সুলতান মাহমুদ আরিফ

সুলতান মাহমুদ আরিফ :: মনে পড়ে বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্তের কথা। আহ! কি আতঙ্ক! চারদিকে কেবল হতাশার বাণী। তখন আশে-পাশে তো দূরে থাক একেবারে বেশ পরিচিত কোন জেলাতেও কেউ মারা গেছে শুনি নাই। কেবল শুরু হলো করোনার হানা। তখন আমি পার্বত্যনিউজে কাজ করতাম। লকডাউনে অফিসেই থাকা শুরু করলাম আমরা। যেদিন থেকে লকডাউন সেদিনের পর থেকেতো প্রায় এক সপ্তাহ অফিস থেকেই বের হলাম না। একটু আধটু সিঁড়িত নামলেও সাথে সাথে করতাম গোসল। জানালা খুলতেও ভয় লাগতো বেশ। মনে হতো এই যেন করোনা উড়ে এসে শ্বাসের সাথে ঢুকলো পেটে। রং চা ছিলো নিত্য সাথি। অফিস ছিলো ১২ তলায়। সেখানে আমরা মাত্র তিনজন থাকতাম। এই তিনজনেও সেই কি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা! হুম-তখন ছিলো করোনার প্রথম ঢেউ। ক্বলিজ্বা কাঁপানো ভয়ে অস্থির হয়েছিলাম করোনার খবরে।

একদিকে নিজের ভিতরে ছিলো ভয় আর অন্যদিকে সরকারের দেয়া লকডাউনে আরো ভয় ঢুকলো। দু‘টো ভয়ের মিলনে নিজেদের করোনা থেকে রক্ষার আরো কি চেষ্টা! রাস্তা ছিলো একেবারে ফাঁকা। মাঝে মাঝে মামুন(অফিস পিওন) বের হতো। গিয়ে বাজার করে আনতো । অবশ্য আমিও মাঝে মাঝে সাথে যেতাম। গেলে দেখতাম পল্টন গলির ভিতরের এলাকায় কোন পুলিশের নাম নিশানা তেমন নেই। তবে, নেই কোন মানুষের উপস্থিতি। কারণ, তখন মানুষ নিজ থেকেই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টায় মগ্ন ছিলো। অথচ-

প্রথম ঢেউয়ের সময় যে ভয়-ডর মানুষের মধ্যে ছিল, তা কিন্তু এবার নেই। এবার যেন করোনার সাথেই করছে সংসার। এবার সরকারও নামেমাত্র লকডাউন দিচ্ছে বটে। তবে বাঘ আসার গল্পের মত। মানুষও নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে সরকারের এই বাঘ আসা গল্পের মত লকডাউনের সাথে। লকডাউন যেন এবার মুখের বুলি কেবল। কাগজে ছাপছে কঠিন লকডাউনের হুঁশিয়ারি বাস্তবে তার শূণ্যসার। আর শূণ্যসার হবে না কেন! প্রথম ধাপের লকডাউন ছিলো সবার মাঝে করোনার ভয়। আর এই ধাপের লকডাউন কেবল করোনার ভয় না। লকডাউন শোনা মাত্রই গরিবের মস্তিস্কে গিয়ে আঘাত দিচ্ছে ক্ষুদার ভয়।করোনায় মারা যাওয়ার ভয়ের চেয়েও ক্ষুদার ভয়টা এই ধাপে কাজ করছে বেশি।

গতবার দেয়া করোনায় ছিলো নিজের কাছে কিছু সম্বল, তা দিয়েই না হয় চলছে লকডাউনে থাকা সময়টা। গতবারের রেশ না কাটতেই আবার লকডাউন! এবার কিন্তু জমানো কিছুই নেই উঁচু, নিঁচু আর মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারের। কিছু কারণে সরকারের প্রতিও সাধারণ জনগণের কোন আস্থা নেই। কারণ সরকারের দেয়া ত্রাণ কেবল ছলে-বলে কৌশলে নিচ্ছে আর খাচ্ছে সরকার দলীয় লোকগুলোই। কারো বাসায় পাওয়া গিয়েছে তখন চালের বস্তা আবার কারো বাসায় সয়াবিন তেলের খনি। আলুর মিনি বাজার ছিলো এক একটা মেম্বার-চেয়াম্যানের বাসা। এই জন্য এবার করোনায় সরকারের অনুদানের উপরও বিশ্বাস রাখতে পারছেনা সাধারণ জনগণ।

স্বেচ্ছাসেবি সংগঠনগুলোও এবার কেমন যেন চুপসে গেছে। যাওয়ারই কথা। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো চলে স্বাবলম্বীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে। এবারতো আর সেই অর্থের যোগানদাতারা একেবারে ফ্রি নেই। এবার তারা মগ্ন হেফাজত আর মামুনুলের রিসোর্ট কাণ্ডে কিংবা মির্জা আব্বাসের ইলিয়াসকে নিয়ে বোমা ফাটানো কাণ্ডে। এবার আর স্বাবলম্বীরাও এসব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর পাশে নেই। তাইতো চোখেও পড়ছে না তেমন তাদের আনাগোনা।

