ঢাকা: চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জামায়াত বেশ ভালো করেছে। বিশেষ করে ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামায়াতের বাজিমাত চমকে দিয়েছে সব মহলকে। জামায়াতের এই ভালো ফলাফলের পেছনে ছিল বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা। বেশির ভাগ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বিএনপিকে ছাড় দিয়ে ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে দলটি। এজন্য জামায়াতের ভাইস চেয়ারম্যান সংখ্যা বড় দুই দলের চেয়ে বেশি।

ইতিমধ্যেই দুই দফায় মোট ২১২টি উপজেলার নির্বাচনের ফলাফলেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বেশ পিছিয়ে পড়েছে। এছাড়া বর্তমান প্রধান বিরোধী দল এবং একইসঙ্গে মন্ত্রিসভায় আসীন জাতীয় পার্টিও দুই দফাতেই চেয়ারম্যান পদে মাত্র একটি করে উপজেলায় জয়লাভ করেছে। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে টেক্কা দিয়ে বিএনপি অধিকসংখ্যক উপজেলায় তিন পদেই বড় ব্যবধানে জয়লাভ করেছে।

সম্প্রতি নানারকম বিতর্ক আর জটিলতার মধ্য দিয়ে সময় পার করা এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রায় নেতৃত্বহীন জামায়াতও উপজেলা নির্বাচনে বেশ চমকপ্রদভাবেই নিজেদের সংকটাপন্ন অস্তিত্বকে আবারো জাহির করেছে।

গত বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফার উপজেলা নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে, অধিকাংশ উপজেলায় এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতেও স্থানীয় সরকারের ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামায়াতেরর প্রার্থীরা নির্বাচনী দৌড়ে জয়লাভ করেছে। মূলতঃ বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমেই এই অগ্রগতি লাভ করেছে দলটি।

বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে ১১২টি ভাইস চেয়ারম্যান পদের মধ্যে ৩২টিতেই জিতেছে জামায়াত। যেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৩০টি আর জাতীয় পার্টি মাত্র তিনটি এবং অন্যান্য দলীয় বা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলে ১৪টিতে জয়লাভ করেছে। পাশপাশি সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামায়াতের ১৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এবং এদের মধ্যে ১১ জন বড় ব্যবধানে জয়লাভও করেছেন।

মাত্র কিছুদিন আগেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকানোর জন্য দেশব্যাপী চরম সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনার কারণে জামায়াত ভীষণ সমালোচিত হয়েছিল। আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা রাখায় সমালোচিত এই দলটির শীর্ষ নেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে কারাগারে আটক আছেন। ইতিমধ্যে একজনের মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয়ে গেছে।

দলের এই অবস্থায় এতকিছুর পরেও উপজেলা নির্বাচনে দলটির এই ফলাফল অনেককেই বেশ চমকে দিয়েছে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারির প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনে স্থানীয় সরকারের প্রধান হিসেবে দলটি জয় পেয়েছে ১২টি উপজেলায়।

প্রথম দফায় আশার চেয়ে ভালো ফলাফল করার পরে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনকে সামনে রেখে আরো সচেতন হয়েছিল স্থানীয় পর্যায়ে দলটির নেতাকর্মীরা। দ্বিতীয় দফার নির্বাচন উপলক্ষ্যে যেসব উপজেলায় জামায়াত সমর্থকদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি সেসব উপজেলা চিহ্নিত করে বিএনপির সহায়তা নিয়ে সেখানে ভাইস চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী দিয়েছে দলটি।

এক্ষেত্রে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে ভাইস চেয়ারম্যান পদগুলোর জন্য সেসব উপজেলাতে বিএনপির সমর্থনও আদায় করেছে দলটি, বিনিময়ে উপজেলাগুলোর চেয়ারম্যান পদে তারা সমর্থন দিয়েছে বিএনপিকে।

ফলাফল আর জামায়াতের এই কৌশল বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, অধিকাংশ উপজেলাতেই এবার চেয়ারম্যানের পদ বাদ দিয়ে ভাইস চেয়ারম্যানের পদগুলোতেই বেশি মনোযোগ দিয়েছে দলটি। ফলে ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব এসেছে বলে জনমনে যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছিলো, তা নিয়ে আবারো চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে।

নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে জামায়াত যে কৌশল অবলম্বন করেছিল- অর্থাৎ বিতর্কিত সর্বদলীয় সরকারের অধীনে ৫ জানুয়ারির একদলীয় নির্বাচন এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে দলীয় কোন্দলের কারণে উপজেলা পর্যায়ে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা- ইত্যাদি বিষয় যে জনমনে দাগ কেটেছে তাও এখন বেশ পরিষ্কার।

জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতা দাবি করেছেন, সরকার ও যৌথ বাহিনীর সদস্যরা বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতারের পাশাপাশি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম এবং নানাভাবে যে অত্যাচার চালাচ্ছে সেই বিষয়টিও দলটিকে জিততে সাহায্য করেছে।

দ্বিতীয় দফার উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতের ২৮ জন প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে, ৫৩ জন প্রার্থী ভাইস চেয়ারম্যান পদে এবং ১৬ জন প্রার্থী সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।

উপজেলা জামায়াতের নেতারা জানিয়েছেন, বিএনপির সঙ্গে সমঝোতাই নির্বাচনের ফলাফলে প্রতিফলিত হয়েছে। একই ধ্বনি প্রতিফলিত হয়েছে স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যেও।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী, খোকসা ও মিরপুর উপজেলায় জামায়াতের কোনো চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিল না। অন্যদিকে, ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিএনপির কোনো প্রার্থী ছিল না। কুমারখালীতে তারা কোরো নারী ভাইস চেয়ারম্যানকে সমর্থন দেয়নি। চেয়াম্যান পদে বিএনপি না জিতলেও জামায়াত একজন নারী ভাইস চেয়ারম্যানসহ ঠিকই তিনটিতে বিজয়ী হয়।

মেহেরপুরের দুটি উপজেলায় বিএনপি চেয়ারম্যান এবং একটি নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে জয় পায়। অন্যদিকে জামায়াত একটি নারী ভাইস চেয়ারম্যানসহ তিনটি ভাইস চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করে জামায়াত।

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী এবং রাজারহাট উপজেলা উজেলাও জামায়াত সমর্থিত ভাইস চেয়ারম্যান বিজয়ী হয়।

এসব উপজেলাতে বিএনপি ও জামায়াতের পরস্পরের প্রতি সমর্থনের কারণে এগুলোর চেয়ারম্যান পদে বিএনপি এবং ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামায়াত প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। একই কৌশল অবলম্বনের কারণে উপজেলাগুলোর বেশ কয়েকটিতে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীরাও জয়লাভ করেছেন।

জামায়াত প্রার্থীরা জনগণকে নিজেদের দিকে টানতে ঘরে ঘরে গিয়ে প্রচারণা চালিয়েছেন। পাশাপাশি, দলীয় কোন্দলের কারণে অনেকগুলো উপজেলায় আওয়ামী লীগের একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। ফলে সব মিলিয়ে উপজেলা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেহাল দশার সুযোগ নিয়ে জামায়াতকে সঙ্গী করে এগিয়ে গেছে বিএনপি।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here