মোঃ সাহাবুর রহমানমোঃ সাহাবুর রহমান ::

পোলট্রি একটি কর্মসংস্থানমুখী সমৃদ্ধ শিল্প। দেশীয় পুঁজি ও উদ্যোগে তিলে তিলে গড়ে ওঠা পোলট্রি শিল্প দেশের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখছে। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এ শিল্প নতুন বিপ্লবের পথ দেখিয়েছে। পোলট্রি শিল্পের বিকাশ ও সফলতার পেছনে রয়েছে বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি মানের উদ্যোক্তাদের নীরব বিপ্লব। চাকরির বাজারের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে দেশের যুব ও যুব মহিলারা স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ আর সীমিত পুঁজি নিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এ শিল্পকে।

বহু বাধা-বিপত্তি, সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও জিইয়ে রেখেছেন এ শিল্পের সম্ভাবনাকে। বার্ড ফ্লু আতঙ্কে এ শিল্পটি বেশ কয়েকবার ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে। পুঁজিসর্বস্ব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে অসংখ্য উদ্যোক্তা। কর্মসংস্থান হারিয়েছে লাখো মানুষ। অব্যাহত লোকসানে বন্ধ হয়ে গেছে লাখ লাখ পোলট্রি খামার।

তারপরেও নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে আবারও ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে পোলট্রি শিল্প। পোলট্রি শিল্পের মতো এমন ব্যাপকভিত্তিক সফলতা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টি চাহিদা পূরণের নজির আর কোনো শিল্পে লক্ষ্য করা যায়নি। পোলট্রি শিল্পের বিবকাশের ফলে দেশের জনগণ আয়-উপার্জনের সামঞ্জস্যতায় ডিম ও মুরগির গোশত খেতে পারছেন যা সুখকর সংবাদ।

মুরগির খামার লাভজনক ব্যবসা। কম সময়, কম পরিশ্রম আর স্বল্প পুঁজিতেই মুরগির খামার করা যায়। ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা নিয়েই শুরু করা যায় এ ব্যবসা। মাত্র দেড় থেকে তিন মাসের মধ্যে উঠে আসে আয়। মুরগির মাংস ও ডিমের পাশাপাশি মুরগির বিষ্ঠা জৈব সার হিসেবে বিক্রি করা যায়। আর পরিবারের লোকজনের মাধ্যমেই পরিচালনা করা যায় মুরগির খামার।

মুরগির মাংস আমাদের আমিষজাতীয় খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে। মুরগির বিষ্ঠা ও হাঁড়ের গুঁড়া জমিতে সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর পাখনা দিয়ে ধুলাবালি ঝাড়ার ঝাড়ন তৈরি হয়। মুরগির নাড়িভুঁড়ি মাছের অতি পছন্দনীয় খাবার। লাভজনক বলে এখন গ্রাম ও শহরের অনেকেই মুরগির খামার করছেন।

উদ্যোক্তা যে কেউ মুরগির খামারের ব্যবসায় নেমে পড়তে পারেন। ১০০ থেকে ১৫০টি মুরগি পালনের জন্য বাড়ির আশপাশে মাত্র ২০ ফুট লম্বা এবং ১০ ফুট চওড়া জায়গা হলেই যথেষ্ট। মুরগির খামারের জন্য স্থায়ী উপকরণ হিসেবে ঘর তৈরি, পানির ছোট পাত্র, কোদাল, লোহা বা তারের জাল, পলিথিন ইত্যাদি কিনতে প্রায় ১৮ হাজার টাকার প্রয়োজন।

চলতি উপকরণ ঝুড়ি, ধানের তুষ, কাঠের গুঁড়া, বৈদ্যুতিক বাল্ব, বৈদ্যুতিক তার, রশি ইত্যাদি কিনতে লাগবে প্রায় ১ হাজার টাকা। মুরগির খামারে ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগি রাখা হয়। মাংসের জন্য ব্রয়লার এবং ডিমের জন্য লেয়ার মুরগি পালন করা হয়। ভালো জাতের মুরগি ছাড়া ব্যবসায় লাভ করা যায় না। মাংসের জন্য ব্রয়লার মুরগির একদিন বয়সী বাচ্চা কিনতে হয়। ডিমের জন্য লেয়ার মুরগির একদিন বয়সী বাচ্চা কিনতে হবে। ভালো কোম্পানির কাছ থেকে বাচ্চা কিনতে হবে। কেনার আগে জেনে নিতে হবে বাচ্চার টিকা দেয়া আছে কিনা।

