ঝিনাইদহ প্রতিনিধি:

 

ঝিনাইদহের মাঝদিযা গ্রামের মানুষ বসবাস করছে আর্সেনিকের সাথে। এখানে ভয়াবহ আকার ধারন করেছে আর্সেনিকোসিস। একই গ্রামের ২ শতাধিক ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে ২জন ।

সরেজমিনে কালীগঞ্জের মাঝদিয়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় বৃদ্ধা সুখ কুমারীর সাথে। তার সংসারের সকল সুখ কেড়ে নিয়েছে ঘাতক ব্যধী আর্সেনিক। নিজে আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ভুগছেন ১০ বছর। স্বামী হাজারী লালও এই রোগে আক্রান্ত। স্বামী-স্ত্রীর সবচে বেশী কষ্ট তাদের একমাত্র পুত্র পরিমল কুমার ঘোষ (৩৫) আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মরতে বসেছেন। গত ১২ টি বছর নানা রকম চিকিৎসা দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। আর একমাত্র ছেলেকে বাঁচাতে তাদের চাষযোগ্য ১৬ বিঘা জমির মধ্যে ১১ বিঘায় বিক্রি হয়ে গেছে।

হাজারী লাল ঘোষ নামের ওই পরিবারের শুধু নয়, গোটা গ্রামের দুই শতাধিক পরিবারের সদস্যরা এই রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরের পর বছর ভুগছেন। ইতোমধ্যে ২ জন এই রোগে আক্রন্ত হয়ে মারা গেছেন। যারা আক্রান্ত রোগী আছেন তাদের নেই কোন ভালো চিকিৎসা। ২/১ টি সেচ্ছাসেবী সংগঠন গ্রামটিতে কয়েকটি আর্সেনিক মুক্ত পানির প্লান্ট স্থাপন করে দিয়েছেন। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। গ্রামটিতে দেখা দিয়েছে পনির সংকট।

মাঝদিয়া গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামটিতে প্রায় ৬ শ পরিবার রয়েছে। বসবাসকারী লোকসংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। এখানে দুই শতাধিক পরিবার রয়েছে যাদের বেশীরভাগ সদস্যই আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রন্ত। গ্রামের ঘোষপাড়ার হাজারী লাল ঘোষ জানান, ইতিপূর্বে আর্সেনিক সম্পর্কে তাদের কোন ধারনা ছিল না। এখন থেকে ১২ বছর পূর্বে হঠাৎ একদিন তার ছেলে পরিমল কুমার ঘোষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার শরীরে জ্বর এবং ফোটা ফোটা দাগ দেখা দেয়। ঠিকমতো খেতে পারে না, কোন কাজও করতে পারে না দূর্বল হয়ে পড়ে।

এ অবস্থা দেখে তিনি যশোর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে দেখানোর পর কোন রোগ ধরা পড়ে না। আবার ছেলেও সুস্থ্য হয়ে ওঠে না। তখন তিনি নিয়ে যান খুলনা হাসপাতালে। সেখানে যাবার পর ডাক্তার তাকে জানান ছেলে আসেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত। ওই ডাক্তার বাড়ির টিউবওয়েলের পানি পান করতে নিশেষ করেন। কিন্তু বিকল্প কোন ব্যবস্থা না থাকায় তারা কিছু দিন ওই পানিই খেয়েছেন।

হাজারী লাল জানান, কয়েক মাসের ব্যবধানে একই রোগ ধরা পড়ে তাদের গ্রামের জয়দেব কুমার ঘোষ (৩৪) ও ইজ্জত আলীর (৩৮)। এরাও চিকিৎসা নিতে থাকে। তিনি তার ছেলেকে ভারতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো শুরু করেন। ছেলে পরিমল তার একমাত্র পুত্র সন্তান। যে কারনে তাকে বাচাঁতেই হবে, তাই অর্থের দিকে তিনি খেয়াল করেননি।

যত টাকা প্রয়োজন পড়েছে তিনি জায়গা-জমি বিক্রি করে জোগাড় করেছেন। এভাবে ১১ বিঘা জমি বিক্রি করে ফেলেছেন। এখনও ছেলে ভালো হয়নি। কোন শক্ত কাজ করতে পারেন না। শরীর দুর্বল থেকেই যায়। তিনি জানান, তার সন্তানের সাথে জয়দেব ও ইজ্জত আলী নামের যে দুইজন আক্রান্ত  হয়েছিল ৭/৮ বছর চিকিৎসা নিয়েও তারা বাচঁতে পারেনি। অর্থের অভাবে ভালো চিকিৎসা না হওয়ায় ৪ বছর পূর্বে ওই দুইজন মারা গেছেন।

