রুদ্র অয়ন :: ধর্ম নিয়ে যারা ভ্রান্ত ধারণা ছড়ায়, তাদের ফাঁদে পা দেয়াটা নেহায়েত বোকাদের কাজ। যারা বিভ্রান্তিমূলক এসব বানোয়াট তথ্যের ফাঁদে পা দেয় তারা কি একবারও জানার চেষ্টা করছে না যে, সত্য ছড়াচ্ছে নাকি মিথ্যা! তার ওপর এক শ্রেনীর স্বল্প শিক্ষিত মোল্লা তার অজ্ঞতাকে তথাকথিত শিক্ষিত হবার মোড়কে ঢেকে সাধারণ মানুষদের করছে আরো বিভ্রান্ত। তারই রেশ ধরে আমরা জানতে পারি এপ্রিল ফুলের মিথ্যে এবং বানোয়াট গল্প দিয়ে গড়া এক ইতিহাস।
এক শ্রেনীর মোল্লার মতে এপ্রিল ফুলের ঘটনা বড়ই কষ্টের। বড়ই করুণ। এই দিন রানী ইসাবেলা এবং রাজা ফার্ডিনান্ড এর সেনাবাহিনী মুসলিমদের মসজিদে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল। পর্যুদস্ত মুসলিম বাহিনীকে ক্রিশ্চিয়ানরা আত্মসমর্পনের সুযোগ দিয়ে বলেছিল মসজিদে আশ্রয় নাও। এভাবে তারা কৌশলে মুসলিমদের মসজিদে ঢুকিয়ে দরজায় তালা মেরে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। মুসলিমরা যখন পুড়ে মরছিল, ক্রিশ্চিয়ানরা তখন উল্লাস করছিল। মুসলিমদের বোকা বানানোর এই দিনটি ছিল এপ্রিলের এক তারিখ। সেই থেকে ক্রিশ্চিয়ানরা এই দিনটি উদযাপন করে আসে ‘এপ্রিল ফুল দিবস’ হিসেবে।
সম্মানিত পাঠক, ওপরের ইতিহাস আপনি হয়তো শুনেছেন। শুনেছেন বহুবার। কিন্তু কখনও কি ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছেন এর সত্যতা কতটুকু? আসুন আজ আমরা এক এর ইতিহাস ঘেঁটে দেখি। জোসেফ ও’ কালাহান এর লেখা এবং কর্নেল ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ A History of Medieval Spain থেকে আমরা দেখতে পাই ( বইটা অনলাইনে পড়া যাবে ) মুসলিমরা স্পেনে শাসন শুরু করে ৭১১ খৃষ্টাব্দ থেকে। আল ওয়ালিদ ইবন আবদ আল মালিক প্রথম উমাইয়া খেলাফতের পক্ষ থেকে স্পেনে শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং কিছু অংশ নিয়ে গঠিত এলাকাকে উমাইয়া খেলাফতের প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করে।
তবে তারা ৭৫০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে। এরপর ক্ষমতায় আসে করডোবার আমিরাত (৭৫০ থেকে ৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ), করডোবার খেলাফত (৯২৯ থেকে ১০৩১ খ্রিষ্টাব্দ) এবং আলমনজুর (৯৩৮ থেকে ১০০২ খ্রিষ্টাব্দ)। শেষের জন আসলে একজন শাসক যিনি মুসলিম শাসনকে স্পেনে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে ইতিহাসে এর পরে দুশো বছর একচ্ছত্র আধিপত্য দেখাতে পারেনি কোন সুনির্দিষ্ট মুসলিম শাসক। মুসলিমদের স্পেন শাসন আবার পাকাপোক্ত হয় মূলতঃ ১২৩৮ সনে যখন গ্রানাডার আমিরাত প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে মুসলিমরা স্পেনের গ্রানাডা ভিত্তিক একটা খুবই শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে পরিচিতি পায়।
