আ হ ম ফয়সল, কাঠমুন্ডু (নেপাল) থেকে:
সকলের জন্য উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাঠমুন্ডু ঘোষণার মধ্য দিয়ে ৩দিন ব্যাপী পঞ্চম দক্ষিণ এশীয় স্যানিটেশন সম্মেলন (সেকোসেন-৫) বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে। সমাপনী দিনের অধিবেশনে উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থার পাশাপাশি গুনগত মানসম্পন্ন স্যানিটেশন সামগ্রী, প্রতিবন্ধিবান্ধব স্যানিটেশন ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে স্যানিটেশন বিষয়ক কোর্স চালু করার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়।
সকলের জন্য স্যানিটেশন: স্যানিটেশন সকলের জন্য শ্লোগান নিয়ে নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডুর ইয়াকি-ইয়াতী হোটেলে সম্মেলনটি মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়।
সম্মেলনের তৃতীয় ও সমাপনী দিনে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর উদ্ভাবনী স্যানিটেশন কার্যক্রম নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম মোঃ শহিদ খান। এ অধিবেশনে ৮টি উদ্ভাবনী কার্যক্রম উপস্থাপন করা হয়। এদের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের জিওবি-এডিবি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক সৈয়দ শাহবাজ হোসেন ও বিশ্ব ব্যাংকের কমিউনিকেশন স্পেশালিষ্ট মিরভা টুলিয়া পৃথক-পৃথক দুইটি উদ্ভাবনী স্যানিটেশন কার্যক্রম তুলে ধরেন।
বাংলাদেশের অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য: সম্মেলনে যোগ দিতে আসা বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশের পানি ও স্যানিটেশন স্পেশালিস্ট রোকেয়া আহমেদ বলেন, প্রথম সেকোসেনে স্যানিটেশন বিষয়ক এজেন্ডা তৈরী করা হয় কিন্তু এবারের অধিবেশনে এসে মনে হচ্ছে এ এজেন্ডা সকলের। পাঁচটি সম্মেলনের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে স্যানিটেশন বিষয়ে কমিটমেন্ট তৈরী হয়েছে। আমাদের দেশে বেসিক স্যানিটেশন হয়েছে। এখন আমাদেরকে উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থার জন্য কাজ করতে হবে। এ জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায় ও রাজনৈতিক দলগুলোর সংশ্লিষ্টতা প্রয়োজন। তাহলেই দ্রুত বাংলাদেশ এমডিজি লক্ষমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।
আইসিডিডিআরবির গবেষক মুহাম্মদ ফারুক হুসাইন বলেন, এ সম্মেলনে অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর স্যানিটেশন সংক্রান্ত অবস্থান, অর্জন ও প্রতিবন্ধকতা জানতে পারলাম। এ ছাড়া অন্য দেশগুলোর উদ্ভাবনী কার্যক্রমগুলোও জানার সুযোগ হয়েছে। এ ধরণের অভিজ্ঞতা আমাদের কাজে লাগাতে হবে। বিশেষ করে পাকিস্তানের কমিউনিটি ভিত্তিক ড্রেনেজ স্যানিটেশন ব্যবস্থা আমাদের দেশে গ্রামীণ এলাকায় বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
জাতিসংঘের পানি বিষয়ক পুরস্কার প্রাপ্ত এনজিও ডর্প এর প্রতিষ্ঠাতা ও সেক্রেটারী জেনালে এএইচএম নোমান বলেন, স্যানিটেশনের পাশপাশি দারিদ্র বিমোচনের জন্য আমাদেরকে কাজ করতে হবে। এ জন্য সরকারী ও বেসরকারী সংগঠনগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। উদ্ভাবনী কার্যক্রম হিসেবে ডর্প এর অনুশীলনকৃত স্বপ্ন প্যাকেজ কার্যক্রম সরকার বাস্তবায়ন করতে পারে। তাহলেই দেশের দারিদ্র বিমোচনের পাশপাশি শতভাগ স্যানিটেশন নিশ্চিত সম্ভব হবে।
