ডেস্ক রিপোর্টঃঃ  আমার সবগুলো বই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। গত ডিসেম্বর মাসে বইগুলো আমি রংপুর থেকে কিনে এনেছিলাম। মার্চের শেষের দিকে আমার অনার্স তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। আমার রুমের সবকিছুই পুড়ে গেছে। কোনো কিছু বাচাঁতে পারিনি। আমি কালকে স্যালারি পাইছি। আরও মানুষের টাকা ছিল আমার ব্যাগে সেটাও পুড়ে গেছে। শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম। যেন সবাইকে শিক্ষাদান করতে পারি। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে, কালকে আমি স্যালারি পাইছি, সেই কষ্টের স্যালারির টাকাও পুড়ে গেল। আমার তো জমানো কোনো টাকা নেই যে, আমি বাসাটা আবার বানাবো। সরকারের কাছে চাওয়া যেন, কোনো সাহায্য পাই। তাহলে আমাদের খুব উপকার হবে।

চোখে পানি নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন নীলফামারীর সৈয়দপুরের মুন্সিপাড়ার মো. কায়সারের ছোট মেয়ে নওসিন আক্তার।

গতকাল শুক্রবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় অগ্নিকাণ্ডে তাদের বাড়িসহ রেলওয়ের পাঁচটি কোয়ার্টার পুরোপুরি পুড়ে গেছে। নওসিন আক্তার রংপুর মডেল কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ও শহরের একটি রেস্টুরেন্টে ম্যানেজার পদে কর্মরত। অগ্নিকাণ্ডে সব হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন নওসিন ও তার পরিবার।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নওসিনের পরিবারের মতো সর্বস্ব হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে আরও চারটি পরিবার। একই এলাকার মৃত রবিউল চৌধুরীর মেয়ে রোমানা আক্তার তিশার একই অবস্থা। পড়াশোনা করে ব্যাংকার হবেন, এমন স্বপ্ন নিয়ে সবে এইচএসসি পাস করে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির। অগ্নিকাণ্ডে তিশাদেরও বসত বাড়ি, আসবাবপত্র, বইখাতাসহ তার সারা জীবনের অর্জিত সব সার্টিফিকেট পুড়ে গেছে। পুড়ে গেছে তার ব্যাংকার হওয়ার স্বপ্নও।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পুড়ে যাওয়া বাড়িতে সবাই ব্যস্ত নিজের ঘরের মালপত্র সরানোর কাজে। কেউ নিজের ঘরের পুড়ে যাওয়া জিনিসপত্র নিয়ে করছেন আহাজারি। আবার কেউ কেউ ধ্বংসস্তূপে নিজের প্রয়োজনীয় বস্তুটি খুঁজছেন।

চোখে পানি নিয়ে তিশা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবা মারা গেছেন সাত বছর আগে। বাসা ভাড়া দিয়ে কোনো রকম সংসার চালাতেন মা। অগ্নিকাণ্ডে আমাদের জমানো টাকাগুলো পুড়ে গেছে। সেই সঙ্গে কাপড়, আসবাবপত্র, বইখাতা এমনকি সার্টিফিকেটও পুড়ে গেছে। এখন কীভাবে বাড়ি বানাবো আর কীভাবে যে পড়াশোনা করবো জানি না। আমার সারা জীবনের অর্জিত সব আমানত পুড়ে ছাই হয়েছে।

এদিকে সব কিছু হারিয়ে দিশেহারা তিশার মা জাহেদা বেগম। স্বামী হারিয়ে ৩০ বছরের সাজানো সংসার চোখের সামনে পুড়ে ছাই হতে দেখ ভেঙে পড়েছেন তিনি।

জাহেদা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পড়নের একটা কাপড় নিয়ে বের হয়ে গেছি। আর কোনো কিছু বাঁচাতে পারিনি। রাস্তায় বের হয়ে চিৎকার করেছি, কেউ এগিয়ে আসেনি। আমার ৩০ বছরের সংসার চোখের সামনে শেষ হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, আমার মেয়েটার সব কিছু পুড়ে গেছে। মেয়েটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম, বড় হয়ে চাকরি করে পরিবারের হাল ধরবে। কিন্তু ওর তো সব স্বপ্ন শেষ। এখন ৩টা সন্তান নিয়ে কী করবো কোথায় যাব জানি না?

এ বিষয়ে সৈয়দপুর পৌরসভার মেয়র রাফিকা আক্তার জাহান বেবি বলেন, আমরা প্রতি পরিবারকে ১০ হাজার করে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেছি। তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা রাত থেকে করা হবে এবং খাওয়া-দাওয়া ও রান্নার জন্য যেসব জিনিস প্রয়োজন, সব দেওয়া হবে। এছাড়াও তাদের পুনর্বাসনের জন্য আগামীকাল একটি মিটিং করা হবে।

সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সাল রায়হান বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শীতবস্ত্র ও শুকনা খাবার প্রদান করা হয়েছে। কয়েকজন শিক্ষার্থীর বই পুড়ে গিয়েছে। তাদের পড়াশোনা ও পুনর্বাসনের জন্য আগামীকাল যাব। ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করা হবে।

সৈয়দপুর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার খুরশীদ আলম বলেন, প্রাথমিকভাবে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি দিলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও অগ্নিকাণ্ডের সঠিক কারণ জানা যাবে।

প্রসঙ্গত, নীলফামারীর সৈয়দপুরের মুন্সিপাড়ায় শুক্রবার (১৭ফেব্রুয়ারি) বিকেলে আগুনের সূত্রপাত হয় ওই এলাকার জাহেদা বেগমের বাড়ি থেকে। এদিন দুপুরে রবিউল চৌধুরীর বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা বাইরে বেড়াতে যান। বাড়িতে একাই ছিলেন রবিউল চৌধুরীর স্ত্রী জাহেদা বেগম। দুপুরের পরে হঠাৎ বাড়িতে আগুন দেখতে পান তিনি। পরে তার চিৎকারে স্থানীয়রা আগুন নেভানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরই মধ্যে আগুন পাশের বাড়িগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। পরে খবর পেয়ে স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসসহ নীলফামারী, উত্তরা ইপিজেড ও রংপুরের তারাগঞ্জের ছয়টি ইউনিটের কর্মীরা ঘটনাস্থলে এসে দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ আগুনে ওই এলাকায় থাকা আজমেরী ট্রেডার্স এবং আকরাম এন্টারপ্রাইজ নামের একটি স্যানিটারি ও একটি হার্ডওয়্যার দোকানের গুদামের মালামালও ভস্মীভূত হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here