‘ইচ্ছে করে কারো দরজা খুলে ফারহানকে টেনে নিয়ে আসি’ষ্টাফ রিপোর্টার :: ‘প্রতিদিন রাত ৮টার দিকে ফারহান আসতো। দরজা খুলে দিতাম। এখনও প্রতিদিন বসে থাকি, ফারহান আসে না। আমাকে মা ডাকে না। কার ঘরে আমার ফারহানকে আটকে রাখা হয়েছে। আমার ইচ্ছে করছে কার দরজা খুলে ফারহানকে টেনে নিয়ে আসি’। কথাগুলো বলে ঝরঝর করে কেঁদে উঠলেন ফারহানের  মা। গত ১১ মে বনানী থেকে ডিএনএস সফটওয়্যার লিমিটেডের রিলেশনশিপ ম্যানেজার ফারহান অপহূত হয়। আজও পুলিশ তার সন্ধান পায়নি।

ইস্টওয়েষ্ট ইউনির্ভাসিটি থেকে এমবিএ করেছেন এ এস এম ফারহান হোসেন (২৮)। মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকার ১৩ নম্বর রোডে মা-বাবার সঙ্গে থাকতেন। ডিএনএস সফটওয়্যার লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানে রিলেশনশিপ ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। গত ১১ মে বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটে তাকে অফিস নিচে আসতে ফোন করা হয়। বের হওয়ার সময় টেবিলে ল্যাপটপ ও অন্যান্য সামগ্রী খোলা রেখে বাহির হয়। তারপর থেকে আর কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।

নিখোঁজের দিন রাত প্রায় ১২টার দিকে রূপনগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। যার নাম্বার- ৪৩২। বনানী থেকে অপরহূত হওয়ায় ওই থানায় জিডি করার জন্য রূপনগর থানা থেকে বলা হয়। এরপর ১২ মে বনানী থানায় পূনরায় জিডি করা হয়। যার নাম্বার- ৫৫০। জিডি গ্রহণের পর বনানী থানার কর্মকর্তারা মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে নিখোঁজের সর্বশেষ অবস্থান মিরপুর শাহ আলি থানাধীন চটবাড়ী পেয়েছেন। এছাড়া নিখোঁজের পর দিন ফারহানের পিতা সকাল ১১টায় র‌্যাব-৪ কার্যালয়ে গিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেন। যার নাম্বার ২০৪।

‘ইচ্ছে করে কারো দরজা খুলে ফারহানকে টেনে নিয়ে আসি’অপহরণের দুইদিন পর সকাল সোয়া ৬টায় ফারহনের বাবার (সাহাদাত হোসেন) ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে ০১৮১১৫৪২৩১৬ থেকে একটি ফোন আসে। পরবর্তীতে আবারও অপহরণের চারদিন পর বেলা পৌনে ১২টায় একই নম্বর থেকে ফোন আসে। এবার ফারহান খাওয়ার খরচ বাবদ ২৫ হাজার দাবি করে অপহরণকারীরা। ওইদিন কিছুক্ষণ পর নিখোঁজের খালু তৌহিদুল ইসলামের মোবাইল নম্বরেও ফারহানের নম্বর থেকে ফোন আসে। এরপর ফারহানে বাবা অপহরণকারীদের কাছে ২০ হাজার টাকা বিকাশ করে পাঠান। তারপরই নম্বর দুইটি বন্ধ হয়ে যায়। আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

ফারহানে মা গুলশান আরা বেগম জানান, ‘প্রতিদিন সকালে ফারহান রুটি খেতো। সেদিনই প্রথম গরম ভাত খেতে চেয়েছিল। ভাত রেধেঁছি, সঙ্গে ছিল গরুর গোশত। খাওয়ার পর ফারহান অফিসের যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল। প্রতিদিনের মতো তাকে ফি-আমানিল্লাহ বলে বিদায় দিলাম। এরপর আমার ছেলে আর ফিরে আসেনি।’ তিনি আরও জানান, ‘গত ২০ ফেব্রুয়ারি ফারজানা আক্তার ববির সঙ্গে ফারহনের বাগদান হয়। আগামী ২৪ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হওয়া কথা ছিল। এরই মধ্যে অপহরণের ঘটনাটি ঘটে।’ ছেলে বিয়ে বিষয়ে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মা গুলশান আরা বেগম।

অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি বলেন, ‘ফারহান আমাকে প্রায় বলত, মা বিয়ে নিয়ে তোমরা কী ভাবছো? আমি কিন্তু খুব বেশি জাকজমক পছন্দ করি না। আমাদের এতো টাকা নেই। আর বেশি খরচ হলে বাবার ওপর চাপ পড়বে।’ মায়ের খুব আদরের ছোট ছেলে ফারহান। মেয়ে না থাকায় মাকে ঘর-দোর পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে সব কাজে সাহায্য করতে সে। তার নিজের বিছানা এমনভাবে সাজিয়ে রাখতো যেন মেহমানের জন্য সাজানো হয়েছে।

ঢাকা কমার্স কলেজের ছাত্র ফারহানের শৈশব কাটে মতিঝিল ব্যাংক কলোনীতে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চ বিদ্যালয়ের লেখাপড়া করেছেন তিনি। সরকারি চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত বাবা সাহাদাত হোসেনের কষ্ট লাঘবের জন্য খুব দ্রুত চাকরি নেয় সে। সাহাদাত হোসেন বলেন, ‘সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর একটি বেসরকারি ফার্মে আমি চাকরি নেই। ফারহান প্রায় বলত বাবা, তোমাকে আর কষ্ট করতে দিবো না। আমি তো চাকরি করছি। এবার তুমি চাকরিট ছাড়।’ অপহূত ছেলের কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে যান তার বাবা। তিনি বলেন, ‘ফারহান যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে, তখন তার মায়ের খুব কঠিন অসুখ হয়। ওই সময় তার মাকে অপারেশন করাতে হয়েছে। অপারেশনের পুরোটা সময় ফারহান মায়ের পাশে তসবিহ হাতে আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়েছিল। ডাক্তার দেখে বলেছিল, এমন ছেলের মায়ের কখনো বড় কোন রোগ হবে না।’

তিন মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও কোন খোঁজ নেই ফারহানের। এতে পুরো পরিবারটি বিধ্বস- হয়ে গেছে। পরিবারের বড় ছেলে রিদওয়ান হোসেনকে ভয়ে ঘর থেকে বের হতে দিতে চায় তার ফারহানের মা। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়ে দরজার সামনে বসে থাকেন তিনি। কখনও ফারহান আসবে, সেই অপেক্ষায় দুই মাস নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছেন দরজায় সামনে বসে। অপহরণের পর তিন থানায় জিডি ও র‌্যাবের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তারপরও সন্তান হারানো বিধ্বস্ত পরিবারটিকে খুব বেশি আশার বাণীতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী। যোগাযোগ করা হলে প্রতিদিনই বিষয়টি আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছি বলে দায়িত্ব শেষ করেন পুলিশের সদস্যরা। তিন মাস পার হয়ে গেলেও ফারহানকে উদ্ধারে কোন অগ্রগতি নেই।  ফলে মায়ের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। কেটে যাচ্ছে একের পর এক নির্ঘুম রাত।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here