ঢাকা :: কোভিড-১৯ মহামারী সময়ে শ্রমিক, সম্মুখযোদ্ধা ও জরুরী সেবা প্রদানকারীদের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নীতি পর্যালোচনা করে তাতে মহামারী পরিস্থিতিতে শ্রমিক ও কর্মক্ষেত্রের জন্য করণীয় বিষয়গুলো পুণর্বিবেচনা ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ সংযোজনের আলোকে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন সরকার, ট্রেড ইউনিয়ন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস এর উদ্যোগে আয়োজিত ”কোভিড-১৯: পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সবার জন্য (শ্রমিক, সম্মুখযোদ্ধা, সেবা প্রদানকারী)” শীর্ষক ওয়েবিনারে আজ ১২ আগস্ট বক্তারা এ অভিমত ব্যক্ত করেন।

শ্রমজীবী মানুষ, কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সম্মুখ যোদ্ধা এবং সেবা প্রদানকারীদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার উপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব এবং অসহায়ত্বের তুলনামূলক পর্যালোচনা;  সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রণীত নীতিসমূহের ঘাটতি বিশ্লেষণ; বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অংশগ্রহণকারীগণের মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ এবং এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে এ সভার আয়োজন করা হয়।

বিলস চেয়ারম্যান মোঃ হাবিবুর রহমান সিরাজের সভাপতিত্বে এবং মহাসচিব নজরুল ইসলাম খানের সঞ্চালনায় আয়োজিত ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ এন্ড সায়েন্স এর ডিপার্টমেন্ট অব অকুপেশনাল হেলথ এন্ড এনভায়রনমেন্টের ফ্যাকাল্টি মেম্বার এ কে এম মাছুম উল আলম।

প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন-বিএমএ সাবেক সভাপতি ড. রশিদ-ই-মাহবুব। সম্মানিত আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন, শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম-এসএনএফ এর আহ্বায়ক ড. হামিদা হোসেন, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক (স্বাস্থ্য শাখা) ডাঃ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, বিলস ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল সভাপতি আনোয়ার হোসাইন, বিলস যুগ্ম মহাসচিব ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির  ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক হেলথ এর সহযোগী অধ্যাপক  ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা- ডব্লিউএইচও’র সাবেক সিনিয়র জাতীয় পরামর্শক ড. সালামত খন্দকার, আইএলও সাউথ এশিয়ার ডিসেন্ট ওয়ার্ক টেকনিকেল টিমের ওয়ার্কার্স অ্যাক্টিভিটিস স্পেশালিস্ট সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ, আইএলও আরএমজি প্রজেক্ট চীফ টেকনিক্যাল এডভাইজার জর্জ ফলার, ইন্ডাষ্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল (আইবিসি) সাধারণ সম্পাদক চায়না রহমান প্রমুখ।

মূল প্রবন্ধে এ কে এম মাছুম উল আলম বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। লকডাউন এবং সাধারণ ছুটি নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বিধা থাকার কারণে মানুষের সচেতনতার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটেছে। সমন্বয়হীনতার কারনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্যবিভ্রাট ও ক্ষেত্রবিশেষে গুজব রটেছে, যার কারণে মানুষের হয়রানির শিকার। স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর দুর্নীতি এ ক্ষেত্রে সমস্যাকে আরও বৃদ্ধি করেছে। জনসচেতনতা ও সমন্বয়ের অভাবের কারণে এলাকাভিত্তিক লকডাউন থেকেও আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়নি।

প্রধান আলোচকের বক্তব্যে ড. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, কোভিড-১৯ কোন পেশাগত রোগ নয়, এটি সংক্রামক ব্যাধি, এ  বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগ করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে এটি মালিকপক্ষকেই নিশ্চিত করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমিকদের সঠিক সুরক্ষা দিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শ্রমিকদের মধ্যে কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে অনুসরণ করতে হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন ।

কোভিড-১৯ মোকাবেলায় শ্রমিকদেরকে আরও সচেতন করতে ট্রেড ইউনিয়নকে এগিয়ে আসতে হবে উল্লেখ করে ড. হামিদা হোসেন বলেন, শ্রমিক শুধু এক শ্রেণীর নয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক মিলে বিভিন্ন ধরণের শ্রমিক রয়েছেন। কোভিড-১৯ সময়ে শ্রমিকদের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষকে একসাথে কাজ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, শ্রমিকদের খাদ্য ও যাতায়াতের ব্যবস্থা মালিকপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে।

