উপকূলের শিক্ষামিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া(পটুয়াখালী) প্রতিনিধি :: পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নবগঠিত ইউনিয়ন ডালবুগঞ্জ। ২০১১ সালে এ ইউনিয়টি খাপড়াভাঙ্গা ইউনিয়ন ভেঙ্গে মহিপুর ইউনিয়নের সাথে পৃথক ইউনিয়ন ঘোষনা করে। অবহেলিত এ ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের একটি গ্রাম বরকতিয়া।

যেখানে এক দশক আগেও ৫০ ভাগের বেশি শিশু স্কুলগামী হতো না সেখানে এখন ৯০ ভাগেরও বেশি শিশু স্কুলে যায়। কলাপাড়ার প্রত্যন্ত এলাকায় স্কুলগামী শিশুদের হার বাড়লেও অভিভাবকদের কাছে এখন আতংক বিদ্যালয়ের ভাঙ্গা ভবন। তেমনি একটি বিদ্যালয় বরকতিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানে টিনের ঘরে স্কুল চললেও এখন অভিভাবকদের কাছে আতংক পরিত্যক্ত আগের বিদ্যালয় ভবনটি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একতলা বিল্ডিংটির ছাদের পলেস্তারা খসে পড়েছে অনেক আগেই। নেই দড়জা-জানালা। ভবনের পিলার ভেঙ্গে শুধু মরচে ধরা রডগুলো বের হয়ে আছে। বিবর্ণ ওয়ালের পলেস্তারাও খসে ইট বের হয়ে রয়েছে। একটু জোড়ে বাতাস হলেই ঝুর ঝুর করে ঝড়ে পড়ছে ছাদের পলেস্তারা, বালি।

এ ভবনেই ক্লাস করতো প্রায় দুই শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী। বরকতিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের এ জড়াজীর্ণ ভবনে দূর্ঘটনা এড়াতে ২০১৭ সালের শুরুর দিকে ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষনা করা হয়। কিন্তু নতুন ভবন নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দের আগেই ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষনা করায় বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাজীবন রক্ষার্থে ওই ভাঙ্গা বিধ্বস্ত ভবনের পাশেই একটি টিনের ঘর নির্মাণ করে ক্লাস নেয়া শুরু হয়। সে অবস্থা এখনও চলছে।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৫ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ৩০ বছর পর ১৯৯৫ সালে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদফতর তিনরুম বিশিষ্ট এ ভবনটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ভবন নির্মাণে অনিয়মের কারনে নির্মাণের ২২ বছরের মধ্যেই পরিত্যক্ত ঘোষনা করা হয় স্কুল ভবনটি।
বরকতিয়া গ্রামের একাধিক অভিভাবক জানান, প্রতিদিনই বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে খেলতে গিয়ে ভবনের ভাঙ্গা অংশ পড়ে শিশুরা আহত হচ্ছে।

এরআগে যখন ওই ভবনে ক্লাস হতো তখনও ছাদের পলেস্তারা পড়ে শিক্ষার্থী আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। জরুরী ভিত্তিতে ওই বিধ্বস্ত ভবনটি ভেঙ্গে ফেলা না হলে এ দূর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। এ কারনে অনেক অভিভাবকরা সন্তানদের একা স্কুলে পাঠাতে পারছে না। এ কথা স্বীকার করলেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. তৈয়ব আলী মৃধা জানান, ভবনটি জরাজীর্ণ হওয়ায় ভয়ে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে চাইতো না। এ কারনে গত বছর ভবনটিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী বিভাগ পরিত্যক্ত ঘোষনা করে। এরপর থেকে ক্লাস নেয়া হচ্ছে ইউনিসেফ’র দেয়া একটি টিনের ঘরে।
স্থানীয় বাসিন্দরা জানান , এ ইউনিয়নের কাজিকান্দা ,হাজিকান্দা, বরকতিয়া , খাপড়াভাঙ্গা, মনসাতলী ও পাশের মাজের দিওর গ্রামের শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষা লাভের একমাত্র প্রতিষ্টান এ বিদ্যালয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৮০ জন।

বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. কাশেম আলী মৃধা বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিদ্যালয়ে ভবনের ব্যাপারে আবেদন জানিয়েছি। তারা পরিদর্শনও করেছে। কিন্তু এখনও নতুন ভবন নির্মাণের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।

কলাপাড়া উপজেলা এলজিইডির উপ প্রকৌশলী মো.দেলোয়ার হোসেন বলেন, ওই বিদ্যালয় নতুন ভবন টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে । আমরা পুর্বের ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষনা করছি।

