হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বরাবরই সব ধরনের মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরোধী, কেননা এই শাস্তিটি অমানবিক এবং কাউকে মেরে ফেললে তার বিচারিক কোন ত্রুটিও আর সংশোধনের সুযোগ থাকেনা।
বাংলা প্রেস, নিউ ইয়র্ক থেকে: এবার যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা মুহাম্মাদ কামারুজ্জামানকে দেয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ অবিলম্বে স্থগিত করার আহ্বান জানালেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
ফাঁসির দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার পূর্ণ আইনি অধিকার দিতে সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়। এর আগে ইইউ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে বিবৃতি দিয়েছিল।
গত রোববার সংস্থাটির ওয়েব সাইটে দেয়া এক বিবৃতে এসব কথা বলা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই ঢাকা জেল কর্তৃপক্ষকে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করার ব্যবস্থা নিতে বলেছে, এই খবরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার পরপরই কামারুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়, যা তড়িঘড়ি করে ফাঁসি কার্যকর করার সরকারি ইচ্ছারই ইঙ্গিত বহন করে। কামারুজ্জামান এবং তার আইনজীবীদের সর্বাগ্রে আপিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি সরবরাহ করতে হবে যাতে তারা নিয়মানুযায়ী ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ পিটিশন জমা দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন।
সরকারি কর্মকর্তারা এরই মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে ফাঁসি কার্যকর করারও ইংগিত দিয়েছেন যা বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রচলিত নিয়মেরও বরখেলাফ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বরাবরই সব ধরনের মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরোধী, কেননা এই শাস্তিটি অমানবিক এবং কাউকে মেরে ফেললে তার বিচারিক কোন ত্রুটিও আর সংশোধনের সুযোগ থাকেনা।
এ বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড এডামস বলেন, এটা খুব বড় আকারের একটি সমস্যা। বিশেষ করে যেই বিচারিক প্রক্রিয়াটি ত্রুটিপূর্ণ এবং যেখানে এই মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ দেয়া হয় না সেখানে এই ধরনের রায় মোটেও মানা যায় না।
তাছাড়া এখন সরকারের পক্ষ থেকে এটাও বলা হচ্ছে যে, এই ধরনের অপরাধে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পাওয়ার অধিকারও খুব সীমিত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের আদেশের ভিত্তিতে ২০১০ সালের জুলাইতে কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। কামারুজ্জামানকে কি কারণে গ্রেফতার করা হচ্ছে প্রাথমিকভাবে তাও জানানো হয়নি।
স্বেচ্ছাচারী গ্রেফতার বিষয়ক জাতিসংঘের গ্রুপও (ইউএন ওয়ার্কিং গ্রুপ অন আরবিট্রারি ডিটেনশন) এই গ্রেফতারের নিন্দা করে এবং গ্রেফতারটিকে আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন হিসেবে অভিহিত করে।চরমভাবে ত্রুটিপূর্ণ একটি বিচার প্রক্রিয়ার শেষে কামারুজ্জামানকে শেরপুরের সোহাগপুর গ্রামে গণহত্যায় পরিকল্পনার অভিযোগে ২০১৩ সালের মে মাসে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
সবশেষে গত ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগও ট্রাইব্যুনালের এই রায় বহাল রাখে। গত ৭ দিনে বাংলাদেশে এই নিয়ে তিনটি মৃত্যুদ- দেয়ার ঘটনা ঘটলো। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বরাবরই বলে আসছে, কামারুজ্জামানসহ ট্রাইব্যুনালে চলমান সবগুলো বিচারিক প্রক্রিয়াই ত্রুটিপুর্ণ।
কামারুজ্জামানের মামলায় আসামিদের স্বাক্ষ্য ও প্রমাণাদি উপস্থাপনে যথাযথ সুযোগ না দিয়ে আসামির প্রাপ্য অধিকারকে সীমিত করা হয়েছে।
প্রসিকিউশন স্বাক্ষ্যদের অসংগতিকে বিচারকেরা অগ্রাহ্য করেছেন এবং সরকারি স্বাক্ষীদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আসামিপক্ষের চ্যালেঞ্জকেও প্রত্যাখান করা হয়েছে।
এইসব অন্যায় ও অসংগতি ট্রাইব্যুনালের প্রতিটি মামলায় বিদ্যমান।এর আগে গত ডিসেম্বর ২০১৩ তে আরেক জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে তড়িঘড়ি করে ফাঁসি দেয়া হয়েছে এবং তাকে ফাঁসি দেয়ার জন্য সরকার আইনও সংশোধন করেছে যা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লংঘন।
অপর আসামি দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীর পক্ষের স্বাক্ষীকে ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে অপহরণ করা হয়। আর এই ব্যপারে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা বারবার একটি নিরপেক্ষ তদন্ত করার আহ্বান জানালেও কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখান করে।
প্রতিটি মামলার সময়ই প্রসিকিউশন ও বিচারকদের নিয়মিত যোগাযোগের অভিযোগ উত্থাপিত হয় যা ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। অন্যদিকে এই সব অভিযোগকে বিচারকরা তো আমলে নেনই নাই বরং যারা অভিযোগ তুলেছে তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছে।হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশের মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারের পক্ষে তবে তা হতে হবে আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন।
ভিকটিম এবং আসামিপক্ষ উভয়ের অধিকার পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষণ করলেই কেবল ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে।পরিশেষে সব ধরনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ পরিহার করার জন্য বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানায় সংস্থাটি।