একটি মুরগি প্রতিদিন গড়ে ১০০ গ্রাম খাবার খায়। খাবারের মধ্যে থাকে গম, ভুট্টা, চালের কনা, চালের কুড়া, গমের ভুসি, তিলের খৈল, শুঁটকি মাছের গুঁড়া, ঝিনুক ও শামুকের গুঁড়া। মুরগি পালনের ক্ষেত্রে রোগবালাইয়ের প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হয়। রানীক্ষেত, বসন-, রক্ত আমাশয়, কলেরা, বার্ড-ফ্লু মুরগির প্রধান রোগ।

এসব রোগে আক্রান্ত হলে মুরগি মারা যায়। এজন্য খুব সতর্ক থাকতে হয়। শীতের সময় মুরগি ও বাচ্চাকে ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করতে হয়। গরমের সময় মুরগির ঘরে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হয়। মুরগিকে পচা ও বাসি খাবার খাওয়ানো যাবে না। পানির পাত্রে সব সময় পরিষ্কার পানি দিতে হবে। রোগে আক্রান্ত মুরগিকে টিকা দেয়া যাবে না। মুরগি মারা গেলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। মুরগির ঘরে বাইরের জুতা পরে ঢোকা যাবে না।

বিভিন্ন এনজিও থেকে সামান্য পুঁজি ঋণ নিয়ে পোলট্রি শিল্পে বিনিয়োগ করে হাঁস-মুরগী পালন করে অনেকেই সংসারের অভাব ঘুচিয়ে হয়েছেন স্বাবলম্বি। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত কয়েকটি নমুনা সংক্ষিপ্তাকারে উধৃত করছিঃ

রাশিদাঃ নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডের বাসিন্দা রাশিদা। বৈবাহিক জীবনে দুই সন্তানের জননী। ২০১১ সালে রিকশাচালক স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হলে সংসারে অন্ধকার নেমে আসে। পাশের বাড়ির এক এনজিওকর্মীর পরামর্শে রাশিদা মুরগির ফার্ম দেওয়ার প্রস্তুতি নেন। এলাকার এক স্বর্ণের দোকান থেকে মাত্র ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনি এ ফার্মের কাজ শুরু করেন।

একে একে তিনি ৫টি শেডের মাধ্যমে মুরগি পালন করতে থাকেন। সব খরচ বাদ দিয়ে তাদের যে লাভ হতো তা দিয়ে তাদের সংসার বেশ ভালোভাবে চলছিল। এরপর ২০১২ সালের এপ্রিলে আশা থেকে ২২ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে খামারের পরিধি বাড়ান। এখন তার তিনটি শেডে বিভিন্ন সাইজের ১৬০০ মুরগি আছে। এখন আর কোনো আভাব নেই তাদের সংসারে। ছেলেমেয়ে, স্বামী নিয়ে এখন তার সুখের সংসার।

মাহমুদা আক্তারঃ বাবা-মায়ের চার সন্তানের মধ্যে মেঝো মেয়ে মাহমুদা আক্তার। ৮ বছর আগে একই গ্রামের মোবারকের সঙ্গে বিয়ে হয় মাহমুদার। এরই মধ্যে সংসারে আসে দুটি সন্তান। কিন্তু হঠাৎ মাহমুদার রিকশাচালক স্বামী মোবারক মিয়া সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি মারা যাওয়ায় তার সংসারে ঢুকে পড়ে অভাবের দানব। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া তো দূরের কথা, তিন বেলা খাবার জোটানোই সম্ভব ছিল না। পরে উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদফতরের মাঠ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি হাঁস-মুরগি পালনের প্রশিক্ষণ নিয়ে বাবার দেয়া কানের দুল বিক্রি করে ৯ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেন ব্রয়লার মুরগির খামার।

বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত ছোট ঘরে প্রথমে একদিন বয়সের ২০০টি ব্রয়লার বাচ্চা তার খামারে তোলেন। প্রথমবার মুরগি বিক্রি করে লাভও হয় ভালো। দ্বিতীয় দফায় তার খামারে ৩০০টি বাচ্চা তোলেন। হঠাৎ মুরগির খামারটিতে মড়ক লেগে মুরগিগুলো মারা যায়। আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে যান তিনি।

পরে প্রশিকা (এনজিও) থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে খামারটি পুনরায় চালু করেন। অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। ঋণের টাকাও শোধ করেছেন। বর্তমানে তার খামারে ব্রয়লার মুরগির সংখ্যা এক হাজার। মাহমুদা বলেন, ‘পোলট্রি ব্যবসা করে তার দিন বদলেছে। মুরগির খামার করে আমি আমার পোলা-মাইয়া লইয়া অহন অনেক সুখে আছি। ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়াচ্ছি। আমার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই।’ তার সফলতা দেখে ওই গ্রামের অনেকেই পোলট্রি ব্যবসা করতে শুরু করছে।

