রহিমা আক্তার মৌ :: দশ বছরের লেখালেখির জীবন। প্রায় আনমনেই নিজে হারিয়ে যাই এই ভেবে যে লেখাপড়ায় ফাঁকিবাজ মায়ের মনাটা লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সময় খুব বেশি না হলেও লড়াইটা করেছি অনেক। এ লড়াই অন্য রকম এক লড়াই, একই ছাদের নিচে থেকে লড়াই। সব লড়াইকে হাসি মুখে মেনে নিতে না পারলেও ভুলে গেছি সফলতা পেয়ে। তবে সহযোগিতা পেয়েছি অনেকের। ঘরে বাইরে পথে পথে। লেখালেখির পেছনে সবচেয়ে আসল সহযোগিতা করেছে আমার দুই সন্তান। ওরা পাশে না থাকলে নিজের নামের পাশে কখনও সাহিত্যিক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক শব্দগুলো বসাতে পারতাম না। আমায় সহযোগিতা করার মানুষদের তালিকা অনেক বড়। এই তালিকা দেখে অনেকে হাসতেও পারে, তাতে আমি কিছু মনে করিনা।

একটা লেখা লিখে পত্রিকার অফিস পাঠানো লেখা প্রকাশের পর তা সংগ্রহ করা এখানেও অনেক পথ পাড়ি দিতে হয় আমায়। বাসার ঠিকানা কোথাও ব্যবহার করতে পারিনা বলে সুন্দরবন কুরিয়ারের একটা ঠিকানা ব্যবহার করি। বই ম্যাগাজিন বা কোন প্রয়োজনীয় কিছু সেই ঠিকানায় আসে। পত্রিকা বা লেখালেখির জন্যে যে মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করি তা আমি সব সময় রিসিভ করতে পারিনা বলে কুরিয়ারে বলা আছে, “আপনারা কল দিয়েন আমি না ধরতে পারলেও বুঝে নিব আমার প্যাকেট এসেছে। না ধরলে কষ্ট করে বারবার কল দিতে হবে না।” উনারাও ঠিক তাই করে। ১৫ অক্টোবর সকালে পরপর তিনটা কল আসে সুন্দরবন কুরিয়ার থেকে। ধরতে পারিনি, পরপরই আমি কল দিই। বলেন,” জরুরী ডকুমেন্ট এসেছে, আজই নিয়ে যাবেন। এই জন্যেই তিনবার কল দিয়েছি, নইলে তো ৩/৪ দিন পর আসবেন”।

কথাগুলো শুনে কিছু সময় চুপ করে থাকি, এই শহরে এতটুকু কে করে কার জন্যে। মিনিট ত্রিশের মাঝে যাই। একটা খাম দেয় আমায়, সেখানেই খুলে পড়তে থাকি। পড়ে তো আমি অবাক। পড়ে জানতে পারি, সাজ প্রকাশন পুস্তক প্রকাশনার পাশাপাশি দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও সংগীত জগতকে সমৃদ্ধ করার লক্ষে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও আধুনিক কবিতার অগ্রপথিক ও রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ৬৫ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা,  ছড়া, কবিতাপাঠ ও ‘কবি জীবনানন্দ দাশ স্মৃতিপদক ২০১৯’ প্রদানের আয়োজন করেছেন।

২২ অক্টোবর মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি কনফারেন্স লাউঞ্জে সাজ প্রকাশনের প্রকাশক শেখ সাইদুর রহমান সাইদ এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হবে। এবছর দেশের ২২ জন গুণী ব্যাক্তিকে ‘কবি জীবনানন্দ দাশ স্মৃতিপদক ২০১৯’ প্রদান করা হবে। কথা সাহিত্যে সন্মাননা দিচ্ছেন আমাকে। পড়া অবস্থায় আমার চেহারা দেখে উনারা বুঝেন নিশ্চই ভালো কোন খবর আছে। জিজ্ঞেস করলেন, উনাদের খবরটা দিলাম, খুব খুশি হলেন।

অতঃপর ২২ অক্টোবর অনুষ্ঠানে উপস্থিত হই। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় রেলপথ মন্ত্রী এ্যাডভোকেট মো. নুরুল ইসলাম সুজন এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আশালতা বৈদ্য, ক্রীড়া সংগঠক রেহানা পারভীন, রাজশাহী জেলা আওয়ামী যুব লীগের সাধারণ সম্পাদক মো ওবায়দুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডার মোহাম্মদ আলী কামাল ও অতীশ দীপঙ্কর গবেষণা পরিষদের চেয়ারম্যান কবি গোলাম কাদের। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কবি আরিফ নজরুল।

এ বছর যে সব ব্যক্তিকে “কবি জীবনানন্দ দাশ স্মৃতিপদক ২০১৯” প্রদান করা হয় তারা হলেন – মুক্তিযুদ্ধে মোহাম্মদ আলী কামাল, কথা সাহিত্যে রহিমা আক্তার মৌ, কবিতায় কবি মুস্তফা হাবীব, সাহিত্যে ডা. এস এম এমরান আলী। ক্রীড়া ও প্রশিক্ষণে রেহানা পারভীন, অভিনয়ে নায়িকা মিষ্ট মারিয়া, ব্যাংকিংয়ে মো. মোখলেসুর রহমান, আইন ও মানবাধিকারে এডভোকেট এনামুল হক, মাদক বিরোধী আন্দোলনে আশরাফ আলম কাজল, সংগীতে সাউথিয়া জামান মীম, সমাজসেবায় মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমান, আকুপ্রেসার ও দক্ষ প্রশিক্ষক হিসেবে রওশন আলী, পুলিশ প্রশাসনে মো. মিজানুর রহমান পিপিএম, সংগঠক ও সমাজসেবায় মো. আজাদুল কবির আরজ প্রমূখ।

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক জীবনানন্দ দাশ। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমানে বাংলাদেশ) অন্তর্গত বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

তার পূর্বপুরুষরা বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার নিবাসী ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তবে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্বে তিনি ২১টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন যার একটিও তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি।

মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবিতে পরিণত হয়েছেন। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা-পুরাণের জগৎ জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়। তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ অভিধায় খ্যাত হয়েছেন।

জীবনানন্দের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত (১৯৫৩) হয়। ১৯৫৫ সালে শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটি ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করে। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মাঝে রয়েছে রূপসী বাংলা, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, বেলা অবেলা কালবেলা, শ্রেষ্ঠ কবিতা ইত্যাদি।

 আজ সেই কবিকে নিয়ে প্রবর্তিত ‘কবি জীবনানন্দ দাশ স্মৃতিপদক ২০১৯’ প্রাপ্তিতে নিজের মধ্যে অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করছে। যা হয়তোবা লিখে বা বলে প্রকাশ করতে পারবো না। শুধু ধন্যবাদ দিয়ে নয়, সাহিত্য জগতে আমাকে অসামান্য মূল্যায়ন করে, আমার কাজের প্রতি দায়িত্ববোধ বাড়িয়ে দিয়েছে সাজ প্রকাশন।

এখনও পথ চলতে হবে অনেক, যেতে চাই অনেক দূর।

লেখক: সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল: rbabygolpo710@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here