হীরেন পণ্ডিত :: বিশ্ব সভ্যতাকে নতুন মাত্রা দিতে যাচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এই বিপ্লবের প্রক্রিয়া ও সম্ভাব্যতা নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে আমাদের দেশেও। এই আলোচনার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এক ধরনের সচেতনতা তৈরি বাংলাদেশকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নেতৃত্ব দানের উপযোগী করে গড়ে তুলে দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা নিরলস কাজ করছেন। আমরা জানি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হচ্ছে ফিউশন অব ফিজিক্যাল, ডিজিটাল এবং বায়োলজিকাল স্ফেয়ার। এখানে ফিজিক্যাল হচ্ছে হিউমেন, বায়োলজিকাল হচ্ছে প্রকৃতি এবং ডিজিটাল হচ্ছে টেকনোলজি।

ব্লকচেইন একটি বিকেন্দ্রীভূত এবং টেম্পারিং প্রতিরোধী লেজার পদ্ধতি। একবার ব্লকচেইনে কোনও ডেটা বা লেনদেন নিবন্ধিত হয়ে গেলে, এটি পরিবর্তন করা যায় না, ফলে এটি অপরিবর্তনীয়। এছাড়াও, একটি ব্লক গঠন ও চেইনে যুক্ত হওয়ার আগে, নেটওয়ার্কগুলিতে সমস্ত অংশগ্রহণকারীদের ডেটা যাচাই করা হয়। এই বৈধতা সম্মতি হিসাবে পরিচিত। ঐক্যমত হয়ে গেলে ব্লকটি অনুমোদিত হয় এবং একটি টাইমস্ট্যাম্প দেওয়া হয় যা পূর্ববর্তী ব্লকের সাথে সংযুক্ত হয়। এভাবে অনেক গুলো ব্লক নিয়ে চেইন গঠন করে। তাই ব্লকচেইন প্রযুক্তি ডিজিটাল তথ্য সংরক্ষণ, শেয়ারিং ও যাচাইকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের আস্থা, দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছতা বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করে। আর এজন্য বিভিন্ন সংস্থা অর্থ, পরিচয় ব্যবস্থাপনা এবং সরবরাহ চেইনের মতো শিল্পগুলিতে জালিয়াতি রোধে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহারের উপায়গুলি নিয়ে কাজ করছে।

ডিজিটাল পরিচয়ের মূল ভূমিকা হচ্ছে অনলাইন মাধ্যমে আমাদের আদান-প্রদানগুলো আরও সহজ, দক্ষ, সুরক্ষিত এবং ব্যক্তিগত করা। বর্তমান ডিজিটাল বিশ্বে অনলাইন পরিচয় পদ্ধতি হচ্ছে অনেটাই কেন্দ্রীভূত। যেহেতু কেন্দ্রীভূত পরিচয় ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত তথ্য কোনো কেন্দ্রীভূত সার্ভারে সংরক্ষিত থাকে এবং কোনো একক পার্টি পরিচয় ইস্যু অধিকার রাখে। আর এই সার্ভারগুলো সাইবার আক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সরকার এবং সংস্থাগুলি যেখানে সাইবার আক্রমণ থেকে নাগরিক এবং গ্রাহকের তথ্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে এমন সমস্ত জায়গায় তথ্য ফাঁস প্রতিরোধ করতে স্বতন্ত্র সার্বভৌম পরিচয় একটু যুগান্তকারী সমাধান। সার্বভৌম পরিচয় ব্যবস্থায় ব্যবহারকারীরা তাদের পরিচয় নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, তথ্য ব্যবহার এবং পরিবর্তন করতে পারবে এবং সর্বোপরি বাছাই করা ব্যক্তিগত তথ্য অন্যান্য সংস্থার সাথে শেয়ার করতে পারবে। বিকেন্দ্রীকরণ, স্বচ্ছতা, অপরিবর্তনীয়তা প্রভৃতি বৈশিষ্টের কারণে ব্লকচেইন প্রযুক্তির সাহায্যে সহজেই ডিসেন্ট্রালাইজড ডিজিটাল আইডেন্টিটি সিস্টেম তৈরী করা সম্ভব।