রুনু বেগমঃ হাঁস পালনে দারিদ্র্য জয় করেছেন বরগুনার আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী গ্রামের রুনু বেগম। স্বামী আলতাফ হোসেন একজন দিনমজুর। অভাবের সংসারে দুই ছেলের লেখাপড়ার খরচ আর সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন দিনমজুর আলতাফ। কখনও কখনও দুবেলা খাবারও জুটতো না। পরবর্তীতে প্রতিবেশীদের পরামর্শে স্থানীয় এনজিও নজরুল স্মৃতি সংসদের (এনএসএস) সদস্য হয়ে ঋণ নিয়ে ১০টি হাঁস কেনেন রুনু বেগম।

তারপর আর রুনুকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্রমে হাঁসের সংখ্যাও বাড়িয়েছেন এবং হাঁসের ডিম বিক্রি করে ছেলেদের বই-খাতা-কলমসহ সংসারের খরচ জোগাচ্ছেন এবং ঋণও শোধ করেছেন রুনু বেগম। তার এখন কষ্ট হচ্ছে না ছেলে-মেয়েদের নিয়ে, আর উপোসও থাকতে হয় না। তিনি ডিম বিক্রি করে সংসার খরচ চালিয়েও এ বছর প্রায় ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা আয় করেছেন এবং ১০ থেকে ১৫টি হাঁস বিক্রি করেছেন। বর্তমানে একটি দলের হয়ে তার ব্যক্তিগত ৩০টি হাঁস রয়েছে। হাঁস পালন করে এখন রুনু স্বাবলম্বী।

বর্তমানে পোলট্রি শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। ২০০৭ সাল পর্যন্ত দেশীয় চাহিদা পূরণ করেও বিদেশে রফতানি হয়েছে পোলট্রি পণ্য। ২০০৭ সালের মার্চ মাসে প্রথম বার্ড ফ্লু দেখা দেয়ার ফলে দুই বছরে এ শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের ক্ষতি হয় ৪১৫০ কোটি টাকা। পরবর্তী ২ বছর এ অবস্থার কিছুটা স্বাভাবিক গতি এলেও ২০১১ সাল থেকে আবারও মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে পোলট্রি  শিল্প।

বাজারে ফার্মের উৎপাদিত মুরগি ও ডিমের ভালো দাম না পাওয়ায় দেশের অধিকাংশ খামারি হতাশ হয়ে পড়েছেন। অনেকে ব্যাংকঋণ নিয়ে খামারে বিনিয়োগ করে এখন সর্বস্বান্ত। লোকসানের কারণে অনেক খামার মালিক উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। লক্ষাধিক দেশীয় খামারে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে। এখন পরিকল্পনায় দূরদর্শিতার অভাবে সামান্যতম ভুল করলে বিপুল ও অপূরণীয় ক্ষতি হবে বাংলাদেশের। লাভবান হবে বিদেশি ব্যবসায়ীরা।

ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কারসাজি, ৭০ ভাগ পোলট্রি ফার্ম বন্ধ শিরোনামে সাপ্তাহিক সোনারবাংলা পত্রিকার ২১ নভেম্বরের রিপোর্টঃ মুরগির বাচ্চা, খাদ্য, ওষুধসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোলার চরফ্যাশন, মনপুরা, চরআইচা ও চরশশীভুষণ থানার কয়েকশত এবং সারা দেশে শত শত পোলট্রি ফার্ম বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বেকার হয়ে পড়েছেন এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত হাজার হাজার খামারি ও শ্রমিক-কর্মচারী।

খামারিদের অভিযোগ, বাচ্চা ও খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করে অধিক মুনাফার আশায় এ অবস্থা সৃষ্টি করেছে এবং তারা বলছে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাচ্চার দাম তিন গুণ বৃদ্ধি করে ফেলেছে। এ ব্যাপারে সরকারের যথাযথ নজরদারি না থাকায় সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি ধ্বংস হতে বসেছে। খামারিরা জানান, একদিন বয়সী একটি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার উৎপাদন খরচ হয় ২২-২৫ টাকা, কিন’ তা বিক্রি করা হয় ৭০ থেকে ৮০ টাকায়।