স্পেনে যখন মুসলিমরা শাসন করছে তখন বিভিন্ন রাজারা যা করতে পারেননি, একজন নারী হয়ে রানী ইসাবেলা তা করে দেখিয়েছিলেন। সে মুসলিমদের বিতাড়িত করেছিল স্পেন থেকে। প্রশ্ন জাগতে পারে, কে এই ইসাবেলা? হ্যা, এই সেই ইসাবেলা যে কলম্বাসকে আমেরিকা আবিষ্কারে পাঠিয়েছিল। পরবর্তীতে তাঁর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সিদ্ধান্ত গুলো স্পেনের ইতিহাসকে নূতন রূপ দিয়েছিল। ইসাবেলা অনুভব করেছিল মুসলিমদের হারাতে হলে স্পেনের ছোট ছোট রাজ্যগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আই. এল. প্লাঙ্কেটের লেখা Isabel of Castile গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি ইসাবেলা রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে তার কজিন এ্যারাগনের রাজা ফার্ডিনান্ডকে বিয়ে করেছিল। এই বিয়েও খুব একটা সহজ ছিলনা কেননা সে সময় কাজিনকে বিয়ে করতে খোদ পোপের অনুমতি প্রয়োজন ছিল। শেষ পর্যন্ত ইসাবেলা সেটাও জোগাড় করেছিল এবং ১৯ অক্টোবর ১৪৬৯ সনে তারা বিয়ে করেন।
বিয়ের পর ইসাবেলা-ফার্ডিনান্ড এর প্রধান মিশন হয়ে দাঁড়ায় মুসলিমদের পরাজিত করা। ১৪৮২ সনের ১ ফেব্রুয়ারি রাজা-রানী ভ্যালাডোলিড প্রদেশের মেডিনা ডেল ক্যাম্পোতে এসে পৌঁছান গ্রানাডা আক্রমনের লক্ষ্য নিয়ে। জন এ্যাডওয়ার্ড তার লেখা পিয়ারসন এডুকেশন থেকে প্রকশিত গ্রন্থ Ferdinand and Isabella-তে এ দিনটিকে গ্রানাডা যুদ্ধের সূচনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ্যাডওয়ার্ডের ঐ ইতিহাস গ্রন্থ থেকেই জানা যায় যে এ সময় ইসাবেলা ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে তার সেনাবাহিনীতে সৈন্য নিতে শুরু করে এবং তাদের কামান বিভাগকে আরো সুগঠিত করে সাজাতে তৎপর হয়। গ্রানাডা আক্রমনের মূল সমস্যা ছিল প্রকৃতি। অঞ্চলটা এমন ভাবে দুর্গম প্রকৃতি দ্বারা বেষ্টিত ছিল যে সেখানে নূতন করে গিয়ে আক্রমন করতে হলে অসাধারণ সেনাবাহিনী প্রয়োজন। ইসাবেলা দারুণ ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে দশ বছর ধরে যুদ্ধ করে তবেই মুসলিমদের স্পেন ছাড়া করতে পেরেছিল।
এ্যাডওয়ার্ডের বর্ণনা মতে, ইসাবেলা একবারে গ্রানাডা দখল করার মত উচ্চাভিলাস দেখায়নি। বরং সে মুসলিম সাম্রাজ্যটাকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে একটু একটু করে দখল করে। ১৪৮৫ সনে রন্ডো এবং ১৪৮৬ সনে গ্রানাডার লজা দখল করে ইসাবেলার সেনাবাহিনী। লজা দখলের সময় গ্রানাডার শাসক দ্বাদশ মোহাম্মদকেও তারা বন্দি করে কিন্তু পরে ছেড়ে দেয়। ১৪৮৯ সনে দখল করে বাজা। এভাবে আস্তে আস্তে গ্রানাডার একেকটা অঞ্চল দখল করতে করতে শেষ পর্যন্ত ১৪৯১ সনে মূল গ্রানাডা আক্রমণ করে ঘেরাও করে ইসাবেলার সেনাবাহিনী। ফলে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে দ্বাদশ মোহাম্মদ আত্মসমর্পণ করে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত পেগি লিসের লেখা গ্রন্থ Isabel the Queen অথবা জন এ্যাডওয়ার্ডের লেখা পিয়ারসন এডুকেশন থেকে প্রকশিত গ্রন্থ Ferdinand and Isabella অথবা আই. এল. প্লাঙ্কেটের লেখা Isabel of Castile গ্রন্থ অথবা জোসেফ ও’ কালাহান এর লেখা কর্নেল ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ A History of Medieval Spain থেকে আমরা জানতে পারি ১৪৯২ সনের ২ জানুয়ারি ইসাবেলা এবং ফার্ডিনান্ড গ্রানাডায় প্রবেশ করে এবং দ্বাদশ মোহাম্মদের কাছ থেকে শান্তি পূর্ণ ভাবে নগরের চাবি গ্রহণ করে।
