নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার রায় হতে যাচ্ছে আজ। সোমবার সকালে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক  সৈয়দ এনায়েত হোসেন এ রায় দেবেন।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজন অপহরণ হওয়ার তিনদিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর ত্রিমোহনায় বন্দর শান্তিরচর এলাকা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ৬ জনের ও ১ মে অপর একজনের বিভৎস মরদেহ উদ্ধারের পর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জ।

এ ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় দুটি মামলা হয়। একটি মামলার বাদী নিহত অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। অপর মামলার বাদী নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি।

দুটি মামলাতেই অন্যতম প্রধান আসামি হলেন, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর  হোসেন,র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট (চাকরিচ্যুত) কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ। এ দুজন ছাড়াও আরো ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হলেও সবার দৃষ্টি আটকে আছে এ দুজনের দিকেই।

কারণ এদের মধ্যে কাউন্সিলর নূর হোসেনের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমানের সখ্যতার বিষয়টি সবারই জানা। একইসঙ্গে চাকরিচ্যুত র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ বর্তমান সরকারেরই এক মন্ত্রীর মেয়ে জামাতা।

মামলার শুরু থেকেই এ দুজনকে নিয়ে অনেক নাটকের জন্ম হয়েছে। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল অপহরণের পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল চার্জশিট, ওই বছরের ১২ নভেম্বর ভারত থেকে নূর হোসেনকে দেশে আনা, আদালতে সাক্ষীদের চোখ রাঙানি, বাদী পক্ষকে হুমকি, অন্যতম আসামি র‌্যাবের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা তারেক সাঈদের অসুস্থতার নাটকে হাসপাতালে ভর্তি, কাঠগড়ার ভেতরে নূর  হোসেনের মারামারিসহ অনেক ঘটনায় ঘটেছে এ দুজনকে নিয়ে।

হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেনের পালিয়ে যাওয়া নিয়েও সমালোচনা ওঠে। পলাতক অবস্থায় নূর হোসেনের সঙ্গে সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমানের ফোনালাপ প্রকাশ হলে তা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা ওঠে। পরে নূর হোসেনকে ওই বছরের ১৪ জুন গভীর রাতে কলকাতার দমদম বিমানবন্দর সংলগ্ন বাগুইআটি থানা পুলিশ আটক করে।

২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে তাকে বাংলাদেশের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

কে এই নূর হোসেন
বাসের সামান্য খালাসি থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হয়ে ওঠা নূর হোসেন নদীর বালি তোলা-সহ নানা বেআইনি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নারায়ণগঞ্জে ব্যবসায়ীদের থেকে নিয়মিত তোলা আদায় করা নূর হোসেনের রাজনীতি শুরু।

এরশাদের আমলে তাির দলের কর্মী হিসেবে ছিলেন। তার পরে বিএনপি ক্ষমতায় এলে নূর বিএনপিতে যোগ দেন। অবশেষে তিনি স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমানের দাক্ষিণ্যে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে পর পর দু’বার কাউন্সিলর হন।

কিন্তু পাশের আসনের কাউন্সিলর নজরুল তোলা আদায় ও অন্যান্য বেআইনি কাজে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠায় নূর র‌্যাবকে টাকা দিয়ে তাকে খুনের চক্রান্ত করেন।

কে এই তারেক সাঈদ মাহমুদ
র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক হিসেবে নারায়ণগঞ্জে কর্মরত ছিলেন লেফটেনেন্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মাহমুদ। ছয় কোটি টাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জে প্যানেল মেয়র নজরুলসহ সাতজনকে হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ২০১৪ সালের মে মাসেই তাকে অবসরে পাঠানো হয়।

লেফটেনেন্ট কর্নেল তারেক সাঈদ বড় হয়েছেন সেনা পরিবারে। বাবা কর্নেল মুজিব সেনাবাহিনীর ইঞ্জিয়ারিং কোরে থাকা অবস্থায় অবসরে যান।

তারেকের মায়ের নাম দেলোয়ারা বেগম। মুজিব-দেলোয়ারা পরিবারে তারেকরা চার ভাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বড়ভাই খালেদ সুমন পেশায় চিকিৎসক, তারেক লেফটেনেন্ট কর্নেল, টুটুল মুসা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর লেফটেনেন্ট কমান্ডার এবং সবার ছোট ওমর ডানিডার (ডেনিস ডেভেলপমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি) ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত।

উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমানী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম এবং আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম অপহৃত হন।

পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ছয়জনের ও ১ মে একজনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় দুটি মামলা হয়। একটি মামলার বাদী নিহত অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। অপর মামলার বাদী নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি।

দুটি মামলার তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নূর  হোসেন, র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এতে দুটি মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ১২৭ জন করে। মামলায় গ্রেফতার রয়েছেন ২৩ জন। আর পলাতক ১২ জন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here