KALAPARAমিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া(পটুয়াখালী) প্রতিনিধি :: সেই শৈশবে মা,ভাই-বোনদের মুখে দু’মুঠো ভাতের যোগান দিতে গিয়ে দূর্ঘটনায় একটি হাত হারালেও এখনও এক হাতেই শিক্ষা ও সংসারের হাল ধরতে হয়েছে ফেরদাউসকে। প্রতিবন্ধী হওয়ার যন্ত্রনা ও কষ্ট বুকে চেপে রেখে অন্য প্রতিবন্ধীদের মুখে হাসি ফোঁটাতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে সেচ্ছাসেবীর কাজ করছেন। প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে শিক্ষার আলোতে আলোকিত হতে এক হাত দিয়েই অনার্স শেষ করে ভর্তি হয়েছেন মাষ্টার্সে।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের সোনাতলা গ্রামের জেলে শাজাহান খলিফা ও ফিরোজা বেগম দম্পত্তির প্রথম সন্তান মো. ফেরদাউসের শৈশবটাও ছিল গ্রামের অন্য ছেলেদের মতো হাসি-খুশিতে ভরা ও স্বাভাবিক। স্কুলে,খেলার মাঠে হাসি আনন্দে কাটতো তার সকাল-বিকাল। কিন্তু হঠাৎ দুর্যোগের কবলে পড়ে দূর্ঘটনার শিকার হয়ে কেটে ফেলতে হয়েছে তার বাম হাতটি। তখর তার বয়স মাত্র ৯।

ফেরদাউসের ভাষায়, আমি তখন পূর্ব সোনাতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস টুতে পড়ি। বাবা তখন সাগরে একাই মাছ ধরতো। অভাব তখন নিত্য সঙ্গী। ঘরে খাবার নেই। ছোট ভাই রিপন খলিফা ও বোন ফাহিমা আক্তার ক্ষুদ্ধার যন্ত্রনায় কাঁদছে। ২০০১ সালের বর্ষা মেীসুমে তাই বাধ্য হয়ে একদিন ভোরে বাবার সাথে মাছ ধরতে সাগরে যাই। সাগরে মাছ শিকার শেষে কূলে ফেরার পথে হঠাৎ ঝড় ও তুফান শুরু হয়। ভয়তে বাবা তখন আমাকে ট্রলারের ইঞ্জিন রুমে গিয়ে বসতে বলে। ঝড়ে সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে ট্রলারটি কাঁত হয়ে গেলে ইঞ্জিনের উপর পড়ে বাম হাতটি ইঞ্জিনের মধ্যে ঢুকে গিয়ে কেটে যায়।

বাবার সাথে প্রথম সাগরে গিয়ে দূর্ঘটনায় বাম হাত হারিয়ে ছোট্র ফেরদাউস মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়লেও মায়ের অনুপ্রেরণা ও ভালবাসায় প্রতিবন্ধকতা ভুলে মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাওয়া শুরু করে। পরিবারে দৈন্যতা থাকলেও তেগাছিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, নাওভাঙ্গা টেকনিক্যাল কলেজ থেকে এইচএসসি ও পটুয়াখালী সরকারী কলেজ থেকে ইসলামের স্ট্যাডিজে অনার্স শেষ করে এবছর মাষ্টার্সে ভর্তি হয়েছে।

ফেরদাউস জানায়, আমার হাতটি কেটে যাওয়ার পর অভাবের সংসারে হাল ধরতে ছোট ভাই রিপন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবার সঙ্গে সাগরে মাছ শিকারে নেমে পড়ে। এ কারনে ছোট ভাইয়ের আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। পরিবারে দৈন্যতা থাকায় ২০১৫ সালে প্রতিবন্ধীদের সহায়তা সংস্থা একশন ডিজাবিলিটি এন্ড ডেভলপমেন্টে চাকুরী নেয়। এ সংস্থা থেকে প্রাপ্ত টাকা থেকে নিজের পড়াশোনা ও পরিবারের কাজে খরচ করছেন।

সে জানায়, ছোটবেলা থেকে এক হাত না থাকলেও ভালো ফুটবল খেলতেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ফুটবল খেলে কিছু টাকা পেতেন। এ টাকাও পড়ালেখা ও সংসারে খরচে ব্যয় করতেন। বর্তমানে ফেদাউস কলেজের নিজ ডিপার্টমেন্টের টিম লিডার ছাড়াও পাখিমারা খেলোয়ার কল্যান সমিতির সদস্য।
ফেরদাউস বলেন, বাবা-মা বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েছে। বাবা এখন কয়েক লাখ টাকা দেনা হয়েছে। সাগরে এখন মাছ শিকার বন্ধ। পরিবারে অভাব যেখানে সবসময় দড়জায় কড়া নাড়ে তখন সকল নিষেধাজ্ঞার শিকল ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু উচ্চ শিক্ষা গ্রহনই এখন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে।

তার আর্তি, পরিবারে একটু স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে মৎস্য অধিদপ্তরে চাকুরির ইন্টারভিউ দিলেও চাকুরী হয়নি। তারপরও সমাজসেবা অধিদপ্তর, খাদ্য অধিদপ্তর ও প্রাথমিক শিক্ষক কোঠায় আবেদন করেছেন। কিন্তু এখনও তাকে ডাকা হয়নি।

ফেরদাউসের পিতা শাজাহান খলিফা বলেন, একটি হাত না থাকলেও কখনও দমে যায়নি। স্কুলে, কলেজে লেখাপড়া ও খেলাধুলায় ছিলো সামনের সারিতে ছিলো ফেরদাউস। এখন যদি একটা চাকুরী হয় তাহলে তাদের অবর্তমানে এক হাতেই পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারবে সে। এজন্য তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি ও সহায়তা কামনা করছেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here