মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন

মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন :: ঘন্টায়, ঘন্টায়, দিনে দিনে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) এর অতি দ্রুত প্রসারের কারণে বিশ্বের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হচ্ছে। এটা অর্থনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য গভীর চিন্তার বিষয় হয়ে পড়েছে। সমস্যা দিন দিন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে নানা দিক থেকে। ব্যবসা-বাণিজ্য, রুজি-রোজগার থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন এবং পৃথকীকরণের সূত্রের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে সামাজিক ক্রিয়াকলাপের প্রতিটি ক্ষেত্র প্রভাবিত হচ্ছে। তাই ট্যাক্স ডিজিটালাইজেশন বিষয়টি ট্যাক্স চ্যালেঞ্জগুলির জন্য একটি নতুন রেজোলিউশন, যা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা হওয়া অবশ্যই ব্যতিক্রম নয়, বরং সময়োপযোগী।

বাংলাদেশের ন্যায় ক্রমবর্ধমান উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য, কোভিড-১৯ একটি বাস্তব আলোচনার বিষয়। করোনায় অর্থনীতির যে ব্যাপক ঝুঁকির মুখোমুখি আমরা হতে যাচ্ছি তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে আমাদের উপায়গুলি নিয়ে ভাবনা, গভীরভাবে চিন্তা করা এবং বাস্তবায়নের জন্য কাজ শুরু করা অবশ্যকতা রয়েছে। আজ বিশ্বব্যাপী যে বিষয়টি প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তার মধ্যে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য সরকারের রাজস্ব আদায়ের কৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাথে সাথে করদাতার আয়কে সহায়ক ও সহনীয় পর্যায়ে সহযোগিতা করে কিভাবে আয়কর আদায় করা অব্যাহত রাখা যায় সে কৌশল নিয়ে ও ভাবনার অন্ত নাই।

একদিকে আয়কর আদায় ডিজিটাল পদ্ধতির প্রয়োগ, অন্যদিকে ব্যবসা-বান্ধব আয়কর ব্যবস্থা চালু করা একটি সমসাময়িক কৌশল প্রয়োগ করাই হবে অর্থনীতির জন্য সহায়ক। এটা একটা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বকে এখন এর নতুন নতুন কৌশল নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।

এখানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও একটা বড় বিষয় হিসেবে দেখা দিবে। কারণ অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে গেলে রাজনৈতিক মতানৈক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি লক্ষ্যণীয় বহুবিধ চ্যালেঞ্জ, তবে উগ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন আবশ্যক। এই ব্যবহারিক চ্যালেঞ্জগুলিকে উত্তরণের শিক্ষা ও প্রস্তুতি কোভিড-১৯: এর পরবর্তী কাজ হিসেবে আমাদের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করার পথ বাতলিয়ে দিচ্ছে।

সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশ ও মহামারী করোনার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব দৃশ্যমান। সরকারের রাজস্ব আদায়ের জন্য জাতীয় রাজস্ববোর্ডকে প্রস্তুতি নিতে হবে আধ-ঘাট বেঁধে। ইতিমধ্যে নানা উদ্যোগ হয়তোবা তাঁরা নিয়েছেন। করোনার ছুটির মধ্যেই অফিস খোলা রাখার কথাও শোনা যাচ্ছে।

কিন্তু কতটুকু সফলতা আসবে তা অনুমান করা কঠিন। গতানুগতিক অফিস আর রিটার্ন জমা, ট্যাক্স জমার পদ্ধতি থেকে বের না হলে রাজস্ব বোর্ড তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য ত দূরের কথা রাজস্ব আদায়ের সাথে জড়িত লোকবলের খরচ, অফিস খরচ উঠাতে পারে কি না সন্দেহ হচ্ছে। এ সন্দেহ হওয়ার কারণ হচ্ছে করোনা মহামারীর পূর্বে রাজস্ব আদায়ের হার মূল্যায়ন দেখে। ফলে রাজস্ব বোর্ড হয়ে উঠতে পারে সরকারের আরেকটা চিন্তার বিষয়।

