দীর্ঘ প্রত্যাশিত স্বপ্নের এই চার লেন সড়কটি এশিয়ান হাইওয়ে সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) এবং বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক করিডোরে (বিসিআইএম) নতুন করে বাংলাদেশের ৮ টি মহাসড়ক যুক্ত হবে।
এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর চার লেন প্রকল্পের খরচের মধ্যে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) দিচ্ছে ১১ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা আর সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ৫ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা ও রংপুর জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। রংপুর-সৈয়দপুর-বাংলাবান্ধা ৪ লেন হয়ে গেলে ওই মহাসড়কের মাধ্যমে বন্ধু প্রতীম প্রতিবেশী দেশ ভারতে ঢোকা যাবে। ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য প্রসারের ক্ষেত্রেও করিডোরটি বেশ রাখবে অবদান। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সড়কটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে অনুসন্ধানে জানাগেছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের সূত্র দাবি করে বলছে, কার্যাদেশ প্রাপ্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মোমেন গ্রুপের কর্ণধার আবদুল মোনেম ২০২০ সালের ৩ মে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ ঠিক গতিতে চলছিল। পরে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেন মোনেমের দুই ছেলে এ এস এম মাঈনুদ্দিন মোনেম ও এ এস এম মহিউদ্দিন মোনেম। অভিযোগ আছে, তাঁরা চলমান কাজের যথাযথ দেখভাল না করার কারনে গেল দুই মাস আগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেডকে নোটিশ টু কারেক্ট অর্থাৎ সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। এই চিঠির জবাবে তারা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে, সঠিক সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করা হবে।
সড়ক বিভাগের সূত্র আরও বলছে, ১৯০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে আবদুল মোনেম লিমিটেড, মনিকো লিমিটেড, কনকর্ড প্রগতি কনসোর্টিয়াম লিমিটেড ও চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড কাজ করছেন । এর মধ্যে মোনেম লিমিটেড ছাড়া অন্যদের কাজের গতি ভালো। তবে জটিলতা দেখা দিয়েছে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ী এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণে। সেখানে স্থানীয় প্রশাসন এখনও জমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারনে কার্যাদেশ প্রাপ্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এখনও কাজেই শুরু করতে পারেননি।
এ ব্যাপারে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক অলিউর রহমান এক প্রশ্নের জবাবে জানান, কিছু সমস্যা বিদ্যমান ছিল। তবে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করা হয়েছে।খুব শিগগিরই সড়ক বিভাগের কাছে অধিগ্রহণ না হওয়া জমিগুলো দিতে পারব।
কাজের ধীরগতি প্রসঙ্গে আবদুল মোনেম লিমিটেডের পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশল বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘চুক্তির সময়ের মধ্যেই আমরা সব কাজ শেষ করে ফেলব। এর আগে করোনার কারণে চলমান কাজে কিছুটা ভাটা পড়েছিল। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। এর পরও আমরা চেষ্টা করছি ঠিকমতো কাজ চালাতে। তিনি দাবি করেন, মহাসড়কের তিনটি বড় স্পটে কাজ বন্ধ করা হয়নি, তবে করোনা কালীন কাজের গতি কম হয়েছে।