কোভিড-১৯ সময়কালে শ্রমিকের সুরক্ষায় ট্রেড ইউনিয়নকে সঠিক ও কার্যকর ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে ড. সালামত খন্দকার বলেন, এক্ষেত্রে যে তিনটি বিষয়কে বিবেচনায় রাখতে হবে তা হচ্ছে, রোগের উৎস, এটি কিভাবে ছড়ায় এবং কিভাবে সুরক্ষিত থাকা যায়।

নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যসম্মত কর্মক্ষেত্র শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার উল্লেখ করে জর্জ ফলার বলেন, কর্মক্ষেত্রে পেশাগত সুরক্ষা আইএলওর সুপারিশকৃত শোভন কাজের একটি অংশ। এটিকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিতে হবে, বিশেষত কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে। এক্ষেত্রে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগকে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের জন্য একটি গাইডলাইন তৈরী করতে হবে।

চায়না রহমান বলেন, কোভিড-১৯ এর কারনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্রমজীবী মানুষ। তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের যে ঝুঁকি রয়েছে তা কমিয়ে আনার জন্য প্রধান দায়িত্ব মালিকপক্ষের। ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সুরক্ষার দাবীগুলো তুলে ধরলেও মালিকপক্ষ তাদের লাভের বিষয়টিই সর্বোচ্চ বিবেচনায় রাখছে। তিনি আরো বলেন, কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল। উপরন্ত নির্বিবেচনায় ছাঁটাই হচ্ছে শ্রমিক।

ডাঃ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান  বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি শুধুমাত্র স্বাস্থ্যগত সমস্যাই নয় বরং এটি একই সাথে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক সংকট। তিনি বলেন, এখন আমাদের কোভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরী করতে সকল পক্ষের মতামত জানা আবশ্যক বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের মৃত্যু শুধু সংখ্যা এবং খবরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে গৃহিত পদক্ষেপ সম্পর্কে জানা যাচ্ছে না। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বহু শ্রমিককে বাধ্যতামুলক কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন এটা বাংলাদেশের সংবিধান এবং আইএলও’র নীতিমালার সুস্পষ্ট লংঘণ।

তিনি আরও বলেন, সরকার ঘোষিত প্রণোদনার বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করা প্রয়োজন ছিল, যাতে সঠিকভাবে সকলে এটি অনুসরণ করে। এ বিষয়ে জরুরীকালীন আইন প্রণয়ন করার প্রয়োজনীয়তা এখনও রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সংক্রামক ব্যাধির কারণে শ্রম আইনের সঙ্গনিরোধ বিষয়ক অংশগুলো প্রয়োগ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শ্রমিকরা ঝুঁকিপুর্ণ নয় এ কথা বিবেচনা করলে পরবর্তী পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, ক্ষুদ্র কারখানাগুলো প্রণোদনা দিয়ে চালু করার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে করে শ্রমিকদের আয় অব্যাহত রাখা যায়। তবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এবং শ্রমিকদের জন্য রেশন ও নিজস্ব ব্যবস্থায় খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে বলে তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সৃষ্টির মাধ্যমে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার উপর জোর দেন তিনি।

আনোয়ার হোসাইন বলেন, আজকের আলোচনায় যে সমস্ত বিষয়গুলো উঠে এসেছে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করলেই তা শ্রমজীবি মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে।

স্বাগত বক্তব্যে নজরুল ইসলাম খান বলেন, কোভিড-১৯ নতুন রোগ হওয়ায় এ ব্যাপারে যথেষ্ঠ প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয় নি। পেশাগতভাবে এই রোগ মোকাবেলা করতে গিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীরা। এ ছাড়া প্রশাসনিক ক্ষেত্রে রোগাক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।

সভাপতির বক্তব্যে মোঃ হাবিবুর রহমান সিরাজ বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সকল পক্ষের করণীয় নির্ধারণেই এই ওয়েবিনারের আয়োজন। সুপারিশমালাগুলো অনুসরন করলে তা সকল পক্ষের জন্য সহায়ক হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।-প্রেস বিজ্ঞপ্তি

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here