বুদ্ধিজীবীষ্টাফ রিপোর্টার :: আজ বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম কালো দিন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরেরা মিলে আজকের এই দিনে দেশকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। এই দায়িত্বশীল দোসর ঘাতক দালালরা হলো আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকার বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় যখন অনিবার্য তখন পাকিস্তানি যুদ্ধবাজ রাও ফরমান আলীর নির্দেশনায় গভীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ঘাতক দল বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে।

 

এই তালিকায় শিক্ষাবিদ ৯৯১ জন, সাংবাদিক ১৩ জন, চিকিৎসক ৪৯ জন এবং আইনজীবী ছিলেন ৪২ জন। তালিকায় উল্লেখযোগ্য নামগুলো হলো : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. মুনির চৌধুরী, ড. আনোয়ার পাশা, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, চিকিৎসক অধ্যাপক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি, ডা. আলিম চৌধুরী, লেখক, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সেলিনা পারভীন,  সিরাজুদ্দীন হোসেন, গীতিকার ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ, রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সমাজসেবক এবং দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা,  শিক্ষাবিদ, আয়ূর্বেদিক চিকিৎসক যোগেশচন্দ্র ঘোষ, লেখক, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান,  কবি মেহেরুন্নেসা, সমাজসেবক, আয়ূর্বেদিক চিকিৎসক নূতন চন্দ্র সিংহসহ আরো অনেকে। শুধু ১৪ ডিসেম্বর নয়, মুক্তযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন সময় এদের হত্যা করা হয়।

 

যুদ্ধে চিকিৎসকদের হত্যা না করার বিধিনিষেধ থাকলেও সেই আন্তর্জাতিক নিয়মের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে এবং জেনেভা কনভেনশন অমান্য করে তারা চিকিৎসকদেরকেও তারা হত্যা করেছিল। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধকালীন উভয় পক্ষের কাছে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী নিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং আক্রমণের শিকার হবেন না । তারা এ ক্ষেত্রেও অপরাধ করেছে এবং ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে  দেশের সূর্য সন্তানদের। প্রকৃতপক্ষে এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিত করতে হত্যাকান্ডের আগে থেকেই তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। তাকে তালিকা প্রস্তুতিতে সহযোগিতা করেছেন এবং হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের পেছনে ছিল মূলত আল-বদর বাহিনী। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ঘাতক ছিলেন বদর বাহিনীর চৌধুরী মঈনুদ্দীন। তিনি ছিলেন অপারেশন ইন-চার্জ। আরেকজন ছিলেন আশরাফুজ্জামান খান। যুদ্ধের পর আশরাফুজ্জামানের ব্যক্তিগত ডায়েরিতে প্রায় ২০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল। তার গাড়ির ড্রাইভারও এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিল। চৌধুরী মঈনুদ্দীন অবজারভার ভবন থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম ঠিকানা রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার বশীর আহমেদকে পৌঁছে দিতেন।

 

বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে একটি কাদালেপা মাইক্রোবাস। বসটি শহরময় ঘুরেছে এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে বুদ্ধিজীবীদের তুলে এনেছে। তুলে আনার সময় ঘাতকরা পরিবারের অন্যদের বলত, স্যারকে একটু নিয়ে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর ফিরিয়ে দিয়ে যাব। কিন্তু কেউ আর ফিরে আসেনি। পরে তাদের পাওয়া যায়  রায়ের বাজার, মিরপুর বা অন্য কোনো বধ্যভূমিতে নিষ্প্রাণ দেহে পড়ে থাকা লাশ হয়ে। ঘাতকরা  বুদ্ধিজীবীদের তুলে এনে প্রথমে রাখত মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজে। তারপর সেখানে তাদের অত্যাচার করা হতো। শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, ছাত্র কেউই ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পাননি। প্রতিদিনই কারো না কারো বাসায় ঢুকে বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে ধরে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হতো অজ্ঞাত স্থানে।

 

যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো নারকীয় নির্যাতনের পর সবাইকেই মেরে ফেলা হতো। ওরা কেউ আর ঘরে ফিরে আসেনি। তাদের যখন নির্যাতন করা হতো, তখন ব্যান্ড বাজানো হতো, যাতে কারো চিৎকার বাইরে থেকে শোনা না যায়। এই নির্যাতন কত নির্মমভাবে করা যায় এ জন্য ঘাতকরা আলোচনায় বসতো, পরিকল্পনা করতো। এই হত্যা কতটা নির্মম শুনলে শিউরে উঠতে হয়। যে বুদ্ধিজীবী হার্ট স্পেশালিস্ট তার হৃৎপিণ্ড উপরে ফেলা হতো। চক্ষু বিশেষজ্ঞের চক্ষু উৎপাটন করা হতো। এ হলো তাদের কর্মকাণ্ডের সামান্য উদাহরণ। দেশ স্বাধীন হলে ঘাতকদের ফেলে যাওয়া ডায়েরি থেকে এমন অনেক তথ্য জানা গেছে। ডায়েরি থেকেই আরো জানা গেছে যে, সিআইএ যুদ্ধকালীন সময়ে এ ধরনের দুজন দক্ষ নীলনক্সাকারী ঘাতক এখানে প্রেরণ করেছিল। তাদের নাম হাইট এবং ডুসপিক। এই দুই ঘাতক ইন্দোনেশিয়ার গণহত্যায়ও নেতৃত্ব দিয়েছিল। সে  দেশের সরকার পরে এদের অনুপস্থিতিতেই তাদের বিচার সম্পন্ন করে।

