ডেস্ক নিউজ :: মারের বদলে মারের হুঙ্কার। সমালোচনার মুখে মধ্যস্থতার সুর।
একদিকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একযোগে যুদ্ধের ডাক। অন্য দিকে, সিরিয়ায় সংঘর্ষ-বিরতির সিদ্ধান্তে ওবামা-পুতিন ঐকমত্য। এটা বুঝেই যে প্যারিস হামলার পর আইএস কাঠগড়ায় তুলতে শুরু করেছে সিরিয়ায় পশ্চিমি দেশগুলোর একপেশে হানাদারিকে। রোববার তুরস্কের রাজধানীআঙ্কারয় জি-২০ বৈঠকের দ্বিমুখী সারমর্ম এটাই।
সংহতির শপথ শনিবারই ছিল৷ রোববার তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় জি-২০ বৈঠক থেকে আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণারই বার্তা দিল বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ২০টি অর্থনীতি৷ আর পাশাপাশি, ইউরোপে আসা সিরীয় শরণার্থীদের ভবিষ্যত্ নিয়েও শুরু হয়ে গেল টানাপোড়েন৷
অর্থনীতি এবং উন্নয়ন নয়, প্যারিস-আতঙ্কের ছায়ায় এ বারের জি-২০ বৈঠকে সন্ত্রাস এবং তার মোকাবিলাই হয়ে উঠল আলোচনার মুখ্য বিষয়বস্ত্ত৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা থেকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, সকলেই ফ্রান্সের পাশে দাঁড়ানোর এবং একজোট হয়ে সন্ত্রাসের মোকাবিলার কথাই বলেন৷ মোদি বলেন, ‘আজ আমরা সন্ত্রাসের ভয়াবহ হানার প্রেক্ষিতে এই বৈঠকে মিলিত হচ্ছি৷
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই এখন ডি-২০ গোষ্ঠীর অগ্রাধিকার হওয়া উচিত৷’ মার্কিন প্রেসিডেন্টও বলেন, ফ্রান্সের উপর জঙ্গি হানায় ‘আকাশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে৷’ ফ্রান্সের পাশে দাঁড়ানো এবং জঙ্গিদমনে তাদের সাহায্য করার কথাও বলেন তিনি৷ তবে ঠিক কী ভাবে আমেরিকা ফ্রান্সকে সাহায্য করবে, তা স্পষ্ট করেননি ওবামা৷
প্রসঙ্গত, ১১ অক্টোবর মার্কিন টিভি চ্যানেল সিবিএস নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট জানিয়ে দেন, আইএস জঙ্গিদের দমন করার জন্য পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে বিপুল পরিমাণে সেনাবাহিনী পাঠাবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ তিনি বলেন, ‘সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া বা ইয়েমেনে এক বা দু’লক্ষ মার্কিন সেনাবাহিনী পাঠিয়ে ওই দেশগুলিতে পুলিশি নজরদারির পাশাপাশি ব-কলমে দেশ শাসনের পরামর্শ যাঁরা দিতে চাইছেন তাদের উদ্দেশে বলি, এই কৌশল ঠিক নয়…আমরা যদি আগের ভুলেরই (ইরাক, মিশর, আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে) পুনরাবৃত্তি করি, তা হলে আমাদের ধিক্৷’
ফ্রান্সের ঘটনার পর সেই অবস্থান থেকে তিনি সরছেন, এমন কোনো ইঙ্গিত অন্তত এ দিনের বক্তব্যে ছিল না৷ বরং সিরিয়ায় শান্তি প্রক্রিয়ায় আমেরিকা ইতিবাচক ভূমিকা নিতে চায় বলেই বার্তা দিয়েছেন তিনি৷ জি-২০ মূল বৈঠকের পাশাপাশি রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও হয়েছে এ দিন৷ আর সেখানেও স্বাভাবিক ভাবেই কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সন্ত্রাস৷ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে রাষ্ট্রপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে শান্তি আলোচনা চালানো এবং সিরিয়ায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার বিষয়ে ওবামা একমত হয়েছেন বলে সংবাদসংস্থা এএফপি-কে জানিয়েছেন এক মার্কিন কর্মকর্তা৷
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রাসেপ তাইপের সঙ্গে সাক্ষাতের পরেও ওবামা বলেন, ‘বিকৃত মতাদর্শের ভিত্তিতে নিরীহ মানুষের হত্যা শুধু ফ্রান্স বা তুরস্কের উপর আক্রমণ নয়, বরং সভ্য জগতের উপর আক্রমণ৷’ ‘প্রে ফর প্যারিস’-এর পরে নানা মহলে এই প্রশ্নটি জোরদার হয়েছে যে, সন্ত্রাসদীর্ণ আঙ্কারা বা বেইরুটের কথা কেন কোনো রাষ্ট্রপ্রধান তুলছেন না৷ এ দিন কিন্ত্ত ওবামা সে প্রসঙ্গ ছুঁয়ে গিয়েছেন৷
