ffffff_134048নিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশ ও বিদেশের অনেকেই প্রত্যাশা করছেন, বাংলাদেশ সরকার দেশটিতে সংঘটিত সন্ত্রাসবাদের অস্তিত্ব অস্বীকারের দীর্ঘদিনের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসবে।

একই সঙ্গে দেশের কিছু মানুষের মধ্যে সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকলেও সরকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পূর্ণোদ্যমে লড়াই শুরু করবে।

শুক্রবারের সন্ত্রাসী হামলা নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করা বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ভিত্তিভূমিতেই আঘাত করেছে। টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এসব কথা।

ঢাকা থেকে প্রতিবেদনটি লিখেছেন দেবদ্বীপ পুরোহিত। তিনি লিখেছেন, এ বছর প্রায় ১৫টির মতো ইফতার মাহফিল আয়োজন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এর প্রতিটিতেই উপস্থিত ছিলেন সহস্রাধিক অতিথি। তার শাসনামলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হয়েছে, রপ্তানি আয় ছাড়িয়েছে আমদানি ব্যয়কে এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ পৌঁছেছে রেকর্ড পরিমাণে। বিএনপি ও জামায়াতের বিরোধীদলীয় জোট অনেকটাই ছত্রভঙ্গ। এমন পরিস্থিতিতে স্বল্প সময়ের জন্য বাংলাদেশ সফরে গেলে এটা মনে হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের গদিতে শক্তভাবেই আসীন রয়েছেন।

কিন্তু ২০ জনের প্রাণহানির কারণ হওয়া ঢাকার কূটনৈতিক পাড়ায় সন্ত্রাসী হামলা তাকে এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। ওই হামলার পর শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা এর আগে বাংলাদেশে কখনও ঘটেনি। এর আগে তারা একজন বা দুজনকে হত্যা করেছে।’ আর এর আগে সরকারও বারবারই বাংলাদেশে সংগঠিত জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু এই ঘটনার পর এখন বাংলাদেশি ও বিদেশিদের অনেকেই আশা করছেন, সরকার সেই অস্বীকারের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পূর্ণোদ্যমে লড়াই শুরু করবে। তাতে কিছু মহলের কাছে সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকলেও সরকার পিছপা হবে না।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক বলেন, ‘সন্দেহ নেই, তার (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সামনে আসা সবচেয়ে শক্ত চ্যালেঞ্জের মধ্যে এটি একটি। তবে আমরা আত্মবিশ্বাসী যে তিনি এটাও সামাল দিতে পারবেন।’

শুক্রবারের সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের মধ্যে নয়জন ছিলেন ইতালিয়ান নাগরিক। বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি গার্মেন্ট খাতের সঙ্গে তাদের প্রত্যেকেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আরো ছিলেন কয়েকজন জাপানি নাগরিক। বাংলাদেশের কাছে দাতাদেশগুলোর তালিকায় শুরুর দিকেই রয়েছে জাপান। এছাড়া বিদেশে পড়ালেখা করছেন এমন কিছু তরুণ-তরুণীও ছিলেন।

জানা গেছে, ধর্মীয় আয়াত পাঠ করার একটি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাদের হত্যার জন্য বাছাই করা হয় এবং তাদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস। ‘এশিয়া তলাবিহীন ঝুড়ি’ বা ‘বাস্কেট কেস’- এমন নানা অভিধার বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়াই করে এসেছে বাংলাদেশ। শুক্রবারের হামলা দেশটির সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ভিত্তিভূমির ওপরই একটি আঘাত হয়ে এসেছে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করা বাংলাদেশে অবশ্য হত্যা বা গণহত্যা নতুন কিছু নয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম রূপকার শেখ মুজিবুর রহমানকে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এক অভ্যুত্থানে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালে। গত দুই বছরেও ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা কমপক্ষে ৪৬ জন ধর্মনিরপেক্ষ বা নাস্তিক ব্লগার, বিদেশি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে হত্যা করেছে। কিন্তু শুক্রবারের হামলা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের।