সুতরাং এখনই প্রয়োজন তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অতিদ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কত কম খরচে করদাতাদের কাছ থেকে কর আদায় করা যায়, তা নিয়ে কাজে নেমে পড়া। প্রসঙ্গে বলতে হয়, কিছু কর্মকর্তা গতানুগতিক পদ্ধতি থেকে বের হতে চাইবেন না। কিন্তু তাদের হীন স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে সরকারকে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এক্ষেত্রে যে যে সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করা যেতে পারে:
১. জটিলতা পরিহার করে,সংক্ষিপ্ত পরিসরে আয়কর রিটার্নের একটি অনলাইন ভার্সন চালু করা, যাতে সহজে করদাতাগণ নিজে বা তার সহযোগী/আয়কর আইনজীবীদের মাধ্যমে রিটার্ন জমা দিতে পারেন।
২. রিটার্ন জমা হওয়ার সাথে প্রাপ্তি স্বীকার পাওয়া এবং সার্টিফিকেট দরকার হলে তা যেন একইভাবে অনলাইনে পাওয়ার ব্যবস্থা থাকে।
৩. সংশ্লিষ্ট ফরম হবে সংক্ষিপ্ত এবং মৌলিক তথ্য সম্বিলিত।
৪. আয়করদাতাগণ শুধু মাত্র তাদের টিআইএন নাম্বার দিলেই অটোমেটিক তার নামে আলাদা পাতা ওপেন হবে। যাতে একটা পাসওয়ার্ড এর ব্যবস্থা থাকতে পারে। এতে করে সহজে করদাতা নিজেই পাসওয়ার্ডটি প্রতিস্থাপন করতে পারেন।
৫. করদাতা নিজের ইচ্ছেমত সকল তথ্য দিতে পারবেন, পরবর্তীতে ভুল হলে তা যেন নিজেই সংশোধন করতে পারবেন;
৬. করাদাতার প্রদেয় আয়কর প্রদানের জন্য বিকাশ/নগদসহ সকল অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা। যাতে ভার্চুয়াল রিটার্ন পোস্টিং দেয়ার সাথে সাথে তার প্রদেয় করের পরিমাণ জানিয়ে দিবে এবং পরিশোধের জন্য একটা সময় বলে দিবে। ঐ সময়ের মধ্যে করদাতা তার প্রদেয় কর বিকাশ/নগদসহ অন্যান্য মাধ্যমে জমা দিলে একটা কোড দেয়া হবে। উক্ত কোড পোস্টিং দিলেই করদাতার রিটার্নটি গৃহিত হবে। গৃহিত হলে অটোমেটিক একটা মেসেজ তার মোবাইলে বা ই- মেইলে প্রাপ্তি স্বীকার চলে আসবে।
৭. করদাতার জন্য বিভিন্ন অপশন থাকবে-যেমন আপনার কি সার্টিফিকেট প্রয়োজন? করদাতা টিক চিহ্নতে ক্লিক করলেই তার সার্টিফিকেট প্রিন্ট/সেভ/ইমেইলে চলে আসবে।
৮. একইভাবে ভ্যাট রিটার্ন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রেও করা যেতে পারে।
৯. এব্যাপারে ব্যাপক পরিসরে প্রচার প্রচারণার ব্যবস্থা করা; যাতে করে সহজে করদাতাগণ নিজেদের সুবিধার কথাগুলি বুঝতে পারে এবং অনলাইনে ভার্চুয়াল রিটার্ন জমা দিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
১০. করদাতার কোন বিষয়ে অধিকতর ব্যাখ্যা জানার প্রয়োজন হলে ই-নোটিশ করার ব্যবস্থা রাখা;
১১. ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে কর মামলা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা;
১২. সংশ্লিষ্ট আয়কর আইনজীবীদের ব্যাপকহারে একাজে লাগানো যেতে পারে। বর্তমানে অনেক তরুণ আইনজীবীগণ আছেন, যারা তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞানে যথেষ্ট ভাল। তাদেরকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
১৩. কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের অনলাইনে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা যেতে পারে।

ভার্চুয়াল কর ব্যস্থায় সরকারের রাজস্ব আদায়ে যে যে ক্ষেত্রে সাফল্য আসতে পারে:
১. কম লোকবল ব্যবহার করে অধিক পরিমাণ রাজস্ব আদায়;
২. অতিসহজে ই-টিআইএনধারী সকল করদাতাকে করজালে নিয়ে আসা সম্ভব হবে;
৩. করাদাতাগণ উৎসাহি হবেন;
৪. কর রিটার্ন জমা দিতে গেলে হয়রানির শিকার হতে হয় বলে যে অভিযোগ আছে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে;
৫. তথ্য প্রযুক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত হবে;
৬. অতিসহজে করদাতাকে মনিটরিং করা যাবে;
৭. করদাতাকে নোটিশ করার প্রয়োজন হলে সহজে করা সম্ভব হবে;
৮. কর মামলা অতিদ্রুত নিষ্পত্তি করে সরকারের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।

