রিপন আশরাফ :: সব কিছু অবশ্যই আগের অবস্থায় ফিরে আসবে না। করোনা যায়নি চলে। কবে যাবে তা কেউ জানে না।বিশ্ব জুড়ে মন্দার করাল গ্রাস ।কতদিন থাকবে সেটা কঠিন এক প্রশ্ন।রপ্তানী ধ্বস ইতোমধ্যে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সামনে এই ঋণাত্মক সংখ্যার ডিজিট বাড়বে।মোট রেমিটেন্সের ৬৫ ভাগই এই শিল্প থেকে আসে। রপ্তানির ধ্বস অনেকটা ঠেকাতে বাংলাদেশকে বেশ কিছুতে গভীর মনোযোগী হয়ে কাজ করতে হবে।
ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিহত করতে মানুষে মানুষে মেলামেশা বন্ধ করা ও ভিড় থেকে দুরে থাকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় শুধুমাত্র এই কারনেই সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে যে লকডাউন চলছে তাতে যেন রীতিমত স্তব্ধ হয়ে গেছে পৃথিবী।
বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর সেলাই মেশিনও তার সাথে সাথে বন্ধ হয়ে রয়েছে। কেননা এই দুর্যোগের দিনে পোশাক নয় শুধু জরুরী দৈনন্দিন সামগ্রী ক্রয়ের জন্যই এখন মানুষ অর্থ খরচ করছে। একইসাথে সংক্রমণ এড়াতে বন্ধ রয়েছে নানা পোশাক ব্রান্ডের দোকান। বাতিল হয়েছে হাজার কোটি টাকার রপ্তানি আদেশ। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এর আগে যে বড় সঙ্কটটি মোকাবেলা করেছিল সেটি ছিল ২০১৩ সালে আজকের এই দিনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দুর্ঘটনা রানা প্লাজা ধস পরবর্তী সময়।
কিন্তু সে সময় যে সঙ্কটের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে যেতে হয়েছে সেটি ছিল শুধু বাংলাদেশের একার। কিন্তু এখন যারা বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের মুল ক্রেতা তারাও রয়েছেন চরম বিপদে, যা এই শিল্পের জন্য আরো ভয়াবহ দুর্দিনের পূর্বাভাস দিচ্ছে। বাংলাদেশ রানা প্লাজার সংকট কাটিয়েছে কিন্তু এবার সংকট মোকাবেলা কতটা সম্ভব হবে?
করোনা উদ্ভাবনী সামগ্রীর অনুসন্ধানঃ উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের মানুষ আছে মন্দাবস্থায়। আমাদের রপ্তানির সিংহভাগ ক্রেতা তারাই। তারা এখন কমদামী প্যান্ট টি শার্ট এবং নিরাপত্তা সামগ্রী যেমন পিপিই পোষাক, মাস্ক এগুলি আমদানি করছে বা করবে আগামিতে বেশি বেশি। কাজেই এই শিল্প মালিকদেরকে এই ধরনের অর্ডারগুলির ক্রয়াদেশ এর সুবিধা নিতে বায়ারদের সাথে আন্তরিক কার্যকর যোগাযোগ করে রপ্তানির প্রবাহ যতদুর পারা যায় ঠিক রাখতে হবে। এই অপ্রচলিত পন্য ই এখন হয়ে যাচ্ছে দুনিয়াব্যাপি প্রচলিত পন্য নিদারুন সংকটে । এই জায়গাটিকে আমাদের শক্তির জায়গা হিসাবে মাইন্ড সেটে সাফল্য আসবে যে সেটা বেক্সিমকো ৬৫ লক্ষ পিস পিপি রফতানি করে দেখিয়েছে।
ক্রেতাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ ও ক্রয় আদেশ পুনর্বহাল করা পোশাক কারখানা মালিকদের সমিতি বিজিএমইএ’র নেতারা মনে করেন, “বাংলাদেশের প্রধান বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ক্রেতারা কেমন আচরণ করে সেটি আগে দেখতে হবে। সাধারণত এরকম দুর্যোগ ও তার পরবর্তী সময়ে মানুষ দরকারি জিনিস কেনে। ফ্যাশন সামগ্রী কেনে না। “বিজিএমইএ বলছে, বছরের গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন মৌসুম