পশ্চিমা কূটনৈতিক মিশনে কর্মরত একজন বাংলাদেশি বলেন, ‘শুক্রবার যা হয়েছে তা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। নিউ ইয়র্ক বা লন্ডনের মতো শহরগুলো সংগঠিত সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে। ঢাকাও এখন সেসব আন্তর্জাতিক শহরের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে।’ এই ‘সংগঠিত সন্ত্রাস’ শব্দগুচ্ছ উদার বাংলাদেশিদের কাছে আশঙ্কার কারণ। দেশের উচ্চশিক্ষিতদের জীবিকা যখন বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল, তখন এই ধরনের হামলার পরিণাম ভয়াবহ বলেই দেখতে পান তারা। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বহুজাতিক গার্মেন্ট পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানির কারখানা রয়েছে। পোশাক খাতের রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে চীনের পরেই অবস্থান বাংলাদেশের। দেশের বিদেশি রিজার্ভের আরেকটি মূল উৎস হলো বিদেশ থেকে পাঠানো অভিবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্থ।

সাম্প্রতিক সময়ের সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলোর জের ধরে বাংলাদেশে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে এখন পর্যন্ত সরকার ও সরকার সমর্থিতরা এগুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। এগুলো দেশে গজিয়ে ওঠা বিরোধী দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কর্মকাণ্ড বলে জানানো হয়েছে। কিছু কিছু হামলার দায় আইএস স্বীকার করলেও উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থাকার নীতিই গ্রহণ করা হয়েছে।

সরকারপন্থি শিক্ষক ও সংঘর্ষ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবারে বলছেন, ‘শুক্রবারের হামলার পর ‘সন্ত্রাসীরা দেশে গজিয়ে ওঠা না বিদেশি’ সেই তর্ক অর্থহীন। আমাদের অগ্রণী হয়ে এদের ধ্বংস করতে হবে।’ ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি বিশ্লেষক আলী রিয়াজ নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘স্থানীয় জঙ্গি দলগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী দলগুলোর সম্পর্ক অব্যাহতভাবে অস্বীকারের প্রবণতা সহায়ক হয়নি। এখন আমরা যা প্রত্যক্ষ করছি তা ছোট দলের কার্যক্রম হতে পারে না। এটা স্পষ্ট যে, অত্যন্ত সমন্বিত একটি হামলা এটি। এটাও যদি তাদের অস্বীকারের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আনতে সক্ষম না হয় তাহলে আমি জানি না ঠিক কী ঘটলে তারা এটা স্বীকার করবেন।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করে আসছেন। কিন্তু অনেকেই যে প্রশ্নটি করছেন তা হলো তিনি কি এই হুমকির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে পারবেন? আওয়ামী লীগের ভিতরের একজন বলেন, ‘বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই। এতে বিএনপি ও জামায়াতের অনেকেই আমাদের সংগঠনে অনুপ্রবেশ করেছে এবং বড় বড় পদ দখল করেছে। তাছাড়া আমাদের দেশটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ। কাজেই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অনেক বেশি শক্ত পদক্ষেপের নেতিবাচক ফলাফলও আসতে পারে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য আজ স্বীকার করে নিয়েছেন যে, দেশের উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি ‘জঙ্গি ও সহিংস উগ্রপন্থিদের দেশ থেকে নির্মূল করতে সবকিছু করার’ প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করেছেন। টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর ইচ্ছায় সন্ত্রাসীদের নির্মূল করে আমরা বাংলাদেশকে একটি শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবো। আসুন, একসঙ্গে কাজ করি। আমাদের সবার মতপার্থক্য পেছনে রেখে নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে কাজ করি।’ কিছু কিছু সমালোচক সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের প্রতি নমনীয় অবস্থান গ্রহণের অভিযোগ করেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের দাবি করা মাওলানাদের সংগঠন আওয়ামী ওলামা লীগ যেভাবে মৌলবাদী এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে তা আওয়ামী লীগ নেতাদেরও বিব্রত করেছে।

ঢাকায় সন্ত্রাসী হামলায় জিম্মিদের উদ্ধারে সরকারি বাহিনীর কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করায় শেখ হাসিনা কিছু বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলের সমালোচনাও করেছেন।

তিনি তাদের লাইসেন্স বাতিলের হুমকিও দিয়েছেন। স্থানীয় একটি সংবাদপত্র তাকে উদ্ধৃত করেছে, ‘তারা কি এটা ভাবে না সন্ত্রাসীরা এটা দেখছে এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের কৌশল সাজাচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্রে যখন মানুষদের মেরে ফেলা হলো, সিএনএন বা বিবিসি কেউই এমন কিছু দেখায়নি যা কার্যক্রমকে ব্যাহত করে। কিন্তু আমাদের দেশে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে। কিছু টিভি চ্যানেল কিছুই শুনতে চায় না। আমি লাইসেন্স দিতে পারি, আমি সেটা নিয়েও নিতে পারি। এটা ছেলেখেলা নয়।’

সূত্র: টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here