সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আগামী ১৮ মার্চ সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সাংবাদিকদের মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। এর আগে ১৫ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশের সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেস ক্লাবগুলোতে সাংবাদিকদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সমাবেশ করা হবে। সেখানে ঢাকা থেকে সাংবাদিক নেতারা উপস্থিত থাকবেন।
সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের অনশন চলাকালে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার মাধ্যমে অনশন ভঙ্গ করেন সাংবাদিকরা। পূর্ব ঘোষণা হিসেবে সকাল থেকেই জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ সারা দেশে সাংবাদিকরা অনশন শুরু করেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনশনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও রুহুল আমিন গাজী, মহাসচিব আবদুল জলিল ভূঁইয়া ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এম আবদুল্লাহ, ডিইউজে’র সভাপতি আবদুস শহীদ ও ওমর ফারুক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মো. বাকের হোসাইন ও শাবান মাহমুদ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপুসহ অন্যান্য সাবেক ও বর্তমান সাংবাদিক নেতা এবং সংবাদকর্মীরা।
ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, “আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করব। ঐক্যের কোনো বিকল্প আমাদের সামনে নেই। আজ সবার মধ্যে যখন ঐক্যের চেতনা সৃষ্টি হয়েছে তখন এটি কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। যারা এই ঐক্য ভাঙার চেষ্টা করবেন তারা চিহ্নিত হবেন।”
তিনি বলেন, “সাংবাদিকদের বিভক্তের কারণে লাভবান হচ্ছেন সংবাদমাধ্যমের মালিক ও ক্ষমতাসীনরা। আমরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শপথ নিয়েছি, এটি হলো আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।”
সাংবাদিকদের ন্যায্য অধিকার ছাড়া আর কোনো চাওয়া মালিক কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে নেই বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, “গত ২০ বছরে অনৈক্যের কারণে যা হারানো হয়েছে, তা সাগর-রুনির মৃত্যুর পর এই ঐক্যের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করা হবে।”
এই সাংবাদিক নেতা বলেন, “আদালতের স্বাধীনতার জন্য আমরা শুধু রাস্তায় নয়, লেখনির মাধ্যমেও আন্দোলন করেছি। সেই বিচার বিভাগ যখন আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে তখন আমরা চুপ থাকতে পারি না। তাতে যদি আদালত অবমাননার প্রশ্নও আসে, আমরা সেটি বরণ করে নিতে চাই।”
প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে তিনি বলেন, “দু’একজন বিচারপতির অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত রুলের কারণে যেন আদালত এবং সংবাদমাধ্যম মুখোমুখি হতে না হয়, সেজন্য আপনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।”
তিনি বলেন, “আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাই। আমরা কোনো রক্তচক্ষুর কাছে অতীতেও মাথানত করিনি। সাগর-রুনির রক্তের ওপর দাড়িয়ে ঘোষণা করতে চাই, কোনো রক্তচক্ষুর কারণে আমরা আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সুযোগ দিব না। আমাদের স্বধীনতায় যারা অতীতে হাত দিয়েছে তাদের হাত পুড়ে গেছে।”
ইকবাল সোবহান বলেন, “একদিকে তথ্য অধিকার আইন পাশ করা হয়েছে। অন্যদিকে পরিবেশনের নিয়ম জানানো হচ্ছে আমাদের। এটি হতে দেব না।”
কয়েকটি বিভ্রান্তিমূলক তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে কেউ কেউ অপসাংবাদিকতার পরিচয় দিচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সেটি বন্ধ করব।”
প্রধানমন্ত্রীর প্রথম দিনের নির্দেশ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৪৮ ঘন্টার সময় বেধে দেয়ায় সাংবাদিক সমাজ আশ্বস্ত হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পরে আইনশৃঙ্খলা বাহীনির বক্তব্যে আমরা সেই আশা হারিয়েছি।”
সাগর-রুনি হত্যা নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনারা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেন একে অন্যের প্রতি আঘাতমূলক কোনো বক্তব্য না দেন, সেই অনুরোধ করছি।”
সরকার যখন ব্যর্থ হলে সাংবাদিক সমাজ তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রকৃত খুনিদের মুখোশ প্রকাশ করবে বলেও জানান তিনি। সঙ্গে সঙ্গে তাদের পেছনে যারা মদদ দিচ্ছে তাদের মুখোশও প্রকাশ করা হবে বলে উল্লেখ করেন।
রুহুল আমিন গাজি বলেন, “অতীতে যারা সাংবাদিকতার স্বাধীনতা বন্ধে হাত বাড়িয়েছে তাদের হাত পুড়ে গেছে। সুতরাং এখনো যারা সেই অপচেষ্টা করবেন সেটি সফল হবে না।”
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি প্রকৃত খুনিদের চেহারা প্রকাশের আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, “রিহার্সেলের মাধ্যমে যদি কোনো জজমিয়া নাটক তৈরির চেষ্টা করা হয় তাহলে সাংবাদিকরা তাদের পেশাদারিত্বের কারণে সেটির প্রকৃত রহস্য তুলে ধরবে। সুতরাং সেসব কাহিনী তৈরি করে পার পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই।”
আমাদের ঐক্য ভাঙার ক্ষমতা কারো নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যারা আজ ঐক্যের আওয়াজ দিচ্ছেন সেটি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেই দিচ্ছেন।”
তিনি বলেন, “স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ আমরা চাইবো কেন। উনি নিজে থেকেই পদত্যাগ করা উচিত ছিল। আইজিপি আপনি কেন এখনো আছেন?”