চলাকালীন মাঝপথে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্রয় আদেশ বাতিল করেছেন ক্রেতারা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-এর ডিস্টিংগুইশড ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলছেন, “এখনই যে চেষ্টাটা শুরু করতে হবে সেটি হল যার যার ক্রেতার সাথে সুসম্পর্ক ধরে রাখা। নতুন অর্ডারের জন্যেও চেষ্টা এখনি শুরু করতে দরকার।” অন্যদিকে ব্র্যান্ডগুলোর সাথে দ্রুতই মার্কেটিং কর্মকাণ্ড শুরু জরুরী, বলছিলেন মি. জামিল, “তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং জানিয়ে রাখা যে বাংলাদেশ উৎপাদনে প্রস্তুত।”একটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাস ইতিমধ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দার সময় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়।
মুস্তাফিজুর রহমান বলছেন, “মাথায় রাখতে হবে যে এসময় ডিজাইনার ব্র্যান্ড বা দামি পোশাক নয় বরং কম দামি পোশাকই হয়ত মানুষ কিনবে। “বাংলাদেশের শক্তির দিকই হল লো-এন্ডের পোশাক। সেটির দিকে অগ্রসর হলে হয়ত বিক্রিতে সমস্যা কম হবে। যেমন টি-শার্ট, সাধারণ শার্ট ইত্যাদি।”
দেনা পরিশোধ, দেউলিয়া হওয়া ঠেকানো পোশাক শিল্পে সাধারণত কাঁচামাল আমদানি হয় বাকিতে। একটা সাইকেলের মতো। আমরা ১২০ দিনের বাকিতে কাঁচামাল আমদানি করি। আর ক্রেতারাও কিছুদিন হল রপ্তানির পর টাকা দিতে ৯০ থেকে ১২০ দিন লাগিয়ে দেয়। সেই টাকা পেলেই তবে কাঁচামালের বাকি পরিশোধ হয়।যেহেতু একটি উৎপাদন মৌসুমের মাঝখানে সব বন্ধ হয়ে গেছে, এই চক্করে পরে কাঁচামালের অনেক দেনা হয়ে গেছে।”বাংলাদেশ মূলত চীন, ভারত ও পাকিস্তান থেকে কাঁচামাল আমদানি করে। এই মুহূর্তে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার দেনায় আছেন বাংলাদেশের পোশাক শিল্প। মৌসুমের মাঝামাঝি থাকার কারণে কাঁচামাল মজুদ রয়েছে প্রচুর কিন্তু উৎপাদন বন্ধ থাকায় সেগুলো জমে আছে। করোনাভাইরাসের কারণে যারা বাংলাদেশ থেকে এর আগে পোশাক নিয়েছেন, যাদের কাছে টাকা পায় দেশের মালিকেরা, তাদের অনেকেই দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাতে তাদের কাছে পাওনাটা পাওয়া যাবে কিনা সেরকম প্রশ্নও তৈরি হয়েছে।
সিপিডির ডঃ মুস্তুাফিজুর রহমান মনে করেন , “বাংলাদেশেও যাতে উদ্যোক্তারা দেউলিয়া না হয়ে যান সেটি নিশ্চিত করতে ” কারখানাগুলোর অর্থের সরবরাহ সচল রাখতে হবে। সরকারি সহায়তার পাশাপাশি ক্রেতাদের কাছেও সহায়তা চাইতে হবে। তা না হলে অনেক মালিককে কারাখানা বন্ধ করে দিতে হবে।
বাংলাদেশের সরকার ইতোমধ্যেই ৫ ,০০০ কোটি টাকার অর্থ ঋণ আকারে দিয়েছে শ্রমিকের বেতন ভাতার জন্য। “বিজিএমইএ সূত্র মতে, শ্রমিকদের বেতন একটি কারখানার খরচের বড়জোর ১৫ শতাংশ। সঙ্কট মোকাবেলায় সহায়তার জন্য বিজিএমইএকে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন বিদেশি দাতা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করা ও সেটা অব্যহত রাখতে হবে।আর এপ্রিল মে মাস হচ্ছে দাতাদের শীতকালীন পোষাক বানানোর সিজন বা উৎপাদন মৌসুম। এই মৌসুম কে নস্ট না করে কাজে লাগাতে ক্রেতাদের সাথে দেন দরবার ও খায় খাতির বাড়াতে হবে।
লেখকঃ রাজনৈতিক ও অর্থনীতির গবেষক।