অরিত্রিরা আত্মহনন

শৌল বৈরাগী :: অরিত্রিরা যখন আত্মহনন করে তখন জাতি হিসেব আজ আমাদের লজ্জা লুকানোর আর কোন জায়গা জায়গা থাকল না। আর কোন অস্বাভাবিক ঘটনা না ঘটলেও জাতির বিবেক জাগ্রত হয় না। স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়েরা যায় মানুষ হতে আর ফিরে আসে লাশ হয়ে। আর তখনই চারিদিকে হইচই শুরু হয়্। হয় আন্দোলন, বেরিয়ে আসে নানা অনিয়ম।

অথচ এটা যে শুধু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় তা অনেকেই অকপটে স্বীকার করেছে। মনে পড়ে আজ থেকে তিন থেকে চার মাস আগে যখন জাবালেনূর গাড়ীর চাপায় দু’জন ছাত্র প্রাণ হারালে তখনই জাতি স্বোচ্চার হলো যে নিরাপদ সড়ক চাই। কত আন্দোলন, কত প্রতিবাদ, সড়কে কত পাহাড়া, কত ছাত্র-ছাত্রী নিজে দায়িত্ব নিয়ে ট্রাফিক পুলিশের কাজ করেছে। লাইসেন্সবিহীন গাড়ী আটক বা বন্ধ করে দিয়েছে। এ থেকে রেহাই পায় নাই পুলিশ, ব্যবসায়ী এমনকি মন্ত্রী পর্যন্ত। সকলকেই খেসারত দিতে হয়েছে। পুলিশ সার্জনদের এবং পাবলিক গাড়ীর ড্রাইভারদেরই বেশী ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।

ঘটনা অতি দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন বিআরটিএ অফিসে লাইসেন্স করার হার বেড়ে যায় কয়েকগুন। সাথে বেড়িয়ে আসে নানা মহলের অনিয়ম। যেমন লাইসেন্স করতে গেলে ঘুষ লাগে, দালালদের খপ্পরে পড়তে হয়, বিআরটিএ’র লোকজন নিজেরাই দূর্নীতির সাথে জড়িত, পুলিশ নিজেরাই টাকা নিয়ে ফিটনেসবিহীন গাড়ী রাস্তায় চলতে সহায়তা করে, দু’নম্বর লাইসেন্স দিয়ে গাড়ী চালায় বা হেলপার দিয়ে গাড়ী চালায় এসব বিষয় জনসম্মুখে উঠে আসে।

কিন্তু বিষয়টিতো কোনভাবেই নতুন কিছুই ছিল না। বিভিন্ন সময়ে এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে, টকশোগুলেতে আলোচনা হয়েছে এবং পত্র-পত্রিকায়ও রিপোর্টা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন, গাড়ীর মালিক, বিআরটিএ নিজে এসব বিষয় তখন থোড়াই গুরুত্ব দিয়েছে। আর যখন ২ জন ছাত্রকে ঐসব অনিয়মের কাছে জীবন দিতে হলো ঠিক তখনই বিষয়টা সবার মুখে মুখে আলোচনায় এলো, সবাই সোচ্চার হলো, আন্দোলন করতে গিয়ে মার খেতে হলো ছাত্র-ছাত্রীদের। তাই বলা যায় যে কোন অস্বাভাবিক মৃত্যু অর্থাৎ চরম মূল্য ছাড়া জাতির বিবেক ও নিয়ম জাগ্রত হয় না।

যদিও সে আন্দোলনের ফল মাত্র কয়েকদিন মাত্র জাতি ভোগ করতে পেরেছে। সবাই ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলেছে, গাড়ী-রিক্সা-মোটর সাইকেল সারিদ্ধভাবে এবং নিয়ম মেনে চলেছে। কিন্তু গত চার মাসের মধ্যেই সব আবার আগের মত। ফিটনেসবিহীন গাড়ী রাস্তায় চলছে, হেলপার দিয়ে গাড়ী চালাচ্ছে, লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভার সবই আছে। কেউ এখন আর দেখার নাই। আমরা এই ৪ মাসেই সব ভুলে গেছি। আবার হয়তো কোন ছাত্র-ছাত্রীর প্রাণের বিনিময়ে (চাই না) কয়েকদিনের জন্য জাতি জেগে উঠবে এবং আবার ঘুমিয়ে পড়বে।

যাহোক অরিত্রির আত্ম-হননের মাধ্যমে গত কয়েকদিনে জাতির সামনে বেশ কিছু ঘটনা উন্মোচিত হয়ে গেল। অবশ্য ঠিক এখনই যে উন্মোচিত হলো তা বলা যাবে না। বিষয়গুলো সবাই জানত কিন্তু সাহস করে কেউ কিছু বলত না। কারন যদি তার মেয়েকে টিসি দিয়ে দেয় বা পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয় বা অন্য কোন মানসিক অত্যাচার করে। তাই এমন ঘটনা আগে ঘটলেও (ঘটেছে যে তা কিন্তু অনেক গার্ডিয়ান তদন্ত কমিটি বা মিডিয়া বা নিজেদের মধ্যে স্বীকার করেছে। এমন ঘটনা আগে বহু জনের ক্ষেত্রে ঘটেছে।