করোনা, লকডাউন আর চলছে রাজনীতি। এতসবের ভিতরে কি আর বন্ধ থাকবে গরিবের পেটনীতি! গরিব বুঝেনা করোনার প্রকোপ। গরিব জানে পেটে দিতে হবে অন্ন। সেই অন্ন অন্বেষণে গরিব ছুটে রাস্তায়। একমুঠো খাবারের বন্দোবস্ত করতে পারলে চলবে একটি পরিবার। কিংবা ঘরে আছে বৃদ্ধা অসুস্থ মা। লাগবে ঔষুধ।দিকবেদিক হারিয়ে রিকশা কিংবা যে যার অবস্থান থেকে অর্থ উপার্জনের নামছে রাস্তায়। ওমা! রাস্তায় নামামাত্রই ধরলো পুলিশ। চাইলো মুভমেন্ট পাশ।

গরিব মনে করলো মুভমেন্ট পাশ মনে হয় করোনায় চেয়েও ভয়ংকর কিছু। কারণ যার কাছে স্মার্ট ফোন ই নাই তার আবার মুভমেন্ট জানা। অবশেষ মারধর আর রাস্তায় রিকশা উল্টিয়ে দেয়া। কোথাও আবার পুলিশকে টাকা দিলে ছেড়ে দেয়ার অনেক তথ্যও গণমাধ্যম দি্চ্ছে। এই মুভমেন্ট পাশ যেন পুলিশের ভাগ্যে পূর্নিমার চাঁদ। মুভমেন্ট বিহীন রাস্তায় নামলেই আলাদা ইনকাম হচ্ছে অনেক পুলিশের। বাহ আয়ের উৎস।

ইতোমধ্যে ভারতের অবস্থা নাজেহাল। শ্মশানের মৃতদের দেহ পোড়ার গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে পুরো ভারত জুড়ে। অথচ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে এখনও করোনাকে মনে হচ্ছে সর্দি-কাশিময় একটু অসুখ বৈ আর কিছুই না। অথচ মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেট–এর সর্বশেষ পর্যালোচনা বলছে(প্রথম আলো থেকে নেয়া), এই ভাইরাস বাতাসে ভর করে ছড়ায়। এটি যে একটি বায়ুবাহিত রোগ, তার পক্ষে তারা ‘ধারাবাহিক ও দৃঢ়’ প্রমাণ পেয়েছে।

তারা বলছে, জনস্বাস্থ্য সংস্থাগুলো যদি এটিকে বায়ুবাহিত ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে কপালে আরও দুঃখ আছে। পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হবে। তার মানে আমাদের আগের সেই ছয় ফুট দীর্ঘ সামাজিক দূরত্ব আর মাস্কের ব্যবহার দিয়ে বাতাসবাহিত জীবাণু আটকানোর ধারণা এখন প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল। এটি যদি বায়ুবাহিত ভাইরাস বলে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়, তাহলে বায়ুশূন্য কাচের ঘরে লখিন্দর হয়ে বসে থাকা ছাড়া সংক্রমণ এড়ানোর আর কোনো উপায় থাকবে না।

তারমানে যেকোন সময় ভারতে ভয়ংকর রুপ নেয়া করোনা হানা দিতে পারে আমদের ছোট্ট এই দেশটাতে। আমাদের অবস্থা কি হবে। সামান্যতেই রাস্তায় পড়ে আছে রোগী। অক্সিজেন সংকটতো বহু আগ থেকেই আছে। হাসপাতালে সামান্য বেড পেতে দম বের হয়ে যাচ্ছে রোগীর। গতবারের চেয়েও এবার সংক্রমণ হচ্ছে বেশি, মানুষও মরছে বেশি।

কিন্তু পাবলিক, বিশেষ করে ব্যবসায়ী ও দিনমজুরশ্রেণি এবার আর ঘরে থাকতে চাইছে না। তারা ধরে নিয়েছে ঘরে থাকলেও আমাকে মরতে হবে ক্ষুদায় আর বাহিরে গেলে মরতে হবে করোনায়। করোনায় আক্রান্ত হবো কি হবো না তাও নিশ্চিত না। কারণ দেখা গেছে স্বাস্থবিধির সম্পূর্ণতা মানার পরও অনেক লোক করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে। আবার বহু রিকশাওয়ালা মাস্ক-হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার না করেও এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাস্তায়।

সুতরাং গরিব মনে করে করোনায় মৃত্যু নিশ্চিত না তবে, ক্ষুদায় মারা যাওয়া নিশ্চিত। তাই গরিব ক্ষুদায় মরতে চাই না। গরিবের নীতি যেন, রফিক আজাদের সেই বাণী- ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো।

ভারতে হানা দেয়া ভয়াবহ করোনার আক্রমণ থেকে সরকার দেশকে বাঁচাতে হলে আনুষাঙ্গিক যে কাজগুলো করতে হবে তারসাথে নতুন আঙ্গিকে করতে হবে গরিবের অন্ন ব্যবস্থা। গতবারের সিস্টেম পরিবর্তন করে গরিবের ঘরে খুব দ্রুত পৌঁছে দিন খাদ্য।চাকরিজীবীদের চাকরি হারানো থেকে বাঁচার নিশ্চয়তা দিন। জনগণের মৌলিক চাহিদা আঞ্জাম দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে যে হারে করোনা হানা দিয়েছে তা থেকে বাঁচতে কঠিন পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের দাবি।

 

লেখক: শিক্ষার্থী এবং গণমাধ্যমকর্মী।
smarifpress@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here