মীর আব্দুল আলীম :: অসভ্যতারতো একটা সীমা থাকা চাই। দেরিতে হলেও করোনা ভাইরাসের নিরাপত্তার কথা ভেবে স্কুল কলেজসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলোসরকার; তাতে ফায়দা কি হলো? ছুটি পেয়েই দে..ছুট। অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে কক্সবাজার আর পর্যটন ষ্পট গুলোতে পাড়ি জমালো। এমন অবস্থায় সরকার কক্সবাজারসহ পর্যটন ষ্পট গুলো বন্ধ করতে বাধ্য হলো। কতটা অসভ্য আমরা। অসচেতন আর কাকে বলে? এমনিতেইতো ভাবনার শেষ নাই। বিদেশ থেকে দেশে ঢুকেছে প্রায় ৬ লাখ দেশী এবং ভীনদেশী। হাস্যকর হোম কোয়ান্টাইনের কথা শুনছি এখন। সেটা কি তাই তো বুঝি না। যেখানে জেল জরিমানা দিয়ে মানুষ বশ করা যায়না সেখানে সেচ্ছায় বাসগৃহের কোয়ারেন্টাই। বাহ্। ভালইতো।

আমারা সতর্ক নই বললেই চলে। জনসমাগম সবখানেই হচ্ছে। হাটবাজার পুরদমে জমছে। ইসলামীক সমাগমও বন্ধ নেই। আগের চেয়ে বাজারে এখন বেশি মানুষ। মানুষের হুশ নেই। আগাম পণ্য কিনতে বাজারে ছুটছেতো ছুটছেই। এই সুযোগে চাল, ডাল, তেল, ঝাল, মরিচের দাম বেড়েই চলেছে। ক’দিন পরে নাকি বাজার থেকে খাদ্য পণ্য উধাও হয়ে যাবে। হুজুগে বাঙ্গালতো বলছে; নাকি দু:ভিক্ষ লেগে যাবে দেশে। পঙ্গপালের কথাও কেউ কেউ বলছেন। আমিতো ভাবছি মুনুষ মরার কথা। আল্লাহ মাফ করুক আমাদের। মানুষ মরলে কারা কিনবে এসব পণ? কারাইবা খাবেন মজুত করা খাবার। শোকাহত মানুষের খাদ্য খাবারের প্রতি মন এনিতেই কমে যাবে। তাছাড়া শহরে মানুষ কিন্তু কিছুটা সচেতন।

ঢাকা শহরেতো এখন যানজট নেই বললেই চলে। ঢাকা এখন ফাঁকা হচ্ছে। হোটেল রেস্তোরায় মানুষ কম যাচ্ছে? মানুষ বাহিরের খাবার খাচ্ছে কম। ঢাকাসহ অপরাপর শহর থেকে গ্রামে যাচ্ছে মানুষ। পণ্যের চাহিদাতো উল্টো কমবে। চাহিদা কমলে পণ্যমূল্য না কমে বাড়বে কি করে? হুজুগ, হুগুগ আর হুজুগে বাঙ্গাল। চিলে কান নিয়েছেতো চিলের পেছনেই ছুটছে মানুষ। টাকা পাতা (থানকুনি পাতা) খেলে করোনা ধারে কাছে নাকি আসে না; এ কথা ফেসবুকে দেয়ার পর ১০ টাকার পাতা এখন নাকি ২’শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভারতে এমন প্রচার গোমূত্র নিয়েও। একারনে ভারতে গোমূত্রের দাম নাকি এখন বেশ চড়া। বাংলাদেশেও যদি কেউ বলে ফেলেন গোমূত্র পান করলে করোনা উধাও হবে। আর তা যদি ফেসবুকে কেউ ভাইরাল করতে পারে তাহলে মুসলমানও হয়তো গোমূত্র পান শুরু করবে। এদেশেও বোধ করি গোমূত্রের টান পড়ে যাবে। তখন গরুর পেছেনে হা করে লাইনে থাকবে হয়তো হুজুগে মানুষ। ক্ষেত্র বিশেষ কিউ কেউ মহা সংকটের গোমূত্র পেতে গরু কেটে কিডনি থেকে গোমূত্র চিপে বের করতে চাইবেন। হুজুগে বাঙ্গাল বলে কথা।