বাংলাদেশে সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে বিরোধ খুব সাধারণ বিষয়। সম্পত্তির সাথে সম্পর্কিত নথিগুলি সহজেই জাল করা যায়। যদি কোনও ব্যক্তি, সম্পত্তি কেনার সময় সতর্ক না হন তবে বহুমুখী সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন, পরবর্তী পর্যায়ে সম্পত্তিটির মালিকানা নিয়ে মামলা হতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশের সম্পত্তির মালিকানা যাচাই করা একটি শ্রমসাধ্য কাজ। মালিকানা যাচাইকরণ, মালিকানার ইতিহাস, অননুমোদিত জমি বিক্রয় ও মালিকানা স্থানান্তরে কালক্ষেপণ প্রভৃতি জটিল সমস্যা ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যাবহার করে সহজে সমাধান করতে পারি।

ব্লকচেইন প্রযুক্তিতে বিকেন্দ্রীকরণ, স্বচ্ছতা এবং অপরিবর্তনীয়তার বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রতিবার যখন কোনও পণ্য হাত বদল করে, লেনদেনটি ব্লকচেইনে নথিভুক্ত হয়। এভাবে উৎপাদন থেকে বিক্রি পর্যন্ত কোনও পণ্যের বিস্তারিত স্থায়ী ইতিহাস তৈরি হয়। ফলে সমস্ত ক্রয়ের আদেশ, পরিবর্তন আদেশ, প্রাপ্তি ও বাণিজ্য সম্পর্কিত বিশদ তথ্য ট্র্যাক করা সহজ হবে।

স্বাস্থ্যসেবাতে ব্লকচেইন প্রযুক্তির সুযোগ অপরিসীম। স্বাস্থ্যসেবাতে রোগীর সমস্ত মেডিকেল রেকর্ডের অখণ্ডতা নিশ্চিত করতে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগীর একক পরিচয় তৈরি করা যেতে পারে। কারণ মেডিকেল রেকর্ড ব্লকচেইনে সংরক্ষণ করা যেতে পারে যা রোগীর তথ্যের নিখুঁত প্রমাণ সরবরাহ করবে কারণ ব্লকচেইনের রেকর্ডটি পরিবর্তন করা যায় না। তাছাড়া বিভিন্ন বিভিন্ন ওষুধের গুণগত মান, উপাদান, সরবরাহ চেইন পরিচালনা ও দাম নির্ধারণের জন্যে ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার অনেকভাবে কাজে আসবে।

তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির ফলে কৃষিতে ডিজিটালাইজেশনের আবির্ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কৃষি পণ্যগুলির উৎস সন্ধানের ক্ষমতা এবং স্বচ্ছতা সম্পর্কিত এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ব্লকচেইন ডিজিটাল প্রযুক্তি যা এই শূন্যস্থানগুলি সমাধান করার সক্ষমতা রাখে। এই প্রযুক্তি কৃষকদের ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রয় করতে এবং লেনদেনের ফি  হ্রাস করতে সহায়তা করবে। ট্রেসিবিলিটি এবং অডিটিবিলিটির মতো বৈশিষ্ট্যের জন্য কৃষকরা মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন ছাড়াই সরাসরি রেস্তোঁরা বা ব্যক্তিদের কাছে সরাসরি ফসল বা খাবার বিক্রি করতে পারবেন। ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে শস্যের সন্ধান এবং রোপণের সময় থেকে বিতরণ পর্যন্ত বিস্তারিত অবস্থা জানতে সহায়তা করবে এ কারণেই ওয়ালমার্ট, ইউনিলিভার, এবং ক্যারফুরের মতো জায়ান্টরা খাদ্য পণ্যগুলির উৎস শনাক্ত করার জন্য ইতিমধ্যে ব্লকচেইন অবলম্বন করেছে।

আন্ত:ব্যাংক সেটেলমেন্ট ব্যবস্থায় ব্লকচেইন প্রযুক্তি ভূমিকা পালন করতে পারে। ব্লকচেইন প্রযুক্তির ফলে কোনো মধ্যস্থতাকারী ছাড়াই বিভিন্ন ব্যাংকিং পার্টির সাথে লেনদেন সহজ হবে। সকল ব্যাংক নিয়ে একটি কনসোর্টিয়াম এবং অনুমোদিত ব্লকচেইন নেটওয়ার্ক তৈরী করা যেতে পারে। এ ধরনের ব্লকচেইনে কেবলমাত্র ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে অনুমতি আছে এমন পক্ষগুলিকে নেটওয়ার্কে অংশ নিতে, লেনদেন করতে এবং তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ থাকবে ফলে আন্ত:ব্যাংক সেটেলমেন্ট ব্যবস্থা অনেক সহজ হবে।