এই সড়ক ছাড়াও হাটিকুমরুল থেকে বগুড়ার বনানী পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কাজ করছে আবদুল মোনেম লিমিটেড। দেখা গেছে, শেরপুর উপজেলার দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা ঘোগাব্রিজ, ছোনকা বাজার ও মির্জাপুর বাজার এলাকায় ওভারপাস ও আন্ডারপাসের কাজ এক বছর ধরে বন্ধ। কাজ অর্ধেক হয়ে পড়ে থাকায় ওই এলাকার মানুষের চলাচলে ভোগান্তি বেড়েছে বহু গুণ। একইভাবে সড়কের মির্জাপুর বাজার থেকে ছোনকা বাজার, ছোনকা থেকে চান্দাইকোনা বাজার, সিরাজগঞ্জের ঘুড়কা বেলতলা বাজার, সাহেবগঞ্জ বাজার, সলঙ্গা বাজার ও কামারবাড়ী সেতু এলাকার কাজ চলছে একেবারেই ধীরগতিতে।
রাস্তায় বৈদ্যুতিক খুঁটি থাকার কারণেও কাজ চলছে ধীরগতিতে। আর এই খুঁটি সরাতে কয়েক বছর ধরে চালাচালি হয়েছে অসংখ্য চিঠি। তবুও হয়নি সমাধান। এ কারণে খুঁটিতেই আটকে আছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ। খুঁটি সরানোর বিষয়ে নেসকো রাজশাহীর প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী পরিচালক (কারিগরি ও অপারেশন) প্রকৌশলী আবদুল আজিজ বলেন, খুঁটিগুলো তুলে নতুন কোথায় বসাব, তারও কোনো নির্দেশনা সড়ক কর্তৃপক্ষ দেয়নি। তার পরও আমরা আমাদের কাজ শুরু করেছি।
হাটিকুমরুল ইন্টারসেকশনের কাজ শুরুই হয়নি কেন? এর উত্তরে জানা গেল পনিবহনগুলো কোনো বাধা না পেয়ে সোজা চলে যেতে পারবে মহাসড়ক ধরে। ফরিদপুরের ভাঙ্গার মতো হাটিকুমরুল মোড়েও হবে একটি ইন্টারসেকশন। এই ইন্টারসেকশনের কাজ এখনও শুরুই করা যায়নি।
এদিকে, মহাসড়কে নির্মাণে ঝামা ইটের খোয়ার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সরকারের প্রকল্প তদারকি প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ আইএমইডি। আইএমইডি বলেছে, সড়ক নির্মাণে কোনো কোনো স্থানে ঝামা ইটের অর্থাৎ পুড়ে যাওয়া কালো হওয়া খোয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে এই মহাসড়ক টেকসই হবে না বলে সন্দিহান তারাও। আইএমইডি ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে ওই প্রতিবেদন দিয়েছিল। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়- ডিপিপি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা লক্ষ্য অনুযায়ী কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় সরকারের অনেক সময় ও অর্থের অপচয় হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে হলে ঠিকাদারকে জনবল ও নির্মাণসামগ্রীর মোবিলাইজেশন বাড়াতে হবে।
সার্বিক এসব বিষয় নিয়ে, আইএমইডির প্রতিবেদন প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক ওয়ালিউর রহমান এক প্রশ্নের জবাবে জানান, ‘আমরা আইএমইডিকে প্রতিবেদনের জবাব দিয়েছি। আইএমইডি কর্মকর্তারা প্রকল্প এলাকায় গিয়ে কিছু পোড়া ইট দেখেছেন। তবে ওই ইট আমরা সড়কে ব্যবহার করিনি।
তিনি আরও জানান, আমরা ধীরগতি কাজের জন্য আবদুল মোনেম লিমিটেডকে দুই মাস আগে চিঠি দিয়েছি। এর পরও তাদের কাজের গতি আশাব্যঞ্জক নয়। করোনা ও বৃষ্টির কারণে প্রকল্পের কাজের গতি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সময় বাড়ানো হয়েছে।
প্রকল্পের অতিরিক্ত পরিচালক হামিদুল হক জানান, সরকারের পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনের আগে এই মেগা প্রকল্পের কাজের বেশির ভাগ অংশ শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে। আবদুল মোনেম লিমিটেডের কাজের অগ্রগতি নিয়ে আমরা বেশ চিন্তিত। তাদের তাগাদা দিয়েও লাভ হচ্ছে না। তাই সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। এবং বর্তমান সরকারের সফল প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বারং বার খোজ খবর নিচ্ছেন। তাগিদ দিচ্ছিন দ্রুত মেগা এই প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন করার।