আজ পহেলা আষাঢ়ষ্টাফ রিপোর্টার :: কাব্যময় ‘বাদল দিনের প্রথম’ ও ‘আষাঢ়স্য’ কদম ফুল ফুটেছে আরও আগেই, অগ্রদূত হিসেবে। কালো মেঘে আকাশ ঢেকে যায়, সাথে গুড়্ গুড়্ ডাক। ভয়ঙ্কর শব্দে কে যেন গো ডমরু বাজায়। আষাঢ়ের শাশ্বত বিশিষ্টতা এমনটিই। তবে জলবায়ু পরিবর্তনে এতে ছন্দপতন অস্বাভাবিক নয়। অবিরাম বর্ষণে বিজলী চমকাক বা না-ই চমকাক, আজ সোমবার পহেলা আষাঢ়। বাংলা প্রকৃতির আরেক ঐশ্বর্য বর্ষা ঋতুর পঞ্জিকীয় অভিষেক দিবস।
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের নিদাঘ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আকুতি ক্লিষ্ট প্রাণের। ফাল্গুনে ফুলের বনে যে উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল তা এই বর্ষাতে ষোলকলা পূর্ণ করবে বুঝি! গ্রীষ্মের তাপদাহকে ম্লান করে দিতে অঝোর বৃষ্টিধারায় মহাআয়োজনের মাধ্যমেই প্রকৃতিতে বাংলা পঞ্জিকার দ্বিতীয় ঋতুটির আগমন ঘটেছে। আষাঢ়ের আরেক সহোদরা শ্রাবণ আসবে আরও এক মাস পর।
লু-হাওয়া আর খাঁ-খাঁ রোদকে সামাল দেয়ার যত প্রস্তুতি নিতে থাকবে আষাঢ় নিজেই। শুষ্ক-রুক্ষ, তাপদাহে নাকাল প্রকৃতি আকাশের কান্নার শীতল পানিতে সবুজ সতেজ হয়ে উঠবে। প্রতিটি বৃষ্টির ফোটায় তরুলতা পাবে সজীব হয়ে ওঠার নির্ভেজাল উদ্দীপনা। ভিন্নমাত্রিক আষাঢ় মাসের নামকরণও হয়েছে তারার নামে। অন্যান্য মাসের নামকরণে যেমনটি ঘটেছে। সে তারার নাম ‘আষাঢ়া’। অর্থে পানি তার বৈভব।
সুবিন্যস্ত সাদা-হলুদ মঞ্জুরীর গোলাকার কদম ফুলসহ এই সময়ের নিসর্গ ঋদ্ধতা প্রতিটি প্রকৃতি-প্রেমিক মনকেই আলোড়িত করে। শিল্পীর বেলায় তো এর আবেদন আরও বেশি হয়। এ সময়ে আরও ফোটে শাপলা, পদ্ম, চালতা, কেতকী ফুল। বাজার জুড়ে মওসুমী ফলের সমারোহ। ফলের রাজা আম ও জাতীয় ফল কাঁঠালসহ নানা নাম ও স্বাদের ফলে রসনা তৃপ্ত করছে নাগরিকরা। শহর ও গ্রাম সর্বত্র বৈষম্যের দেয়াল ভেঙ্গে দিয়েছে বিধাতার সৃষ্টি ফলের মেলা।
ল্যাংড়া, হিমসাগর, চোষা, আম্রপালি জাতের আমের চাহিদা ব্যাপক। আরও পাওয়া যাচ্ছে লিচু, আনারস, জাম, লটকন, কামরাঙ্গা, কাউ, করমচা, ডেউয়া ইত্যাদি ফল। বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও ফড়িয়া-ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফা লাভের মনোবৃত্তির কারণে এসব চিরচেনা ফলও সাধারণের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে।
আষাঢ়ের আরেক পরিচয় উৎসবের দেশে উৎসবের মাস। বিশেষ করে ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ পালনকারীদের কাছে বড়ই আরাধ্য এ মাস। কেননা এ মাসে ‘রথযাত্রা’ উৎসব হয়। হিন্দু শাস্ত্রীয় মতে, পূরীর জগন্নাথের স্মরণে এই উৎসব। একটি রথে জগন্নাথ, তার ভাই বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে বসিয়ে উপাসকরা সোল্লাসে কোন নদী তীরে টেনে নিয়ে যায় এবং গোসল (স্নান) করিয়ে ফিরিয়ে আনে। এই প্রত্যাবর্তনই ‘উল্টো রথযাত্রা’ নামে পরিচিত। এ উপলক্ষে বসে মেলা।
আষাঢ় মাস তথা বর্ষা ঋতু সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান উপাদান। ‘কবি শেখর’ কালিদাস বর্ষা ঋতুকে নিয়ে অন্যূনপক্ষে ত্রিশটি কাব্য লিখেছেন। ‘ছন্দের জাদুকর’ খ্যাত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বর্ষা বিষয়ক কবিতাগুলো হলো-‘বর্ষা’, ‘ইলে্শে গুড়ি’ ও ‘বর্ষা নিমন্ত্রণ’। নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষাপ্রীতি তো রীতিমতো প্রবাদতুল্য। এছাড়া আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা প্রমুখ কবিগণ বর্ষাকে তাদের সাহিত্যকর্মে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। চিত্রশিল্পীরাও বর্ষাকে ক্যানভাসে অাঁকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পটুয়া কামরুল হাসানের ‘বৃষ্টির দিনে খেয়াঘাট’ শীর্ষক চিত্রকর্মটি আজও অনন্য হিসেবে স্বীকৃত।
বর্ষা উপকারী না-কি অপকারী এ নিয়ে অমীমাংসিত বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। সজল বর্ষা প্রকৃতিতে ফুরফুরে আমেজ আনলেও নদীগুলোতে পানি প্রবাহ বেড়ে গিয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে। এখন সিলেট অঞ্চলে যেমনটি হচ্ছে। তবে সর্বজনবিদিত যে, পানির সাথে পলি বয়ে এনে ‘উর্বরা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে বর্ষা ঋতু প্রণিধানযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here