সারা বিশ্ব যেখানে সতর্ক সেখানে আমাদের দেশে সবকিছু অনেকটা স্বাভাবিক। পরে হয়তো বুঝতে পারব কতটা ক্ষতি হলো আমাদের। আল্লাহ মাফ করুক। একটা কথা মনে রাখতে হবে সার্স, ডেঙ্গু বা ইবোলার মতো নানা ধরণের প্রাণঘাতী ভাইরাসের খবর মাঝে মাঝেই সংবাদ মাধ্যমে আসে। এমন মহাবিপদ থেকে আল্লাহ আমাদের উদ্ধারও করেন। ইসলাম ধর্মে এসব রোগ-বালাইয়ের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। আল-কোরআনে মহামারী হলে যেযার স্থানে থাকার কথা বলা আছে। অন্য ধর্মেও রোগের ক্ষেত্রে সতর্ক করা আছে। প্রয়োজন না হলে ক’দিন নিজের জন্য; পরিবারের জন্য; অন্যের জন্য ঘর থেকে বাহিরে না যাওয়াই ভালো। প্রয়োজন থাকলে কি আর করা। আল্লাহ ভরসা। মনে রাখবেন এ সমস্যা কিন্তু অনেক দিন ধরেই থাকবে না। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেনই। কিছুদিন যারা সতর্ক থাকতে পারবেন, সবকিছু ঠিকঠাক মেনে চলবেন তারা হয়তো এ বিপদ থেকে অনেকটা মুক্ত থাকতে পারবেন। তবে আমারা বেশিই অসাবধান মনে হয়। কোন কিছুকেই গুরুত্ব দিতে চাইনা কখনো। কোন কিছু মানতে চাইনা। আল্লাহই আমাদের রক্ষা করবেন।

১৯ মার্চের পত্রিকার শিরোণাম-‘নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশে ঢুকলেন ইউরোপ ফেরত ৭ জন’। রাষ্ট্রের হুকুম নড়লই।নিয়ম মানছি কই? সরকার ইউরোপ থেকে আর কাউকে গ্রহন করবে না বলে নিষেধাজ্ঞা দিলো। পরদিনকতা ভঙ্গ হলো। আমরা যেভাবে করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে আগতদের গ্রহন করেছি আমাদের তা কতটা ঠিক হয়েছে। দেশে ১৬ কোটি মানুষের জানের নিরাপত্তা বলে কথা। আমরা মানুষের জীবনের কথা ভাবীনি মোটেও।মনে চোট লাগে যখন শুনি এয়ারপের্টে বিদেশ ফেরতদের দেশে ঢুকতে ঘুষ নিচ্ছে। আসলে ঘুষখোরদের কোন নীতি নাই। টাকার কাছে দেশের মানুষের জীবনতো তুচ্ছ। আল্লাহ মাফ করুক নিজের স্বজন খোয়া গেলে হয়তো তাদের বোধ হলে হতেও পারে।

প্রশ্ন হলো করোনাভাইরাসের কারণে সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইউরোপের দুই দেশ থেকে সাতজন দেশে কিভাবে আসলেন। গত বুধবার (১৮ মার্চ) রাতে তারা সুইডেন ও স্লোভেনিয়া থেকে পৃথক দুই ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছান। পরে তাদের কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়।ইউরোপ থেকে কাউকে এদেশে গ্রহন করা মানে মহা ঝুঁকির। ১৬ মার্চও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে দেশে আসেন ইউরোপের ৯৬ যাত্রী। এভাবে চিনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ইতোমধ্যে আমরা প্রায় ৬ লাখ করোনা ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে গ্রহন করেছি। আল্লাহই জানেন আমাদের ভাগ্যে কি আছে।তিনি (সৃষ্টিকর্তা) কৃপা না করলে হয়তো এতোদিন মড়ক লেগে অনেকটা ছাফ হয়ে যেতো। আল্লাহর অশেষ রহমতে এখনও করোনা মৃত একজনই আছে।

করোনা ভাইরাস আতংকে ভোগ্য পণ্য ক্রয়ের হিড়িকের কথা বলছিলাম। মানুষ বাজারে গিয়ে লাইন ধরে পণ্য কিনছেন। গিন্ন ফরমাইশী নিত্য বাজার করতে বাসার পাশের পাইকারী দোকানে ভিড় দেখে ভয়েই সেখানে ঢুকিনি সেদিন। প্রয়োজনীয় বাজার না আনায় রাতে বেশ বকুনী জুটেছে কপালে। পরদিন বাসার কাজের জন্য প্লাইবোর্ড কিনতে রাজধানীর গুলশান বাড্ডা এলাকার এক কাঠের দোকানে ঢুকলাম। ঢুকতেই দেখি কয়েক বস্তা করে ডাল, চাল আর চিনি সাজানো। কাঠ আর কি কিনব, গিন্নির চাহিদার জিনিসতো কাঠের দোকানেই পেলাম। বেশ খুশী হলাম। কাঠের কথা না বলে (রহস্য করে) ডাল, চাল, চিনির দাম জিঙ্গাস করতেই ঐ দোকানের জনৈক কর্মচারি বললেন ‘স্যার এটা বসের বাসার জন্য কে না, বিক্রির জন্য নয়’।

