আরিফ চৌধুরী শুভ :: থাকতেন খোলা আকাশের নিচে তেরপাল টানিয়ে। ঝড়বৃষ্টি দেখলে আশ্রয় নিতেন বাড়ির অন্যদের ঘরে। বছরখানেক হলো প্রতিবেশীর পরিত্যাক্ত রসুই ঘরে থাকার সুযোগ পেয়েছেন। এতেই মুছে গেছে অনেকটা আক্ষেপ কিন্তু হাসি নেই মুখে। তেরপালের ফুটো দিয়ে বৃষ্টি এলেই গড়িয়ে পড়ে পানি। খুব জোরে বৃষ্টি এলে পরনের কাপড় দিয়ে পানি পড়া বন্ধ করার চেষ্টা করেন। এ চিত্র লক্ষ্মীপুর জেলার ১৮ নং কুশাখালী ইউনিয়নের ফরাশগঞ্জ গ্রামের আবুল কাশেমের বাড়ির ষাটউর্ধ্বো বৃদ্ধ শামছুন্নাহারের।

স্থানীয় ইউপি পরিষদে গেলেও কখনো পাননি কোন সহযোগীতা? নেই কোন বয়স্কভাতা বা বিধবাভাতার কার্ড। কার্ড করে দিবে বলে বিভিন্ন সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও তাদের অনুসারিরা তার কাছ থেকে ৩০০০ টাকা নিলেও স্বামী মরে যাবার দীর্ঘ ১৫ বছর পরেও মেলেনি বিধাব ভাতার কার্ড। অভিমান করে এখন আর যান না কারো কাছে। স্থানীয় আলোকিত পাঠাগারই তার পাশে বিভিন্ন সময় সহযোগীতা নিয়ে দাঁড়িয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

দিনমুজুর স্বামী দীর্ঘদিন অসুখে ভোগার পরে মৃত্যুবরণ করেন ২০০৫ সালে। স্বামীর মৃত্যুর পর দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে টানাপোড়নের সংসার চলতো অন্যের জমিতে ও বাড়িতে কাজ করে। এখন আর শরীরে কুলায় না। রোগে শোকে বেঁচে থাকার স্বাদটাই যেন দিনদিন হারিয়ে ফেলেছেন এই বৃদ্ধা। ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা থাকেন। ব্রিকফিল্ডে কাজ করে কোনমতে চলে তার সংসার। মেয়েদের বিয়ে দিলেও ছোট মেয়ে শেফালী আক্তার (৩০) স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে যান বিয়ের কয়েক মাস পরে। স্বামী হারা শেফালী এখন একমাত্র পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তি। গার্মেন্টসে কাজ করে সংসারের চাকা সচল রেখেছেন তিনি। ফুটফুটে ৪ বছরের বাচ্চাকে গ্রামে মায়ের কাছে রেখে চট্টগ্রামে গিয়ে গার্মেন্টেসে কাজ করেন। মাঝে মাঝে বাড়ি এসে মাকে আর সন্তানকে দেখে আবার চলে যান কাজে। এভাবে দিন, মাস, বছর, চলে যায়, কিন্তু ভাগ্য বদলায় না তাদের। ‘এটাই আংগো ভাইগ্যো পোড়া কপাল’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন শেফালীর মা।

শেফালীদের খোলা আকাশের নিচে বসবাস দেখে বছর ৪ আগে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন আলোকিত পাঠাগার। ব্যক্তি সহায়তা নিয়ে শামছুন্নাহারকে একটি টিনের ঘর করে দিয়েছেন তারা। কিন্তু বেশিদিন সেই ঘরে থাকা হলো না শামছুন্নাহারের। হঠাৎই কঠিন অসুখে পড়েন তিনি। প্রায় লক্ষাধিক টাকা লেগে যায় তার সুস্থতার জন্য। মাকে সুস্থ করতে গিয়ে মেয়েরা বিক্রি করতে হয়েছে সেই ঘর। ঘর বিক্রি করে চিকিৎসার সময় ধার করা টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে তাদের।

আক্ষেপের সুরে শামছুন্নাহার বলেন ‘নতুন ঘরে হোতা আংগো ভাইগ্যে নাই, মাডিতে হুতি হারা জীবন কাডাইছি, মাডিতেই চলি যাইবো মরার পর’।

মাকে বেঁচে থাকতে আবারো নতুন ঘরে শোয়াবেন বলে একাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ছোট মেয়ে শেফালী।

সরেজমিনে বাড়িতে গিয়ে দেখা পেলাম শামছুন্নাহারের। নাতিকে কোলে নিয়ে বসে আছেন তিনি। ঘরের ভেতরে বসার কোন জায়গা নেই। কয়েকটি কাঠ দিয়ে মাচার মতো করে একটি শোয়ার স্থান ছাড়া আর কিছু নেই ঘরে।

টেলিফোনে কথা হলো শেফালীর সাথে। প্রতিবেদককে শেফালী বলেন, ‘আমাদেরতো কতবছর কোন ঘরই আছিল না। একটা ঘর করে দিছিলো আংগো গেরামের আলোকিত পাঠাগার। হেরাই আংগোরে যখন যা আসে সহযোগীতা করে। মার অসুখের সময় হেই ঘরও বেচি চিকিচ্ছা করাইছি। নইলে মারে বাঁচানো যাইতো না। আমাদের বার বার কে সহযোগীতা করবো বলেন?’

শেফালীর আরো বলেন, ‘নিরুপায় হয়ে আমার ছোড হোলারে মার কাছে রাখি গার্মেন্টসে এসে কাজ করি। মন মানে না কিন্তু কি করবো ভাই। আল্লাহ গরিব বানাইছে আংগোরে। এইবার ঘর নিজেই করবো চিন্তা করছি। এই ৩ বছরে গার্মেন্টেসে কাজ করে সংসারে টিয়া দিয়ে ১০ হাজার টাকা জমাইছি। আর কবছর গেলেই ঘরের টাকা জমা হইবো, কিন্তু ততদিন কি তার মা বাইচ্ছা থাকবো?’

শেফালীদের আবারো ঘর করে দিতে চায় স্থানীয় আলোকিত পাঠাগার। শেফালীর ঘর ও একটি স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন করে দেয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিত্তবানদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন আলোকিত পাঠাগার। এরই মধ্যে শফালীর ঘর করার জন্য ১৫ হাজার টাকা সহায়তাও পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন আলোকিত পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক এবিএম নোমান হোসেন। সহায়তা পেলে রমজানের মধ্যেই নতুন ঘর করে দিতে চায় তারা। ঘর তৈরিতে আলোকিত পাঠাগারের স্বেচ্ছাসেবীরা শারীরিক সহযোগীতা করবেন বলেও জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here