অনেকে বলবেন, আমাদের তো অনলাইনে রিটার্ন জমা দেয়ার ব্যবস্থা আছেই। আমিও জানি আছে। কার্যকরভাবে নাই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনলাইন সিস্টেম এর ওয়েব সাইটটি https://www.etaxnbr.gov.bd/tpos/registration । কিন্তু দুঃখজনক হলো আপনি সাইটটিতে গিয়ে বিব্রত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হবেন। কারণ প্রথমে ভাল একটা উপদেশ দেয়া আছে। কিন্তু দ্বিতীয় অপশনে গেলেন (To register account for Income tax online filing system –Click here.) কোন কাজ করবে না। আপনি রেজিস্টেশনই করতে পারছেন না। বহু অভিযোগ আমার কাছে এসেছে। পরে বাধ্য হয়ে বলতে হলো-ভাই আপনি হার্ড কপি জমা দিয়ে আসেন। তাহলে এমন অনলাইন ব্যবস্থার দরকার কি? বিগত কয়েক বছর ধরে ডিজিটাল পদ্ধতি যেরূপভাবে ব্যবহার করার কথা আলোচনা হয়ে আসছে, সেরূপ ব্যবহার করার জন্য জাতীয় রাজস্ববোর্ড উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি অর্জন করতে পারছে বলে মনে হয় না। এটাই তার বড় উদাহরণ।

বর্তমানে কোভিড-১৯ এর পরবর্তী অর্থনীতি ঘুরে দাড়ানোর জন্য কর পরিশোধ, কর আদায়, কর-মনিটরিং, কর-মামলা নিষ্পত্তি ইত্যাদিতে ডিজিটাল করনীতি ঘোষণা করা এবং তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরী ও অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।

আমাদেরকে সরলভাবে স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের কর আদায় পদ্ধতি অন্য যে কোন রাষ্ট্রের তুলনায় দুর্বল। তাছাড়া আমাদের দায়িত্ববানদের অধিকাংশ স্বচ্ছ নয়। এছাড়া আমাদের আয়কর বিষয়ে সুনিদিষ্ট কোন আইন নাই। ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশ দিয়ে বর্তমান সময়ে আয়কর ব্যবস্থাপনা করা খুবই কঠিন। আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪ এর বিভিন্ন দুর্বলতা থাকায় আয়কর কর্তারা যে কোন সময় একটা এসআরও জারি করে সহজ কোন বিষয়কে জটিল করতে পারেন, আবার সরকারের কোটি কোটি টাকা আদায় করার সুযোগ থাকলেও তা নামে মাত্র আদায় করে অব্যাহতি দিতে পারেন। এসুযোগগুলো আইনের ব্যাপক দুর্বলতা।

আমরা যদি গভীরভাবে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলি কর আদায়ে ডিজিটাল পদ্ধতি অগ্রগতি ব্যাপক। ভারত ও ব্যাপক হারে গত ৩-৪ অর্থ বছরে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করছে, তাদের সফলতাও অনেক।

ট্যাক্স টেক ইন্ডিয়া জরিপ ২০১৬ তে পরিচালিত জরিপের ওপর ভিত্তি করে বলা যায় ট্যাক্স আদায় এবং ব্যবসায় পরিচালনায় প্রযুক্তির ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অন্যদিকে আমরা ডিজিটাল ডিজিটাল করতে করতে মুখে ফেনা তুলছি, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করতে পারছি না।

বর্তমানে করোনা মহামারি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ভার্চুয়াল বনাম ডিজিটাল অর্থনীতি, করনীতি ও কর আদায়নীতি কতটা প্রয়োজন, শুধু প্রয়োজন নয়, কতটা জরুরী। এটা সম্ভবও। আমরা অনেকে এখন অভ্যস্ত ডিজিটাল পদ্ধতির সাথে। অভ্যস্ত হচ্ছি বা হতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ এর কোন বিকল্প এখন আর চিন্তা করা যাবে না।

তবে হ্যাঁ এনালগ পদ্ধতি থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তরের কতগুলি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ চ্যালেঞ্জগুলিকে বড় আকারে না দেখে তা মেনে নেয়াটাই জরুরী। আগামী ১জুলাই ২০২০ এর পূর্বে সরকার তথা রাজস্ব বোর্ড কর ব্যবস্থাকে ডিজিটাইলেশন করার উদ্যোগ নিবেন এ প্রত্যাশা আমাদের সকলের। এটা সময়ের দাবি।

 

 

 

লেখক: আয়কর আইনজীবী-ঢাকা

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here