আসলে সব বসেরই এখন এক রূপ। পণ্য কিনে সারাবর করছে বাজার। দিন আনা দিন খাওয়া লোকদের কি হবে ভাবনায় নেই কারো। একসাথে সবাই বেশি বেশি পণ্য কেনায় বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। পণ্য মূল্যের দাম রাতারাতি বাড়ছে। এমনিতেইতো এদেশের ব্যবসায়ীদের স্বভাব বেশ ভালো! তার উপর এমন অজুহাত পেলে কি আর রক্ষা আছে? যা হবার তাই হচ্ছে। বাজারে রীতিমতো আগুন লেগেছে। তবুও হুজুগে মানুষের কেনাকাটা বন্ধ নেই। বোধ করি কেউ কেউ বউয়ের গয়নাগাটি বিক্রি করেও পণ্য মজুতে নেমেছেন হয়তো।প্লিজ দোহাই আপনাদের এভাবে পণ্য কিনে বাজারে সংকট তৈরি করবেন না। আপনাদের কারনে দিনএনে দিনখাওয়া মানুষগুলো কষ্টে পড়বে। আপনি হয়তো এক টাকার জিনি দু’টাকায় কিনতে পারবেন।

তাঁদের কি হবে? করোনা আতংকে এমনিতেই অনেকে বেকার। আয়রোজগার কমেছে। তার উপর পণ্যমূল্যের চাপ তারা কি করে সামাল দিবে বলুন?
বিশ^ জুড়েই এখন করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। করোনার ছোবল বাংলাদেশেও। যখন লিখছি তখ নপর্যন্ত এদেশে ১৭ জনের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে বলে আইইডিসিআর দাবি করেছে। মারা গেছেন ১ বৃদ্ধ। করোনায় করুণা করছে না কাউকে। মানুষ মরছে প্রতিদিন।

আমাদের সবসময় প্রস্তুত থাকা দরকার। আমরা কতটা প্রস্তুত? আর কতটা শতর্ক? শতর্কতা খুবই কম। রাজধানী কেন্দ্রীক প্রস্তুতি থাকলেও জেলা কিংবা উপজেলা পর্যায়ে প্রস্তুতি তেমন চোখে পড়ে না। আমাদের জনবল খুব কম। সরঞ্জামও কম। করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে তাতে সামাল দেয়া কঠিনই হবে। আমাদের জনগনও সচেতন নয়। একবার করোনা ছড়িয়ে পরা শুরু করলে সর্বণাশ হয়ে যাবে। এ জন্য আগেভাগেই জনগনকে সচেতন করে তুলতে নানা কর্মসূচি গ্রহন করা উচিৎ। প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় সতর্কীকরণ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা দরকার। সভা সেমিনার করা দরকার। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ সবখানে সভা সেমিনার করে জনগনকে করোনা ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে বুঝাতে হবে। যা এখনও চোখে পড়ছে না আমাদের।

করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের যুদ্ধে নামতে হবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। ঘুরতে না যাওয়ার, বেশি মানুষ এক জায়গায় না হওয়ার, আড্ডাবাজি বন্ধ করতে হবে। করোনা নামক শত্রু এদেশে ঢুকে পরেছে। সবাই সতর্কতার যুদ্ধে ঝাপিয়ে না পরলে আমরা হয়তো এ যুদ্ধে হেরে যাব।আসুন সবাই সতর্কতার যুদ্ধে নামি। যেহেতু করোনার ঔষধ এখনো আবিস্কার হয়নি সেজন্য সতর্কতার যুদ্ধের বিকল্প নাই। এ যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে। যুদ্ধ জয়ের জন্য আমরা আতঙ্কগ্রস্ত হলে চলবে না। দিশেহারা হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করার পাশাপাশি ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিকভাবে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সর্বদা বজায় রাখতে হবে। নিজে সতর্ক থাকতে হবে অপরকে সতর্ক করতে হবে। ভাইরাস থেকে রক্ষার একটাই পথ সতর্কতা।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বাংলাদেশের ইনস্টিটিউট ও এপিডেমাইওলজি, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা (আইইডিসিআর) প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অতিত নিকটে বলেছেন, চীনসহ শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা। বাংলাদেশেও আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। করোনায় আমাদের জীবনের ঝুকি কেবল তা নয় অর্থনৈতিকভাবেও আমরা পিছিয়ে যাব। দিকে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আংকটাড করোনাভাইরাস এর কারণে বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ২০টি দেশের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। এটা ভাববারই বিষয়।

আমরা যোদ্ধার দেশ। আমরা যোদ্ধা। আল্লাহ আমাদের সহায় হবেনই। এটা আমাদেও বিশ্বাস। আমরা দেশের জন্য যুদ্ধ করে দেশ পেয়েছি। ডেঙ্গু, কলেরা-ডায়েরীয়ামহামারী সামনে ফেলে সফল হয়েছি। করোনা ভাইরাস মোকাবেলা করে আমদের এ পরিস্থিতিও জয় করতেই হবে। সব ভয়কেই দুরে সরিয়ে নির্ভয়ের, নিরাপদের বাংলাদেশ গড়তেই হবে আমাদের।

 

 

 

 

 

লেখক : সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গবেষক। E-mail- newsstoremir@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here