[author image=”https://www.unitednews24.com/wp-content/uploads/2016/07/MIR-ALIM-1.jpg” ]মীর আব্দুল আলীম[/author]দেশে অবৈধ ভটভটি বন্ধে আইন হয়েছে; কিন্তু তা কার্যকর হয়নি এখনও। জনগণকে আইন মানতে বাধ্য করা হয়নি। হাইকোর্টের নির্দেশ বরাবরই হয় উপেক্ষিত,তাই যা হবার তাই হচ্ছে। ঈদের ছুটিতে গত ৮ জুলাই (২০১৬) দুপুরে চুয়াডাঙ্গার কুষ্টিয়া-আলমডাঙ্গা সড়কে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি ভটভটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তিন যাত্রী নিহত ও দু’জন আহত হয়েছেন। অনভিজ্ঞ চালকের কারণে মুহূর্তেই ৩ প্রাণ নিভে যায়। বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, দিনাজপুর, রংপুর, যশোর, ঝিনাইদাহসহ দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিনিয়ত এভাবে অবৈধ এ যান কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণ। অল্পবয়স্ক, আনাড়ি চালকদেও নিয়ন্ত্রনে অনিরাপদ এ যান সড়ক মহাসড়কে দাবড়ে বেড়লেও যেন দেখার কেউ নেই। গত দু’বছর আগে সড়ক মহাসড়ক থেকে নছিমন, করিমন ও ভটভটি প্রত্যাহারে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে। পাশাপাশি মহাসড়কে যানচলাচলে মোটরযান অধ্যাদেশ অনুসরণ করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না এ ব্যাপারে হাইকোর্ট একটি রুল জারি করেছে। সড়ক দুর্ঘটনা এতটা বেড়েছে যে জনগণকে নিজেদের জীবন রক্ষায় আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়েছে।
মোটরযান অধ্যাদেশ না মান এবং সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের কার্যকর কোন ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছে ১২ হাজারের বেশি মানুষ। আর্থিক দিক থেকে বিবেচনা করলে এর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে তিন ভাগের দুই ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে নিম্নমানের কম গতির নছিমন, করিমন, ভটভটি জাতীয় যানবাহনের কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা না গেলে আগামী ১০ বছরে এর পরিমাণ হবে দ্বিগুণ। সরকার আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা শতকরা ২৫ ভাগে নামিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। বিআরটিএ এর মতে অবৈধ যানবাহন এবং অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালানোর কারণেই দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। ১১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার মহাসড়কের মধ্যে প্রায় সবটাই দুর্ঘটনা প্রতিরোধের দিক থেকে কার্যকর নয়। এ ছাড়া মহাসড়কে নিরাপদ চলাচলে ২০০৫ সালে গঠন করা হয় হাইওয়ে পুলিশ। বর্তমানে লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি দিয়ে চলছে হাইওয়ে পুলিশের কার্যক্রম। হাইওয়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও আছে প্রশ্ন। বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, আইন থাকা সত্ত্বেও এসব পরিবহন চলাচল বন্ধ করা হয়নি। কোন বৈধতা কিংবা বিআরটিএর নাম্বার না থাকলেও কি করে চলছে এসব যান? মোটরযান অধ্যাদেশের পরিবর্তন আনা হয়নি বহু সময় ধরে। তাই আইনের ফাঁক ফোকরে এসব যান চলছে অনেকটাই দাপটের সাথে। কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। ৭১ ভাগ চালকের নেই বৈধ লাইসেন্স। রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত পরিবহনের বিপরীতে অবৈধ চালকের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। তাই যত্রতত্রই ঘটছে দুর্ঘটনা। দোষীদের জন্য নেই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা।