অথচ ২০০৯ সালের শুরুতেও একদিন বয়সের বাচ্চা ৩০ টাকায় পাওয়া যেত। এত উচ্চমূল্যে মুরগির বাচ্চা কিনে বিক্রির সময় লোকসান দিতে হচ্ছে। আর ক্রমাগত লোকসান দিতে গিয়ে মুরগির খামারগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

৩ অক্টোবরের একটি সংবাদপত্রে প্রকাশ, পোলট্রি শিল্পে বিদেশী আগ্রাসনের কবলে পড়েছে। দেশে পোলট্রি শিল্প ক্রমশই বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই এ শিল্পের ৪০ শতাংশ চলে গেছে তাদের দখলে। ২০২০ সালের মধ্যে ৬০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পুরো পোলট্রি শিল্পের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে যাচ্ছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো।

অন্যদিকে একে একে বন্ধ হচ্ছে দেশীয় মালিকানাধীন পোলট্রি খামার। শিল্প উদ্যোক্তারা জানান, পোলট্রি শিল্পের প্রয় ২৫ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে দেশে। আর এই বিশাল বাজার ধরতেই বিদেশি কোম্পানিগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ছে বাংলাদেশে। ইতোমধ্যে বৃহৎ সাতটি বিদেশী কোম্পানী দেশের পোলট্রি শিল্পে বিনিয়োগ করেছে। যার মধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেরই রয়েছে পাঁচটি। এর বাইরে থাইল্যান্ডের একটি এবং চীনের রয়েছে একটি।

বিদেশি এসব প্রতিষ্ঠান নিজ দেশ থেকে নামে মাত্র ২-৩ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে এসে বিনিয়োগ করছে বাংলাদেশে। অপরদিকে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের ১৮-২০ শতাংশ হার সুদে ঋণ নিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে।

সম্প্রতি পোলট্রি শিল্প রক্ষার দাবিতে কাপাসিয়া পোলট্রি মালিক সমিতির উদ্যোগে উপজেলা পরিষদ চত্বর ও প্রাণিসম্পদ অফিসের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। এ সময় খামারিরা রাস্তায় সহস্রাধিক মুরগির ডিম ফাটিয়ে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। ৩৫৬ বর্গকিলোমিটারের পোলট্রি নগরী হিসেবে খ্যাত গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় পোলট্রি খাবার, ওষুধের দাম বাড়ার, ওষুধ কোম্পানির স্থানীয় ওষুধ বিক্রেতা, বিক্রয় প্রতিনিধিদের সিন্ডিকেটের মনোপলি ব্যবসা এবং দীর্ঘ প্রায় ১ বছর ধরে ডিম ও মুরগি মাংসের মূল্য কমে যাওয়ার কারণে কাপাসিয়ার পোলট্রি শিল্প আজ ধ্বংসের পথে।

ব্যাপক ধসে দিশেহারা ও হতাশাগ্রস্থ হাজার হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারি। দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ পোলট্রি শিল্পকে রক্ষা করে কাপাসিয়াসহ সারাদেশের খামারিদের পুনরায় উজ্জিবীত করে পোলট্রি শিল্পের প্রাণ ফিরিয়ে আনতে একযোগে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে গাজিপুরের কাপাসিয়ার পোলট্রি খামারিরা। পোলট্রি খামার ধ্বংসের ৮টি কারণ উল্লেখ করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি পেশ করেছেন তারা। খামারিরা প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) কাজী ফার্মস গ্রুপের পরিবেশক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, পোলট্রি শিল্পের উন্নয়নে যুগোপযোগী ‘জাতীয় পোলট্রি নীতি’প্রণয়ন করা প্রয়োজন। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে খাদ্য, ওষুধ সুলভে পাওয়ার পাশাপাশি পোলট্রি নীতি প্রণয়ন করলে খামারিদের সুবিধা হবে।

দেশের পোলট্রি খাত শুরু থেকেই আয়করমুক্ত ছিল। গত অর্থবছরের বাজেটে পোলট্রি খামার ও পোলট্রি খাদ্য উভয় সেক্টরের জন্য আয়করমুক্তের ঘোষণা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে শুধু পোলট্রি খামারকে এর আওতায় আনা হয়েছে। অন্যদিকে ভুট্টা আমদানির ওপর ৫ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর এবং পোলট্রি খাদ্যে ৫ শতাংশ আয়কর ও শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ টার্নওভার উভয় করের আওতায় আনা হয়েছে।

এই উভয় প্রকার কর অব্যাহতি দরকার। ব্রিডার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সভাপতি একটি জাতীয় দৈনিকে সাক্ষাৎকার প্রদানকালে বলেন, পোলট্রি খাতের কর রেয়াতের মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়ালে ক্ষতিগ্রস্থসহ নতুন খামারিরাও এ শিল্পে বিনিয়োগে উৎসাহী হবেন। তা না হলে ২৫ হাজার কোটি টাকার এ শিল্প অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে।

খামারিদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ, পোলট্রি শিল্পের জন্য বীমা প্রথা চালু এবং পোলট্রি  নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হলে এ খাত থেকে ডিম ও গোশত রফতানি করে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। পোলট্রি শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব হলে ২০২১ সালের মধ্যে দেশে প্রতি বছর ১ হাজার ২০০ কোটি ডিম এবং ১০০ কোটিরও বেশি ব্রয়লার উৎপাদন করা সম্ভব।

এছাড়াও পোলট্রি লিটার থেকে বছরে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। বিপিআইএ’র গবেষণা তথ্যে বলা হয়েছে, ২০২১ সাল নাগাদ পোলট্রি শিল্পে বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়াবে ৬০ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে ছোট-বড় ও মাঝারি আকারের পোলট্রি খামারের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩ লাখ। তখন দেশের বৃহত্তর খাত হিসেবে পোলট্রি শিল্প আত্ম-প্রকাশ করবে। বলা হচ্ছে, ২০২১ সালের মধ্যে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে এ শিল্পে।

পোলট্রি শিল্পকে রক্ষা করুন’ শিরোনামে ২ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদের সম্পাদকীয় সংক্ষিপ্তাকারে উধৃত করছিঃ “ক্ষুদ্র পুঁজি, অনুন্নত প্রযুক্তি, ওষুধের উচ্চমূল্য, বার্ডফ্লু এবং দেশি-বিদেশি বড় বড় কোম্পানির আধিপত্যের কারণে প্রান্তিক পোলট্রি খামারিদের অবস্থা শোচনীয়। নরসিংদী ও গাজীপুরের খামারিদের ভাষ্য, অনেক খামারে খাঁচা আছে, মুরগি নেই। ফলে খামারগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একদিকে বড় পুঁজির দেশি-বিদেশি বড় বড় কোম্পানির কাছে স্বল্প পুঁজির প্রান্তিক খামারিরা অসহায়।

অন্যদিকে নির্দিষ্ট কোম্পানির কাছ থেকেই মুরগির বাচ্চা, খাবার, ওষুধ কেনার বাধ্যবাধকতা থাকায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেন না বলে প্রান্তিক খামারিদের অভিযোগ। তারা ২০০৮ সালের বার্ডফ্লুর ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ২০০৮ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বার্ডফ্লু আক্রান্ত খামারগুলোতে ছোট-বড় প্রায় ১৯ লাখ ৫০ হাজার ৯১৭টি মুরগি নিধন করা হয়েছে। ডিম ধ্বংস করা হয়েছে ২৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭৩৩টি।

ব্রিডারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের তথ্যমতে, বার্ডফ্লুর প্রকোপের আগে দেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় দেড় লাখ পোলট্রি খামার ছিল। এখন রয়েছে ৮০ হাজারের কিছু বেশি। এই হিসাবে প্রায় অর্ধেক খামারই বন্ধ হয়ে গেছে। পোলট্রি ফিড, বাচ্চা ও ওষুধের দাম বেশি হওয়ায় ডিমের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

ফলে ডিম বিক্রি করেও লাভ করতে পারছেন না খামারিরা। ট্রেডিং করপোরেশন অফ বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা। যা গত এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ২৬ থেকে ২৮ টাকা।

২০১১ সালে আবারও বার্ডফ্লুর সংক্রমণ দেখা দিলে তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী পোলট্রি বীমা চালুর কথা জানান। কিন্তু তা এখনও হয়নি। নেই নীতিমালাও। নীতিমালা না থাকায় এ শিল্পে দুর্দশার সৃষ্টি হয়েছে। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রোটিনের চাহিদার একটি বড় অংশই আসে এ খাত থেকে। এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছে সেগুলো দূর করতে হবে।

প্রান্তিক পোলট্রি খামারিদের উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত একটি প্যাকেজ সহায়তায় আনা যেতে পারে। এটি করা হলে খামারিদের অনেক সমস্যা কমে যাবে। পোলট্রি শিল্পকে যেভাবেই হোক রক্ষা করতে হবে। এ খাতে সবচেয়ে বেশি যেটি প্রয়োজন সেটি হলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। গুটিকয় সমস্যার জন্য লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের এই পোলট্রি শিল্প ধ্বংস হয়ে যাক সেটা আমরা চাই না।”

ইমেইল: shahabur@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here