরাঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। এই চরাঞ্চলে বাংলাদেশি কোনো মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক নেই। মাদক ব্যবসায়ীরা ওপারের মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে ভারতীয় মুঠোফোনের সিম দেশের সীমান্তে ব্যবহার করেন। যার ফলে কম খরচে ও স্বল্প সময়ে খুব সহজেই তথ্য আদান-প্রদান করা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাদক ব্যবসায়ী বলেন, ভরা বর্ষায় চারপাশে শুধু পানি আর পানি। তখন অনেক নৌকা চলে। নৌকার তলায় আলাদা করে বানানো হয়, যা পানির নিচে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নৌকায় করে ফেনসিডিল আসে। সেখান থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। আর এ জন্য তিনটি দল কাজ করে। একটি দল নৌকায় থাকে। একটি লাইন (যে পথ ধরে মাদক পাচার হবে) দেখাশোনা করে। আরেকটি দলের কাজ হচ্ছে, যে স্থানে মাদকদ্রব্য পৌঁছাবে সেখানে অবস্থান করা।
জেলার সুশীল সমাজের অভিমত, সীমান্ত এলাকায় চোরচালান প্রতিরোধ করতে হলে প্রশাসনকে যেমন তৎপর হতে হবে তেমনি সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। তাহলে সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান ও মাদকদ্রব্য বন্ধ হতে পারে।