কিন্তু ঐ মেয়েগুলো বা গার্ডিয়ানরা হয়তো মানসিকভাবে শক্ত ছিল বলে কেউ অরিত্রির মত আত্ম-হননের পথ বেছে নেয় নাই। তাই ঘটনাও প্রকাশ পায় নাই। আমার যতদূর মনে পড়ে ২/৩ বছর আগেও ঐ নাম করা স্কুলের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কিছু একটা বড় ধরণের অভিযোগ উঠেছিল এবং তার পদত্যাগের দাবী উঠেছিল। এগুলো তখন পত্র পত্রিকায় উঠেছিল। কিন্তু তিনি কোন এক অজানা রহস্যে সেবার পার পেয়ে গেছেন – যতদূর জানা যায় শুধু ক্ষমতার জোরে। আরো অভিযোগ উঠেছে যে ভর্তির সময় নাকি ১০ লাখ পর্যন্ত টাকা তারা নিয়ে থাকেন।

প্রতিষ্ঠানটি যেহেতু নাম করা তাই শত অত্যাচার মুখ বুঝেই সবাই হজম করে নিয়েছে শুধু মাত্র তাদের মেয়েদের কথা চিন্তা করে। অভিযুক্ত ছাত্রীর (?) পিতা প্রিন্সিপালের রুমে গেলে তাকে কোন রকম একটা ময়লা চেয়ারে বসতে দেয়, তার মা অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও তাকে ভদ্রতার নিম্নতম মাত্রা বজায় রেখে বসতে বলা হয় নি এবং অসম্ভব রকম খারাপ ব্যবহার করেছেন। এটা কি শুধু নাম করা প্রতিষ্ঠান বলেই সম্ভব। কারন তারা মনে করে তারা্ একটি ব্রান্ড হয়ে গেছে। এখন তাদের ছাত্রীর অভাব হবে না এবং অভিভাবকদের সাথে যা খুশী তাই ব্যবহার করা যাবে। আমার ধারণা এসব ঘটনা সবাই জানতেন কিন্তু কেউ-ই এগুলো রোধে কোন পদক্ষেপ নেয় নি যার ফলে এ অত্যাচার আর অনিয়মের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছিল।আর প্রাণ দিতে হলো একটি মেয়েকে।

আর এ যন্ত্রণা সারা জীবন তার বাবা-মাকে ও ছোট বোনকে বয়ে বেড়াতে হবে। এখন সবাই ভিকারুন্নেছা নুন মহিলা স্কুল ও কলেজের দিকে। সবাই হয়েতো মনে মনে ভাবছে কত খারাপ এই প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এ ঘটনা বা কাহিনী যে শুধু ঐ প্রতিষ্ঠানেই ঘটছে তা কিন্তু নয়। এমন ঘটনা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই কমবেশী ঘটছে। সেখানেও হয়তো অভিভাবক ও ছাত্র ছাত্রীরা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন? এ ঘটনা ঘটছে প্রতিটি অফিস-আদালতেও। যেগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনে, টকশোতো, পত্র পত্রিকায় উঠে আসে। কিন্তু ঐ সব ঘটনা প্রকাশ হওয়া এবং পড়া পর্যন্তই। সেখানে ঐসব অনিয়ম ও দূর্ণীতি প্রতিরোধে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় না। বরং যাদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন বা খবর প্রকাশিত হয় তারা ক্রশ চেক এর সময় বরঞ্চ ঐ প্রতিবেদক যে মিথ্যা খবর প্রকাশ করেছে এ রকম একটি ষ্টেটমেন্ট দিয়েই রেহাই পেয়ে যায় এবং তার লাইন সুপারভাইজারও কোন অজানা কারণে তার পক্ষেই কথা বলেন।

এরপর ঘনটা খুবই স্পরশ কাতর হলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় (যদিও তাদের রিপোর্ট জন সমক্ষে খব কমই আসে) বড় জোর সাময়িক সাসপেন্ড বা প্রত্যাহার। কিন্তু পরে প্রত্যাহার কি হয় বা চূড়ান্তভাবে কি হয় তা জনগণ জানে না। যেমন গত কিছুদিন আগে রাতে পুলিশ কর্তৃক এক তরুনীকে হেনস্তা করার জন্য ৩ পুলিশকে সাময়িক প্রত্যাহার করা হয়েছে; কিন্তু তারপর কি হয়েছে তাদের প্রত্যহার স্থায়ী হলো নাকি তারা আবার অন্য জায়গায় কাজে যোগদান করল তা জনগণ হয়তো জানে না বা কোন দিন জানবেই না। এখানেও তদন্ত কমিটি হয়েছে, মামলা হয়েছে, একজন শিক্ষক গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পর কি হবে? মানুষ যখন ভুলে যাবে তখন কি আগের মতই চলবে নাকি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আরো বেড়ে যাবে নাকি বিবেক জাগ্রত হবে? এর উত্তর আমাদের কাছে নেই। শুধু সময়ই সঠিক উত্তর দিতে পারবে। যেমন সেই আপন জুয়েলার্স এর ছেলেও জামিন পেল এবং সে হয়তো অন্য কৌশলে আগের জীবনই পালন করবে।

এগুলো এখানে উল্লেখ করার অর্থ্ হলো এসব নিয়ে জনমত সৃষ্টি করতে বা প্রশাসন বা মালিকের বা পাবলিকের সামনে তুলে আনার জন্য কি আরো অনেককে অরিত্রি’র মত আত্ম-হনন করতে হবে? তবেই কি এগুলো আলোতে প্রকাশিত হবে? নাকি অরিত্রিদের মত ২/১ জনের নিকট হতে শিক্ষা নিব। তবে এগুলো বন্ধ হওয়া বাঞ্চনীয়। আমাদের যেন আর কোন অতিত্রিকে অকালে হারাতে না হয়। আমাদের বিবেক যেন একবারই জাগ্রত হয় এবং তা আর কখনো যেন ঘুমিয়ে না পড়ে।

 

লেখকঃ উন্নযন কর্মী।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here