উন্নয়ন গবেষক মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান

মাহমুদা হক মনিরা :: ইউনাইটেড নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম এর সাথে সাক্ষাৎকারে উন্নয়ন গবেষক ও বেসরকারি সংস্থা ডরপ -এর গবেষণা পরিচালক মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান বলেন,  ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এলাকা অনুযায়ী ঢাকার বর্তমান আয়তন ৩৬০ বর্গ কি.মি. এবং লোকসংখ্যা প্রায় ১কোটি ৩০ লক্ষ। যেখানে প্রতি বর্গ কি.মি. এ ৩৬১১১ জন লোক বাস। পানির প্রাপ্যতা, পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা, জ্বালানী গ্যাস, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎসহ প্রায় সকল নাগরিক প্রয়োগের সরবরাহ বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যার চাহিদার চেয়ে অপ্রতুল। ঢাকাকে বসবাসের যোগ্য করে রাখতে এর সম একটি মহানগর বা এই মহানগরেরই একটি প্রতিনিধি নগর গড়ে তুলতে হবে। স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের সুযোগ ও সম্ভাবনা নিয়ে রাজধানী উন্নয়নে একটি সমন্বিত কৌশল হওয়া উচিত।

সঠিক রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশনসহ অন্যান্য সেবামূলক সংস্থাগুলো আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হলেই, তারা সঠিক সেবা দিতে পারে। প্রয়োজনে উন্নততর সেবা প্রদানের জন্য কর বাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। মোট কথা ঢাকাকে আরও দামি শহর করা উচিত, যাতে বাস্তবিকভাবে বিশ্বের অন্যান্য মহানগরের মত চিত্র প্রতিফলিত হয়।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ১.৩৯ শতাংশ ঝযধৎব করে বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং পানির ক্ষেত্রে। অপর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন, পানি এবং বায়ু দূষণের মত পরিবেশগত সমস্যার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বছরে ৪.২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সুতরাং নাগরিক উপযোগগুলোর যথাযথ ব্যবস্থাপনা রাজধানীর আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে।

অন্যদিকে, রাজধানীর নাগরিক উপযোগের সুবিধা প্রদানের অন্যতম দায়িত্ব ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) ছাড়াও ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ, তিতাস গ্যাস এবং ঢাকা ওয়াসাসহ অন্যান্য বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের উপর ন্যস্ত। মূলত ঢাকা শহরের ব্যবস্থাপনার অনেকাংশ দায়িত্ব ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের উপর, তাই এর গুরুত্বও অনেক। অন্যদিকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ঢাকা মহনগরীরই একটি অংশ।

যোবায়ের হাসান জানান, চাহিদার সাথে সরবরাহের ব্যবধানটা সব সময়ই বাড়ছে এবং প্রতিনিয়ত জনসংখ্যার চাপ সহ্য করতে হাপিয়ে উঠেছে ঢাকা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ঢাকা শহরের বিভিন্ন নাগরিক সুবিধাগুলোর মধ্যে ভাগের পরিমাণ বা অংশীদার বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই অনুপাতে নাগরিক সুবিধা বাড়ানো হয়নি বা সম্ভব হচ্ছে না। অল্প আয়ের লোকজনের উপর সরকার কোনো কর ধার্য না করতে পারায় জনসংখ্যার অনুপাতে রাজস্ব আয় হচ্ছে না।  ফলে সঠিক সেবা দেয়ার জন্য যে আয় দরকার তা আদায় হচ্ছে না। এর ফলে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে পার্থক্য বেড়েই চলেছে।

তিনি আরও বলেন, রাজধানী ঢাকার সামাজিক পরিবেশের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে ছিন্নমূল ও বস্তিবাসীর সমস্যা। ঢাকায় প্রায় ৫০০০ বস্তিতে ৪০ লাখ লোক বাস করছে। সেখানে বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তা, পানি বিদ্যুৎ গ্যাস ইত্যাদি সকল সুযোগ সুবিধাই অপ্রতুল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।

সামাজিক নানা সমস্যার বেড়াজালে এই বিশাল জনগোষ্ঠী সামগ্রিকভাবে মহানগরীর অন্যান্য জনগণের সাথে সমানভাবে সমস্যার অংশীদার। এই বস্তিগুলোর অধিকাংশ মানুষ প্রধানত আয়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকা শহরকে বেছে নিয়েছে গন্তব্য হিসেবে। এই জনগোষ্ঠী প্রতিদিন যে নাগরিক সুবিধা (রাস্তা, বিদ্যুৎ,পানি ইত্যাদি) গ্রহণ করে তাতে সেবা প্রদানকারী সংস্থার কোন আয় হয় না, ফলে এই জনগোষ্ঠী ঢাকার জন্য বাড়তি চাপ হয়ে যাচ্ছে।

মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান বলেন, এই জনগোষ্ঠীর বাস্তবিক পুনর্বাসন না করে এদের উচ্ছেদ করাকে অনেকে আবার মানবাধিকার লংঘন বলে আখ্যায়িত করেন। বস্তি উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ১৯৯৪ সনে ‘বাস্তি উন্নয়ন অধিদপ্তর’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করে, যার দায়িত্ব হচ্ছে ঢাকার বস্তির জীবন যাপনের মান উন্নয়ন করা। এই প্রকল্পের আওতায় চাক্ষুষ কোন  উন্নয়ন দেখা না গেলেও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং ইউনিসেফের সহায়তায় ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কিছু বস্তিকে এই প্রকল্পের আওতায় ট্রেনিং  এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে খাদ্য সরবরাহ করে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিকল্পিত পুনর্বাসন ব্যতীত এই ধরনের সহযোগিতা ঢাকার বস্তি উন্নয়ন কতটুকু টেকসই সেটা বিবেচনার বিষয়। কারণ ঢাকায় বস্তি এবং বস্তিবাসীর সংখ্যা দু’টোই সমানতালে বাড়ছে ফলে সাময়িক কিছু সুবিধা দেয়ার থেকে পরিকল্পিত এবং বাস্তবিক পুনর্বাসন করাই টেকসই উন্নয়নের জন্য সমীচীন পদক্ষেপ হবে বলে মনে করেন।

যোবায়ের হাসান আরও বলেন, ঢাকার সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করলে আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে যদিও আয়ের ব্যবধান অনেক বেশি। দারিদ্র্য বাড়ছে যার ফলে দরিদ্রও বাড়ছে। বিবিএস এর সর্বশেষ প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আয় দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশ, যা অর্থনৈতিক অবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করে সামাজিক অবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। সামাজিক অবনতির কারণে মানুষের স্বভাব ও চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে, যার ফলে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবণতির কারণে পরিবেশের অবক্ষয় হচ্ছে।

উপর্যুক্ত প্রতিটি অবস্থার জন্য ঢাকা শহরকে একটি সঠিক শহর উন্নয়নের এবং জনসংখ্যার চাপ কমিয়ে উপর্যুক্ত বিষয়গুলোকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এর জন্য একটি প্রধান পদক্ষেপ হওয়া উচিত ঢাকা শহরের জনসংখ্যার সঠিক বন্টন।

সঠিক উন্নয়নের জন্য কিছু দিককে বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে যোবায়ের হাসান বলেন, সঠিক নীতি, পরিকল্পনা এবং প্রোগ্রাম এর মাধ্যমে ঢাকা শহরকে প্রধান এবং একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূরে সরাতে হবে। এর জন্য দরকার দেশের অন্যান্য বিভাগ এবং জেলা শহরের মধ্যে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে ঢাকার বাইরের সংবাদের উপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে এর দ্বারা আলোচিত ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করতে হবে। সকল উপখাত জনগণের পরিবেশ সচেতনতা বাড়ানো। যাতে কিছু সংখ্যক জনসংখ্যার পরিবেশ দূষণের জন্য পুরো জাতি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য আন্তঃ মন্ত্রণালয়ের কিছু বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়া উচিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজন হচ্ছে শহরের উন্নয়নের নীতি নির্ধারণের জনগণকে সম্পৃক্ত করা উচিত। যেহেতু পরিবেশের উন্নয়ন বা ব্যবস্থাপনা একটি একক উদ্যোগ নয়, তাই এর সাফল্য কামনায় অন্যান্য কাজসহ পরিকল্পনা মাফিক অগ্রসর প্রয়োজন।

তিনি বলেন, বস্তুত রাজধানীর উন্নয়ন একটি দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ধনাত্মক অবদান রাখতে পারে। সাথে সাথে রাজধানীর পরিবেশের উন্নয়নও সামগ্রিক উন্নয়নের অংশ। নাগরিক উপযোগ খাতের বর্তমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের ব্যবস্থা করতে পারলে দরিদ্রতাও অনেকাংশে হ্রাস পাবে। সঠিক নিয়ম নীতির মাধ্যমে খাতভিত্তি ব্যবস্থাপনা বর্তমানে একটি অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা এবং এগুলোর সুষম পরিচালনায় ঢাকা মহানগরী সামগ্রিক উন্নয়ন এবং সাথে সাথে নগরীর দারিদ্র পরিস্থিতির উন্নয়ন আশা করা সম্ভব।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here