শিক্ষাক্ষেত্রে ব্লকচেইন প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাগত সার্টিফিকেটের জালিয়াতি প্রতিরোধ করবে। এটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল প্রভৃতি কর্তৃপক্ষের সার্টিফিকেট যাচাই করার জটিলতা হ্রাস করবে। সার্টিফিকেট ব্লকচেইন রিপোজিটরিতে সংরক্ষিত হবে। হার্ডকপি সার্টিফিকেটে রেফারেন্স হ্যাশ যোগ করা হবে। ফোন অ্যাপ্লিকেশন, ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে হ্যাশ যাচাই করা যাবে।

হার্ডকপি সার্টিফিকেট সম্পূর্ণরূপে বাদ দেওয়া যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র একটি রেফারেন্স হ্যাশ বা ইউনিক সংখ্যা দেওয়া হবে এবং শিক্ষার্থীরা এই রেফারেন্স নম্বরের দিয়ে চাকরি এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য আবেদন করবে। কর্তৃপক্ষ ব্লকচেইন ভিত্তিক সিস্টেমে সার্টিফিকেট যাচাই করবে। এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট সত্যায়িত করার দরকার নেই।

বিদ্যমান বীমা কাঠামোগুলো ধীর, ব্যয়বহুল এবং প্রায়শই বেশ কয়েকটি মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন হয়। জটিল বিতরণ প্রক্রিয়া, মিথ্যা ইন্সুরেন্স দাবী করার মত ঘটনা, তৃতীয় পক্ষের আর্থিক লেনদেন এবং বিপুল পরিমাণে ডেটা ব্যবস্থাপনসহ বীমা সংস্থাগুলি বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ব্লকচেইন প্রযুক্তি দিয়ে গাড়ি থেকে স্বাস্থ্যসেবা পর্যন্ত বীমা বাজারের প্রায় বিভাগেই কাজ করা সম্ভব যা বিদ্যমান কর্মপ্রবাহের উন্নতি করবে এবং সমস্যাগুলো ব্যাপকভাবে সমাধানে সহায়তা করবে। ফলে বীমা সংস্থাগুলি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিদের আরও ভাল ও সুরক্ষিত বীমা সেবা প্রদান করতে সক্ষম হবে।

রিয়েল-টাইম, অপরিবর্তনীয়, বিকেন্দ্রিকতা, বিশ্বস্ততা এবং স্বচ্ছ লেনদেন প্রভৃতি ব্লকচেইন প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য হওয়ায় ব্লকচেইন প্রযুক্তি কর ও ভ্যাট ব্যবস্থার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ট্যাক্স প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও স্বয়ংক্রিয় করার জন্য ব্লকচেইনের অনেক সম্ভাবনা আছে। যদি কেউ সমস্ত আয়-ব্যয় এবং লেনদেনের হিসেব ব্লকচেইনে রাখে তাহলে ট্যাক্স কর্তৃপক্ষ রিয়েল-টাইমে ট্যাক্সের অর্থ গণনা এবং প্রয়োগের জন্য ব্লকচেইনের সংরক্ষিত তথ্য ব্যবহার করতে পারবে। সেক্ষত্রে ট্যাক্স জালিয়াতি এবং ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ কমে যাবে। তাছাড়া বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সুপারশপ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যেসব ভ্যাট আদায় করা হয় তা যদি ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার সংরক্ষণ করা হয় তাহলে ভ্যাট দাতারা যেমন রিয়েল টাইমে সেসব তথ্য যাচাই করতে পারবে ঠিক তেমনিভাবে ট্যাক্স কর্তৃপক্ষও রিয়েল টাইমে অর্জিত ভ্যাটের পরিমাণ জানতে পারবে।

এছাড়াও ভোটিং, টেলিকমিউনিকেশন, পরিবহন ব্যবস্থা, রিয়েল স্টেট ব্যবসা, মৎস্য শিল্প, গবাদি পশু প্রতিপালন, ফটোগ্রাফি, বিমান যাত্রা ও অভিবাসী ট্র্যাকিং প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্লকচেইন প্রযুক্তি প্রয়োগ করার সুযোগ আছে। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের অন্তর্গত বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডিজিটাল আর্কিটেকচার টীম ব্লকচেইন প্রযুক্তির উপর কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে আমরা বিএনডিএ টিম হাইপার-লেজার ফেব্রিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্য শস্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেম সাথে ব্লকচেইনের সফল ইনট্রিগেশন নিয়ে কাজ করছে। ব্লকচেইন নিয়ে ইতিমধ্যে বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছোট-বড় বিভিন্ন ধারণা নিয়ে কাজ করছে।

 

লেখক: রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here