কোনো সাংবাদিক নেতার বক্তব্যের কারণে যেনো সাংবাদিকদের মাঝে অনৈক্যের প্রকাশ না পায় সেজন্য তিনি সবার প্রতি আহবান জানান। আজ এখানে সবাই এসেছেন। কোনো অনৈক্যের সুযোগ নেই।
সংবাদকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আল্লাহর ওয়াস্তে আজকের পর থেকে সাংবাদিক নেতাদের ‘একাংশের নেতা’ বলবেন না।”
আবদুল জলিল ভূঁঞা বলেন, “একের পর এক সাংবদিক হত্যাকাণ্ড চলছে। কোনোটিরও বিচার হচ্ছে না।”
আবদুস শহীদ বলেন, “আজ যখন সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে তখন আমরা আন্দোলনে নেমেছি। আমরা বিশ্বাস করি আমাদের পুলিশ কর্মকর্তারা অবশ্যই খুনিদের সনাক্ত করার যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু ওনারা করছেন না।” সাংবাদিকদের অধিকারের সংগ্রামে সবার প্রতি ঐক্যবদ্ধের আহবান জানান তিনি।
তিনি বলেন, “সংবাদপত্র নয়, বরং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, আইজিপিসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের বক্তব্যের কারণেই এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।”
ওমর ফারুক বলেন, “এসব ব্যর্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের রাখার দরকার কি? তাদের বাদ দিয়ে নতুন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়া হোক।”
কামাল উদ্দিন সবুজ বলেন, “সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডকে কেউ যেন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে না পারে সেজন্য আমরা দৃষ্টি রাখবো। দেরিতে হলেও সাংবাদিকদের এই ঐক্য আমাদের সবার জন্য আশার আলো। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য সাংবাদিকরা লড়েছে, লড়ছে এবং লড়বে। সত্যিকারের আইনের শাসনের জন্য আমরা একসঙ্গে আন্দোলন করে যাবো।”
আদালতের বিষয়ে তিনি বলেন, “আদালত ও গণমাধ্যম একটি রাষ্ট্রের অঙ্গ। কোনোটি কোনোটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। যে যার মতো কাজ করবে। কোনোভাবে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলে সেটি মেনে নেয়া যাবে না।”
একই প্রসঙ্গে সাখাওয়াত হোসেন বাদশা বলেন, “সংবিধান রক্ষার দায়িত্ব আপনার (বিচারপতির)। আমার অধিকারের বিরুদ্ধে আদালত কথা বললে সেটি হবে সংবিধান বিরোধী। আমার অনুরোধ এমন কিছু বলবেন না, যেন সাংবাদিক সমাজসহ সারা দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়।”
বাকের হোসাইন বলেন, “বিচারপতিরা চোখ বন্ধ করে একটু চিন্তা করা দরকার যে, তাদের একটি রায় ইতিহাস হয়ে থাকবে।” সাংবাদিক দম্পতি হত্যার বিষয়টি গভীরভাবে দেখতে তিনি বিচারপতিদের প্রতি আহবান জানান।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শাবান মাহমুদ আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে সাগর-রুনি হত্যায় প্রকৃত দোষিদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে বলেন, “স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে প্রধানমন্ত্রীর ওপর দায়িত্ব চাপিয়েছেন। আপনি অবিলম্বে পদত্যাগ করুন।”
তিনি বলেন, “আজ আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো তামাশা দেখা কিংবা সরকারের কাছে কোনো করুণা চাইতে আসি নি। সাগর রুনির হত্যার কারণ জানতে এসেছি। নাগরিক অধিকার নিয়ে বিচার চাইছি।”
সৈয়দ আবদাল হোসেন বলেন, “প্রশাসনের প্রতি ধিক্কার দিচ্ছি। হাইকোর্টের রুল সাংবাদিকতা পেশার স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের আলামত। কারো নির্দেশনায় গণমাধ্যম চলবে না। আমাদের নীতিমালা আছে। আমাদের পূর্বসুরিরা যেভাবে নিয়ম তৈরি করে গেছেন সেভাবে আমরা কাজ কররো।”
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, “সাগর রুনির পর আরো খুন হলো। রিপোর্টের মাধ্যমে তাদের চরিত্রকে আবার খুন করা হয়েছে। আরেক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো সংবাদপত্রের কন্ঠ রোধ করার চেষ্টার মাধ্যমে। বড় হত্যাকাণ্ড হলো সত্যকে হত্যা করার চেষ্টা। সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ আর সত্যকে হত্যা করা একই। শুধু সাংবাদিকরা নয়, সাধারণ মানুষও সাগর-রুনি হত্যার সুষ্ঠু বিচার চায়। আমরা দেখছি, খুনিদেরকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে সংবাদপত্রকেই আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে।”
এর আগে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেফতারসহ সব সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা তদন্ত করে দুষ্কৃতকারীদের শাস্তির দাবিতে ২২ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকরা সমাবেশ করে। জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি এবং সাংবাদিকদের দুটি ইউনিয়নের চার অংশের নেতারা যৌথভাবে এ কর্মসূচি পালন করেন।
এ ছাড়া ২৭ ফেব্রুয়ারি সব সংবাদপত্র ও সম্প্রচার মাধ্যমে দুপুর ১২টা থেকে একটা পর্যন্ত প্রতীকী ধর্মঘট ও কালো ব্যাচ ধারণ করা হয়।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাতের কোনো একসময় রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে ভাড়া বাসায় খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। পরদিন সকালে পুলিশ তাদের লাশ উদ্ধার করে।