ইতিহাসের এই পর্যায়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রথমতঃ কোন রকম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঐ দিন ঘটেনি। এবং দ্বিতীয়তঃ দিনটি ১ এপ্রিল ছিল না বরং দিনটি ছিল ২ জানুয়ারি। অর্থাৎ যে দিনকে মোল্লারা মুসলিমদের পুড়িয়ে মারার দিন হিসেবে চিহ্নিত করে, তার তিন মাস আগেই গ্রানাডা বিজয় করে ক্রিশ্চিয়ানরা। এটা ঠিক, অত্যাচার তারা করেছিল। এ্যাডওয়ার্ডের বর্ণনা থেকে জানা যায় মুসলিমদের সবচেয়ে বড় মসজিদটাকে তারা চার্চ বানিয়েছিল এবং অন্য ধর্মের মানুষদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এ কাজ যুগে যুগে সব ধর্ম ভিত্তিক শাসকরাই করেছে। তুরষ্কের সবচেয়ে বড় যে মসজিদটা রয়েছে সেটা এক কালে চার্চ ছিল।
এখন দেখা যাক এপ্রিল ফুলের ইতিহাস কী ছিল। এ্যানসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা থেকে জানা যাচ্ছে যে এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি মূলতঃ রোমান উৎসব হিলারিয়া থেকে যা হতো ২৫ মার্চ। তবে দিনটি পরবর্তিতে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিভিন্ন ভাবে উৎসবের দিন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ হিসেবে ধরা হয় ১৩৯২ সনে প্রকাশিত চসারের কেন্টারবেরি টেলস। সেখানে মার্চের ৩১ তারিখ হিসেবে এপ্রিল ফুলের উল্লেখ রয়েছে। “মিউজিয়াম অব হোক্স ” এর ওয়েব সাইটে বিভিন্ন এপ্রিল ফুলের ঘটনা তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে। সেখানে দেখা যায় ইতিহাসে এপ্রিল ফুলের বড় দৃষ্টান্ত ১৬৯৮ সনে লন্ডনে ঘটে, যখন বহু মানুষকে বোকা বানিয়ে টাওয়ার অব লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। মূল কথা, এ দিনটি ইউরোপের বিভিন্ন জাতি বসন্তের শুরুর দিকের একটা উৎসব হিসেবে উদ্যাপন করে।
অতএব, ওপরের আলোচনা থেকে এতটুকু দেখা যাচ্ছে যে স্পেনের ক্রিশ্চিয়ান সম্প্রদায়ের গ্রানাডা বিজয় এবং এপ্রিল ফুলের মধ্যে সামান্যতম সম্পর্কও নেই। অথচ মুসলিমদের পুড়িয়ে মারার এই মিথ্যেটা যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টির লক্ষ্যে এক শ্রেনীর মৌলবাদী মোল্লা আমাদের সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ ধরনের মানুষের উদ্দেশ্য কখনোই ভালো হতে পারে না। এরা ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে। এদের কাছে ধর্ম একটা পণ্য। ক্ষমতা বিস্তারের পণ্য। এদের রোধ না করা হলে আমাদের সমাজে এরা ভাইরাসের মতো বিভ্রান্তি ছড়াতেই থাকবে। এদের বিনা রেফারেন্সে বলা কোনও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যকে সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বা ইমেইলে ছড়িয়ে দিয়ে আপনার ধর্মকে আপনিও পণ্য বানানো থেকে বিরত থাকুন।
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here