দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৫জেলা এইডস’র জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এক বছরে এইডস-এ আক্রান্ত হয়ে এ অঞ্চলে ১৩জন নারী-পুরুষ মারা গেছে। এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছে ৭২জন। সমুদ্র ও স্থল সীমান্ত অতিক্রম করে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশকারীদের রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা না করা, নিষিদ্ধ পল্লী ও ভাসমান যৌন কর্মীদের নিয়মিত রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় এবং কনডম ব্যবহারে অনীহার  কারণে এ অঞ্চলে এইডস’র ভয়াবহতা বেড়ে যাচ্ছে। এইচআইভি ও এইডস প্রতিরোধে গণসচেতনার জন্য দাতাগোষ্ঠির কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও এইডস রোগীদের চিকিৎসা সেবার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অর্থ বরাদ্দ নেই। সেই সাথে দক্ষিণাঞ্চলে এইডস রোগীদের চিকিৎসার জন্য অভিজ্ঞ কোন ডাক্তার নেই, চিকিৎসা সুবিধাও নেই। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলো হচ্ছে, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল ও যশোর। এ প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে ‘এইচআইভি সংক্রামন ও এইডস মৃত্যু নয় একটিও আর  বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়ব সবাই.. এই আমাদের অঙ্গিকার’ শ্লোগান নিয়ে আজ বিশ্ব এইডস দিবস পালিত হবে। এইডস রোগীদের সেবাদানকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মুক্ত আকাশ বাংলাদেশ’র এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে মধ্যে নভেম্বর পর্যন্ত সময় ৪ জনের মৃত্যু ও ১১জনের শরীরে এইচআইভি জীবানু সনাক্ত করা হয়েছে। এ সংগঠনের স্থানীয় সমন্বয়কারী রেহেনা বেগম জানান, মৃত ও আক্রান্ত ব্যক্তিরা খুলনা, বাগেরহাট ও যশোর জেলার অধিবাসী। মৃতদের মধ্যে ৩জন মহিলা ও ১জন পুরুষ। এইচআইভি জীবানু বহনকারীদের মধ্যে ৯জন মহিলা ও ২জন পুরুষ রয়েছে। তার দেয়া তথ্য মতে, ২০১০সালে এ অঞ্চলের খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় আক্রান্তদের মধ্যে ২০জন পুরুষ, ২৪জন মহিলা ও ৩জন শিশু রয়েছে। সেবাদানকারী সংগঠন আশার আলো সোসাইটির ভিসিটি কাউন্সিলর সাবিনা ইয়াসমিন জানান, দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে চলতি বছর ২৯জন নারী-পুরুষের শরীরে এইচআইভি জীবানু সনাক্ত করা হয়েছে। বছরের শুরু থেকে ১৫নভেম্বর পর্যন্ত ২জন পুরুষ ও  ৪জন নারী মারা গেছে। তার দেয়া তথ্য মতে, নেশাখোর ও যৌনরোগীরা এইচআইভি জীবানু বহন করছে। স্বেচ্চাসেবী সংগঠন জিওন হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রধান পরিচালক সৈয়দ হুমায়ুন রেজা জানান, এইডসে আক্রান্ত হয়ে এ অঞ্চলে এ বছরে ৩জনের মৃত্যু হয়েছে। এ বছর আক্রান্ত হয় ১৫জন মহিলা, ১১জন পুরুষ ও ৬জন শিশু। যশোরের শার্শা ও নড়াইলে কালিয়া উপজেলায় আক্রান্তদের সংখ্যা বেশি। তিনি জানান, অ্যাকশান এইড, ইউনিসেফ, ইউএসএইড, কেয়ার, গ্লোবাল ফান্ড, এফএইচআই ও সেভ দ্যা চিল্ডেন ফান্ড এ ব্যাপারে গণসচেতনার জন্য কোটি কোটি টাকা অর্থ ব্যয় করলেও আক্রান্ত রোগীদের জন্য এ সব দাতা সংস্থার একটি টাকাও বরাদ্দ নেই। বিশেষজ্ঞদের বেতন ও গোল টেবিল বৈঠকে বরাদ্দ সম্পূর্ণ ব্যয় হয়। তিনি বলেন, খুলনাঞ্চলে এইডস রোগী চিকিৎসার জন্য চিকিৎসা সুবিধা যেমন নেই, তেমনি অভিজ্ঞ চিকিৎসকও নেই। এইচআইভি বহনকারীরা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের ঢাকায় পাঠানো হয়। স্থানীয় সরকারি হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসা সুবিধা নেই। ওয়ার্ল্ড ভিশনের প্রজেক্ট অফিসার মার্কুস সিলভানো সরকার জানান, এইচআইভি আক্রান্ত রোগীদের পুষ্টিকর খাবার ও চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া এইচআইভি প্রতিরোধে ২৩হাজার মাদকাসক্ত, পরিবহন শ্রমিক, ভাসমান পতিতা, কলেজ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সমিতির সদস্যেদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। মহানগরীর ৩৬০জন ভাসমান পতিতাকে যৌন রোগ নিরাময়ে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ দেয়া হচ্ছে। খুলনার সিভিল সার্জন কার্যালয় রেকর্ড অনুযায়ী, ২০০৯সাল পর্যন্ত খুলনাঞ্চলে ৩৯জন পুরুষের এবং ৪৫জন মহিলার শরীরে এইচআইভি সনাক্ত করা হয়েছে। গেল বছর বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন সিভিল সার্জন ডাঃ আব্দুল হান্নান উল্লেখ করেন, ২০০১সাল থেকে এ পর্যন্ত এইডসে আক্রান্ত হয়ে ১৯জন মারা গেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুলনাঞ্চল এইডস সংক্রামনের জন্য বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এ অঞ্চলের এইডসের বিস্তার প্রসঙ্গে বর্তমান সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ গোলাম মোর্তুজা শিকদার বলেন, ভাসমান যৌন কর্মী, নিষিদ্ধ পল্লীর যৌন কর্মী, মাদকসেবী, হিজরা, সমকামীদের কারণে এ অঞ্চল ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহিৃত হয়েছে। মাদকাসক্তারা প্যাথেডিন গ্রহণের সময় একই ইনজেকশনের সিরিঞ্জ একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করায় এইচআইভিতে আক্রান্ত হচ্ছে। ভারতের ট্রাক চালকরাও যৌন কর্মীদের ব্যবহারের কারণেও এইচআইভি ছড়াচ্ছে। সীমান্ত এলাকায় অবস্থানের কারণে খুলনাঞ্চল এইডসের জন্য বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ। চিকিৎসা সুবিধাদি কম বলে তিনি উল্লেখ করেন। স্বেচ্চাসেবী সংগঠনের অপর একটি সূত্র জানান, ২০০৫ সালে পীর খানজাহান আলী (রহঃ) সেতু নির্মাণের সময় থাই শ্রমিকরা মাছ কোম্পানীর মহিলা কর্মীদের সাথে অবাধ মেলামেশার পরে কয়েক জনের শরীরে এইচআইভি চিহ্নিত হয়। পরে থাই শ্রমিকদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়। ওয়াল্ড ভিশন বাংলাদেশের একটি সূত্র জানান, ভারতের ৫১লাখ ব্যক্তি এইচআইভি জীবানু বহন করছে। ভারত থেকে প্রতিদিন ১হাজার ট্রাক বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে আসা যাওয়া করে। এই ট্রাক ড্রাইভারদের একটা অংশ এইচআইভি জীবানু বহন করে। ওয়াল্ড ভিশনের এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, এ অঞ্চলের নিষিদ্ধ পল্লীতে যৌন কর্মীদের নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করা হয় না। অবৈধ যৌনচারে লিপ্তদের মধ্যে ২৫শতাংশের বেশি কনডম ব্যবহার করতে আগ্রহ দেখায় না। তাছাড়া সীমান্ত অতিক্রম করে আসা ট্রাক চালকদের রক্ত পরীক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। ট্রাক চালকরা অবসর মূহুর্তে পতিতা পল্লীতে যৌন কর্মীদের শয্যাসঙ্গী হয়। দেশের সীমন্তবতী এলাকাগুলো সম্পর্কে অপর এক গণমাধ্যমে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নারীদের মধ্যে এইডস বিস্তারের ভয়াবহতা সৃষ্টি হয়েছে। সীমান্তবতী এলাকায় ভাসমান যৌন কর্মীদের সঙ্গে রয়েছে অপেশাদার যৌন কর্মীও। বিভিন্ন নারী সংগঠনের সভা সমিতিতে উল্লেখ করা হয়, এই অঞ্চল এইডস বিস্তারের একটি ক্ষেত্র যেমন পরিণত হয়েছে তেমনি নারীদের ফেলে দিচ্ছে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানকার পেশাদার যৌন কর্মীদের সঙ্গে মিলনের ক্ষেত্রে খুব কম পুরুষরা কনডম ব্যবহার করে। ফলশ্রুতিতে পতিতা ঝুঁকিপূর্ণ এবং এইডস মহামারীর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর এ সংক্রামনের প্রধান শিকার হচ্ছে নারীরা। উল্লেখ করা যেতে পারে, খুলনাঞ্চলে ৪০টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এইচআভি এইডস প্রতিরোধে কার্যক্রম চালাচ্ছে।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/শিমুল খান/খুলনা

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here