 

স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেই শোষক পাকিস্তানি হানাদাররা বুঝতে পেরেছিল এ দেশের মানুষগুলোকে আর শাসন-শোষণ করা যাবে না। বাঙালি জেগে উঠেছে। পাকিস্তানি ঘাতকদের পতন অনিবার্য হয়ে উঠছে। এই পরাজয় সহজে মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাঙালিদের এই জাগরণে এ দেশের সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল বাতিঘরের মতো। পাকিস্তানিরা যেহেতু বুঝতে পেরেছিল এ দেশে তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে, তখন তারা মরণ কাঁমড় দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তাদের এই কুৎসিত ইচ্ছায় ইন্ধন যোগায় স্বাধীনতাবিরোধী দালালচক্র।

 

স্বাধীনতাবিরোধীরা দেশের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে  বুঝতে পেরেছিল এতদিন পাকিস্তানি প্রভুদের সঙ্গে মিলে তারা যা করেছে তার সাজাও তাদের পেতে হবে। স্বাধীন বাংলায় তাদের ঠাঁই হবে না। তখন ঘাতক-দালাল চক্রের একটাই উদ্দেশ্য হয়, যেভাবে যতটুকু সম্ভব এ দেশের ক্ষতি করা। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতির যে কোনো বিপর্যয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে সমস্যা সমাধানের পন্থা নির্ধারণ করার যোগ্যতাসম্পন্ন ধীমান ব্যক্তিবর্গ তাদের এই ধ্বংস প্রক্রিয়ার প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হন। এ দেশকে মেধাশূন্য করে পঙ্গু করে ফেলার এক ভয়াবহ নীলনকশার পরিকল্পনা করে তারা। যার ফল হবে এ দেশের মানুষের জন্য মারাত্মক এবং সুদূরপ্রসারী। কোনো জাতির অগ্রসরমানতা বা সার্বিক বিকাশের ধারাকে প্রতিহত করতে এর থেকে মোক্ষম অস্ত্র আর কি হতে পারে?

 

দু’একটি ব্যতিক্রম হয়ত ছিল কিন্তু সেইসব ভাগ্যবানের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো নয়। ঘাতকবাহিনী দেশের  শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করেছিল। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা এখানে তুলে দিচ্ছি :
‘আর একটু এগিয়ে যেতেই বাঁ হাতের যে মাটির ঢিপি ছিল তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা। গামছা দুটো আজও এখানে পড়ে আছে। পরনে কালো ঢাকাই শাড়ি ছিল। এক পায়ে মোজা ছিল। মুখ ও নাকের কোনো আকৃতি নেই। কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে, খামচিয়ে তুলে নিয়েছে যেন চেনা না যায়। মেয়েটি ফর্সা এবং স্বাস্থ্যবতী। স্তনের একটা অংশ কাটা। লাশটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে। বিভৎস চেহারার দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না। তাকে আমি চিনতে পারিনি। পরে অবশ্য সনাক্ত হয়েছে যে, মেয়েটি সেলিনা পারভীন।’

 

আরেকটি বর্ণনায় লেখা হয়েছে : ‘পাশে দুটো লাশ, তার একটির হৃৎপিণ্ড কে যেন ছিঁড়ে নিয়েছে। সেই হৃৎপিণ্ড  ছেঁড়া মানুষটিই হলো ডা. রাব্বী। ডা. রাব্বীর লাশটা তখনও তাজা। জল্লাদ বাহিনী বুকের ভেতর থেকে কলিজাটা তুলে নিয়েছে। তারা জানতো যে তিনি চিকিৎসক ছিলেন। তাই তার হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে ফেলেছে।’ এমনি আরো অজস্র লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়। সেইসব মর্মান্তিক ঘটনা শুনে শিউরে উঠতে হয়। এই ঘাতক দালাল চক্রের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করার মতো উপযুক্ত ভাষা পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। কবি শামসুর রাহমানের কবিতার ভাষায় বলতে হয়- ‘এক ঝাঁক ঝাঝা বুলেট বিদীর্ন করুক এমন সহজ শাস্তি আমি কামনা করি না তাদের জন্য।’

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here