ওই গ্রামের শুশান্ত ঘোষের স্ত্রী মমতা ঘোষ জানান, তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনই আক্রান্ত হয়েছেন। আর্সেনিক কি তা না বুঝে নিজেদের বাড়ির টিউবওয়েলের পানি পান করেছেন। যখন বুঝতে পারলেন তখন আক্রান- হয়ে পড়েছেন। এখন সারাক্ষন ঔষধ খেতে হয়।

স্বামী গ্রামে গ্রামে দুধ বিক্রির কাজ করে। এই কাজে যে আয় হয় তা দিয়ে ঠিকমতো সংসারই চলে না। যে কারনে সব সময় ঔষধ কিনে খাওয়ায় হয়ে ওঠে না। মৃত মন্তোষ কুমার ঘোষের স্ত্রী নমিতা ঘোষ জানান, তার দুই ছেলে জয়দেব কুমার ও মিলন কুমার ঘোষ। তিনি নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে জয়দেব কুমার এই রোগে মারা গেছেন।

ছোট ছেলে বেচেঁ আছেন, কিন্তু আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে। সারাক্ষন তার চিকিৎসা চলে। ভয় হয় বড় ছেলে একবার এই রোগে মারা গেছেন। রোগীরা জানান, তাদের গ্রামের বেশীর ভাগ লোকই এই রোগের চিকিৎসা নিতে নিতে আর্থিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। এখন ঠিকমতো ঔষধ খেতে পারেন না। পল্লী উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে কিছু ভিটামিন দেয়া হয়। সেগুলো তারা খান।

তার ওই সংস্থাটির পক্ষ থেকে গ্রামে বৈঠক করে সকলকে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়। যা তাদের ব্যপক উপকারে এসেছে।

গ্রামের রেজাউল ইসলাম জানান, প্রথমে তারা আর্সেনিক সম্পর্কে বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে যখন গ্রামের দুইজন মারা যান এবং অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন বুঝেছেন এর ক্ষতিকর দিকগুলো। তাছাড়া পরিস্থিতি খারাপ হয়ে আসলে বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের গ্রামে সেবামুলক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসেন।

গরীবের আশ্রয় নামের একটি এনজিও গোটা গ্রামের টিউবওয়েল গুলোর পানি পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন। সে সময় যে টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিক পাওয়া যায় সেগুলোর পানি না খাওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু গ্রামে বিকল্প কোন পানির ব্যবস্থা না থাকায় মানুষ খেয়েছেন।

রেজাউল ইসলাম জানান, পরবর্তীতে এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্ক এর পক্ষ থেকে গ্রামের তিনটি আর্সেনিক মুক্ত পানির প্লান্ট স্থাপন করা হয়। পুকুর থেকে পানি উঠিয়ে ফিলটারের মাধ্যমে আর্সেনিক মুক্ত করে এই পানি খাওয়ার উপযোগী করা হয়। কিন্তু গোটা গ্রামের মানুষের জন্য এটা ছিল খুবই সামন্য।

পরে পল্লী উন্নয়ন সংস্থা নামের আরেকটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন ৩ টি গভীর নলকুপ ও ৫ টি আর্সেনিক মুক্ত পানির প্লান্ট স্থাপন করে দিয়েছেন। এগুলো থেকে গ্রামের মানুষ পানি পান করছেন। কিন’ ৪ হাজার মানুষের জন্য এটা খুবই সামান্য।

সকালে পানি নেবার জন্য লম্বা লাইন পড়ে যায়। গ্রামের মহিলা মেম্বর আলেয়া বেগম জানান, এখনও অনেকে উপায় না পেয়ে আর্সেনিক যুক্ত পানি খাচ্ছে। প্রয়োজন আরো কমপক্ষে ১০ টি আর্সেনিক মুক্ত পানির প্লান্ট স্থাপন।

উপজেলা গণস্বাস্থ্য অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর একটা জরিপ করেছিলেন। সেই জরিপে মাত্র ২০ টি রোগী পাওয়া যায়। এরপর তারা আর কোন তথ্য সংগ্রহ করেননি। ওই দপ্তরের প্রকৌশলী সুনিল কুমার বিশ্বাস জানান, ইতোমধ্যে তারা গ্রামটি পরিদর্শন করেছেন।

নানা সমস্যার কারণে এখন পর্যন্ত গ্রামে তাদের কোন কর্মকান্ড পরিচালিত হয়নি। তবে আগামী বছর থেকে তারা আর্সেনিক মুক্ত পানি সকলেল মাঝে যাতে দেয়া যায় সেই ব্যবস্থা করবেন।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here