অপরদিকে ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি থাকলেও শুধু শিক্ষক সংকটের কারনে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এখনও অবহেলিত। স্কুলে গেলেও ক্লাস হচ্ছে না শিক্ষক না থাকায়। এ অবস্থা অধিকাংশ বিদ্যালয়ে। শহর কেন্দ্রিক বিদ্যালয়গুলোতে আসার জন্য শিক্ষকদের ক্রমশ তদবির ও উপজেলা শিক্ষা অফিসের বদলী বানিজ্য অব্যাহত থাকায় গ্রামীন শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে শিক্ষক সংকটেরর কারনে । তেমনি একটি বিদ্যালয় বৌলতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

১৯৭৩ সালে কলাপাড়ার নয়াকাটা গ্রামে বৌলতলী সৈয়দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যারয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে একজন শিক্ষক দিয়ে চলছে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম। অথচ এ বিদ্যালয়ে চারজন শিক্ষক কর্মরত ছিলেন। পর্যায়ক্রমে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সালে দুইজন শিক্ষক অবসরে যান। ২০১১ সালে শিক্ষা অফিস থেকে বদিউজ্জামান নামে এক জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়। কিন্তু দীর্ঘ ছয় মাস ক্লাশ করার পর তার কলেজে চাকরি হলে তিনি অন্য জায়গা চলে যান। এরপর কোন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি।

বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায় প্রত্যন্ত গ্রামের এ বিদ্যালয়ে ছ্ত্রা ছাত্রীর গড় উপস্থিতি সংখ্যা ৯৫ জন। বর্তমানে একজন শিক্ষক দিয়ে চলছে ১১৮ শিক্ষার্থীর পাঠদান।

এই বিদ্যালয়টিতে শিশু শ্রেণিতে ২১ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২২ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ২৫ জন, চতুর্থ শ্রেণিতে ১৮ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। সকালের শিফটে শিশু শ্রেণি, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাশ ও বিকালের শিফটে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাশ অনুষ্টিত হওয়ার কথা। কিন্তু দুপুর ১২টার মধ্যে বিদ্যালয় ছুটি হয়ে যায়। একজন শিক্ষক তাদের নাম ডাকা ও বিস্কুট বিতরন করতে করতেই সময় শেষ হয়ে যায় এ অভিযোগ অভিভাবকদের।

অভিভাবকদের দাবি, উপজেলায় অনেক স্কুল রয়েছে যেখানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ১০০’র নিচে অথচ শিক্ষক সংখ্যা পাঁচের অধিক। সেসব স্কুল থেকে ডেপুটেশনে শিক্ষক পদায়ন করে এ স্কুলের পাঠদান চালিয়ে নেয়া সম্ভব। কিন্তু শিক্ষা কর্মকর্তা এদিকে কোন নজরই দিচ্ছেন না। এ কারনে অবহেলিত থেকে যাচ্ছে গ্রামী প্রত্যন্ত স্কুলের শিক্ষার্থীরা।

বেীলতলী সৈয়দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারুন অর রশিদ জানান, উপজেলা শিক্ষা অফিসে শিক্ষকের জন্য লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। শিক্ষা অফিস থেকে বলছে শিক্ষক সংকট। এ কারনে বিদ্যালয়ের ১১৮ জন শিক্ষার্থীকে তিনি একাই পড়ান।

তিনি আরও বলেন, উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দুরবর্তী এ বিদ্যালয় থেকে সপ্তাহে দুই দিন সমন্বয় সভাসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের কাজে আমাকে শিক্ষা অফিসে যেতে হয়। কোনো শিক্ষক না থাকায় বাধ্য হয়ে তখন বিদ্যালয় ছুটি দিতে হয়। তাই নিয়মিত ক্লাস নেয়া সম্ভব হয় না।

একাধিক অভিভাবক বলেন, বিদ্যালয়-ছাত্র-ছাত্রী সবই আছে। শুধু শিক্ষক নেই। এ কারনে এখানে পর্যাপ্ত সুবিধা থাকা সত্বেও শুধু শিক্ষক সংকটের কারনে সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না। কারন স্কুলে গিয়ে কি লাভ ? সেই নাম ডেকে বিস্কুট হাতে দিয়ে বলবে ছুটি। আর একজন শিক্ষকের পক্ষে কি একটা স্কুল চালানো সম্ভব। শুধু ঠিকমতো ক্লাস না হওয়ায় ক্রমশ শিক্ষার্থীরা স্কুল বিমুখ হয়ে পড়েছে।

শিক্ষানুরাগী মো. নোয়াব আলী হাওলাদার বলেন, শিক্ষা অফিসে আমি নিজে কয়েকবার লিখিত আবেদন করেছি শিক্ষক নিয়োগের জন্য। কিন্তু কোন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না।

কলাপাড়া প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনি লাল সিকদার বলেন,জানুয়ারী মাসে শিক্ষক বদলীর সময় যে স্কুলে শিক্ষক বেশি আছে সেখান থেকে যে স্কুলে শিক্ষক কম আছে সেই স্কুলে শিক্ষক দেয়া হবে। বিষয়টি তাদের জানা আছে বলে জানান।(চলবে)

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here