দক্ষিণ এশীয় সম্মেলনে বাংলাদেশের হাসিনা বেগম: সম্মেলনের সমাপনী দিনে ঢাকার মিরপুর বস্তির বাসিন্দা হাসিনা বেগমের প্রতি সকলের নজর পড়ে। নির্ভয়ে মূল মঞ্চে দাড়িয়ে বক্তব্য রাখেন হাসিনা বেগম। তিনি রাজধানী ঢাকার বস্তির স্যানিটেশন সমস্যা ও সমস্যা উত্তরণে বিভিন্ন বিষয় তার বক্তব্যে তুলে ধরেন। সামগ্রীক স্যানিটেশন সমস্যা থেকে উত্তরণে হাসিনা বেগম সকলের মধ্যে সচেতনতা তৈরী এবং সরকারী, দাতা সংস্থা ও এনজিওদেরকে একসাথে এগিয়ে আসার আহবান জানান। এ ছাড়া তিনি স্কুল পর্যায়ে হাত ধোয়ার চর্চা ও প্রতিটি স্কুলে স্যানিটেশন সুবিধায় পানি নিশ্চিত করার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
বাংলাদেশ স্টল: সম্মেলন উপলক্ষ্যে ইয়াকি-ইয়াতী হেটেলে প্রতিটি দেশের স্যানিটেশন বিষয়ক সামগ্রী প্রদর্শনীর জন্য একটি স্টল রয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশের স্টলটিতে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের আগম ছিল লক্ষনীয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ স্যানিটেশন সেক্রেটারীয়েটের ফোকাল পার্সন ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো: আনোয়ার হোসেন জানান, স্টলটিকে সমৃদ্ব করার জন্য সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়, পলিসি সাপোর্ট ইউনিট (পিএসইউ), এনজিও ব্র্যাক, ওয়াটার এইড, ডর্প, আইসিডিডিআরবি, আহসানীয়া মিশনসহ অংশগ্রহণকারী সকলের সহযোগিতা ছিল প্রশংশনীয়। উদ্বোধনী দিনে নেপালের উপ-রাষ্ট্রপতি পরমানন্দ ঝা বাংলাদেশ স্টল পরিদর্শন করেন।
ডিকলারেশন: সম্মেলনে অংশগ্রণকারীদের উপসি’তিতে সমাপনী দিনে কাঠমুন্ডু ঘোষণা করা হয়। ঘোষণায় বলা হয়, পূর্ববতী চারটি ঘোষণার সকল নীতি ও তার উত্তম চর্চাগুলিকে নিশ্চিত করেন। সেই সাথে জাতিসংঘ ঘোষিত স্যানিটেশন অধিকার এর যৌথ অঙ্গীকার নবায়ন করন, যেখানে দক্ষিণ এশীয় দেশগুরিতে গ্রহণযোগ্য ও সঠিক সেবা ব্যবস্তার মাধ্যম গড়ে তোলায় কাজ করবেন যাতে একটি সুস্বাস্থ্য চর্চার দক্ষিণ এশিয়া গড়ে উঠে। এর ফলে এমডিজি লক্ষ্য অর্জনে জাতিসংঘ কর্তৃক আহবানকৃত স্যানিটেশনকে ত্বরান্বিত করা হবে। ঘোষণায় সেই সাথে আরও প্রত্যয় করা হয়, সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ ও ক্ষমতায়নের মাধ্যমে স্কুলশিশুসহ প্রতিবন্ধী সকল নারী, শিশু, বৃদ্ধদেরকে স্যনিটেশনের সুবিধাসমূহ প্রদান করা হবে। সেই সাথে এখনই স্যানিটেশনের সময় এবং ২০১৫ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় স্যানিটেশনের আওতা বৃদ্ধিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা শক্তিশালী করা হবে।
পরবর্তী সম্মেলন বাংলাদেশে: ষষ্ঠ দক্ষিণ এশীয় স্যানিটেশন সম্মেলন (সেকোসেন-৬) বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে। সমাপনী অধিবেশনে নেপালের আরবার ডেভেলপমেন্ট মন্ত্র্রী খিল রাজ রিগমি বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম মোঃ শহিদ খানের হাতে সেকোসেনের লগো সম্বলিত পতাকা তুলে দেন। এ প্রসঙ্গে সেকোসেনের বাংলাদেশ ফোকাল পার্সন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোঃ খাইরুল ইসলাম বলেন, ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে এ সম্মেলন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ সেকোসেন-১ সফলভাবে আয়োজন সম্পূর্ণ করেছে। এবারের সম্মেলনের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে শতভাগ স্যানিটেশন লক্ষমাত্রা অর্জনে সহায়তা করবে।
সম্মেলনে বাংলাদেশের ৬৮ সদস্যের প্রতিনিধিসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে ভারত, নেপাল, আফগানিস্তান, ভূটান, মালদ্বীপ, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের চার শতাধিক প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।