তার আগে আরও স্পষ্ট ভাবে সব ধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ার কথা শোনা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদীর মুখে, ব্রিকস-এর বৈঠকে৷ সেখানে তিনি বলেন, ‘প্যারিসে সন্ত্রাসহানার নিন্দায় আমরা ঐক্যবদ্ধ৷ সিনাইয়ে জীবনহানির জন্য রাশিয়ার প্রতি আমরা গভীরতম সমবেদনা জানাই৷ আঙ্কারা এবং বেইরুটও সন্ত্রাসের প্রসার ও প্রভাবের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে৷ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সমগ্র মানবতার এক হয়ে দাঁড়ানো উচিত৷ বিশ্ব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়াইটা এর আগে কখনও এত জরুরি হয়ে ওঠেনি৷ ব্রিকস-এর দেশগুলির কাছেও অবশ্যই এটা অগ্রাধিকার পাবে৷’
তবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যখন আনাতোলিয়ায় এই আন্তর্জাতিক শপথ উচ্চারিত হচ্ছে, তার কয়েক ঘণ্টা আগেই ৭০০ কিলোমিটার দূরের গাজিয়ান্তেপে এ দিনও পুলিশকে লক্ষ করে গুলি চালায় এক আত্মঘাতী জঙ্গি৷ শেষ পর্যন্ত নিজেকে উড়িয়ে দেয় সে৷ গত ১০ অক্টোবর আঙ্কারায় জোড়া বিস্ফোরণের তদন্তে পুলিশ সিরিয়া সীমান্তের কাছাকাছি গাজিয়ান্তেপ এলাকার একটি বহুতলে তল্লাশি চালাতে গিয়েছিল পুলিশ৷
বাড়িটির পাঁচতলা থেকে তাদের লক্ষ করে গুলি চালায় এক জঙ্গি৷ আহত হন পাঁচ জন পুলিশকর্মী৷ পরে ওই জঙ্গি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দেয়৷ প্রসঙ্গত, এই ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগেই তুরস্কের সেনার সঙ্গে আইএস জঙ্গিদের সংঘর্ষ হয়েছে৷ একটি মিলিটারি চেকপয়েন্টে হামলা চালানোর চেষ্টা করে চার জঙ্গির একটি দল৷ সেনার সঙ্গে সংঘর্ষে সকলেরই মৃত্যু হয়৷ এ দিনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিও আইএস-এর সদস্য বলেই অনুমান৷ এই ঘটনার পর জি-২০ বৈঠক ঘিরে নিরাপত্তা আরও আঁটোসাঁটো করা হয়৷ আনাতোলিয়া থেকে অন্তত সাত জন সন্দেহভাজনকে আটক করে সেনা৷
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই আন্তর্জাতিক এই শীর্ষ বৈঠকে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে শরণার্থী সমস্যাও৷ পশ্চিম এশিয়া থেকে শরণার্থীদের স্রোত নিয়ে এমনিতেই কিছুটা দিশাহারা বোধ করছে ইউরোপ৷ যে সব দেশ শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে, তারাও এই অবস্থান কতদিন বজায় রাখাটা নিজেদের অর্থনৈতিক ভারসাম্যের জন্য ক্ষতিকারক হবে না, তা নিয়ে চিন্তিত৷ এর মধ্যে প্যারিস হামলার পর একটা দ্বিধাও তৈরি হতে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে৷ এই পরিপ্রেক্ষিতে জার্মানির চ্যান্সেলর মার্কেল আলাদা করে সতর্ক করে বলেছেন, যদিও তার দেশের অনেক এমপি জার্মান সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবলেও তিনি মনে করেন, জার্মানি এই পদক্ষেপ করলে বলকান রাষ্ট্রগুলিতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে৷
পরিস্থিতি যে রকম দাঁড়িয়েছে, তাতে জি-২০ বৈঠকের পর অ্যাপেক-এর সম্মেলনেও সন্ত্রাস ও শরণার্থী সমস্যা জায়গা করে নেবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল৷ এ সপ্তাহেই বুধ ও বৃহস্পতিবার দু’দিনের এশিয়া-প্যাসিফিক ইকনমিক কো-অপারেশন-এর (অ্যাপেক) বার্ষিক সম্মেলন হচ্ছে ম্যানিলা শহরে৷ প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী ২১টি দেশের এই সম্মেলনেও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিষয়গুলি আলোচ্য হিসেবে দ্বিতীয় সারিতে চলে যাবে বলে মনে করছেন তারা৷
বিশেষ করে, দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের আগ্রাসন নিয়ে মুখ খুলতে পারেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷ ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই এবং তাইওয়ানের সঙ্গে ইতিমধ্যেই চিনের গোল বেধেছে দক্ষিণ চিন সাগরের দখলদারি নিয়ে৷ প্যারিসে আইসিস জঙ্গী হানার পর, সন্ত্রাস দমনে অ্যাপেক দেশগুলি কী ভূমিকা পালন করবে তা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি অ্যাপেক দেশগুলির মধ্যে আঞ্চলিক সৌহার্দ্য এবং সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা নিয়েও আলোচনা হবে৷