এক গবেষণায় দেখা যায়, নানা কারণে দেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরযানে ১০০টি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে। উন্নত দেশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এক হাজার মোটরযানে দুর্ঘটনা দুই দশমিক পাঁচ ভাগ থেকে তিন দশমিক পাঁচ ভাগ। অন্যদিকে আমাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার যানবাহনে ১৬৩ জন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। বুয়েটের এ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইআরআই) পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর ১২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হচ্ছে। নিহতের ৮০ শতাংশের বয়স পাঁচ থেকে ৪৫ বছর। নিহতদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ পথচারী। যাদের ২১ শতাংশের বয়স ১৬ বছরের নিচে। দুর্ঘটনায় আহত ১৫ শতাংশ লোক মারা যায় ঘটনার ১৫ মিনিটের মধ্যে। দেশে ১৬ লাখ রেজিস্টার্ড গাড়ি রয়েছে আর লাইসেন্স পাওয়া ড্রাইভার রয়েছে মাত্র ১০ লাখ। ৪ লাখ ড্রাইভারের ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং ড্রাইভিং ট্রেনিং দেয়া ও তাদের জন্য লাইন্সেসের দরকার আছে। তা নাহলে প্রতিনিয়তই এভাবে অকাতরে ঝড়বে আমাদের প্রাণ। বিগত কয়েকটি বছরের সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। ১৯৯৪ সালে নিহত হয়েছে ৩০১ জন আর আহত হয়েছে ২৭৩৫ জন, ১৯৯৫ সালে নিহত হয়েছে ১৬৫৩ জন আর আহত হয়েছে ২৮৬৪ জন, ১৯৯৬ সালে নিহত হয়েছে ২০৪১ জন আর আহত হয়েছে ৪০৭৬ জন, ১৯৯৭ সালে নিহত হয়েছে ৩১৬২ জন আর আহত হয়েছে ৩৯৯৭ জন, ১৯৯৮ সালে নিহত হয়েছে ৩০৮৫ জন আর আহত হয়েছে ৩৪৫৩ জন, ১৯৯৯ সালে নিহত হয়েছে ৩৩১৪ জন আর আহত হয়েছে ১৯১১ জন, ২০০০ সালে নিহত হয়েছে ৩৪৩০ জন আর আহত হয়েছে ৩১৭২ জন, ২০০১ সালে নিহত হয়েছে ৩১০৯ জন আর আহত হয়েছে ৩৬০৭ জন, ২০০২ সালে নিহত হয়েছে ৩৩৯৮ জন আর আহত হয়েছে ৩০৭০ জন, ২০০৩ সালে নিহত হয়েছে ৩৩৮৯ জন আর আহত হয়েছে ৩৮১৮ জন, ২০০৪ সালে নিহত হয়েছে ২৯৬৮ জন আর আহত হয়েছে ২৭৫২ জন, ২০০৫ সালে নিহত হয়েছে ৩১৮৭ জন আর আহত হয়েছে ৩৭৫৫ জন, ২০০৬ সালে নিহত হয়েছে ৩১৯৩ জন আর আহত হয়েছে ২৪০৯ জন, ২০০৭ সালে নিহত হয়েছে ৩৭৪৯ জন আর আহত হয়েছে ৩২৭৩ জন, ২০০৮ সালে নিহত হয়েছে ৩৭৬৫ জন আর আহত হয়েছে ৩২৮৪ জন, ২০০৯ সালে নিহত হয়েছে ২৯৫৮ জন আর আহত হয়েছে ২৬৮৬ জন, ২০১০ সালে নিহত হয়েছে ৪০৬৭ জন আর আহত হয়েছে ৪৯৭৫ জন, ২০১১ সালে নিহত হয়েছে ৪৯৭৪ জন আর আহত হয়েছে ৩৯৭৫ জন, ২০১২ সালে নিহত হয়েছে ৫০৩৩ জন আর আহত হয়েছে ৪২২৭ জন, ২০১৩ সালে নিহত হয়েছে ৪৮০২ জন আর আহত হয়েছে ৪৮৪৫ জন। ২০১৩ সালে নিহত হয়েছে ৪৮০২ জন আর আহত হয়েছে ৪৮৪৫ জন। ২০১৪ সালে নিহত হয়েছে ৬ হাজার ৫৮২ জন আর আহত হয়েছে অন্তত ১১০০০ জন। ২০১৫ সালে নিহত হয়েছে ৮৬৪২ জন আর আহত হয়েছে অন্তত ২১,৮৫৫ জন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এর হিসাব অনুযায়ী ১৭ বছরে দুর্ঘটনা প্রায় ৭০ হাজার ৬’শ, নিহত ৫০ হাজার ৬’শতাধিক মানুষ। আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি বছরে গড়ে ঘটেছে ৪ হাজার ১’শ ৫২টি দূর্ঘটনা। প্রতিটি দূর্ঘটনায় গড়ে ২ লাখ টাকা ক্ষতি হলে প্রতি বছরে ক্ষতি হয় ৮৮ কোটি ০৫ লক্ষ ৮৮ হাজার ২’শ ৩৫ টাকা। ১৭ বছরে ক্ষতি হয়েছে ১৪১২০০০০০০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে ১৯৮০ সালের চেয়ে ২০০০ সালে সড়ক দূর্ঘটনা বেড়েছে ৪৩ শতাংশ আর একই সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ৪০০ শতাংশ বেড়েছে। প্রায়ই সড়ক দূর্ঘটনা ঘটে চলেছে। যানবাহনের নিষ্ঠুর আঘাত পথচারীদের কখনো অঙ্গহানি; আবার কখনো প্রাণহাণী ঘটাচ্ছে। আঁকা-বাঁকা সড়ক, অসংখ্য মোড়, নছিমন-করিমন আর অদক্ষ চালক দ্বারা গাড়ি চালানোকে সড়ক দূর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করেছেন সচেতন মহল।
নছিমন-করিমন হচ্ছে এক ধরনের বাহন, যা ভটভটি নামেও পরিচিত। নছিমন জাতীয় গাড়ির নেই কোনো লাইসেন্স। চালকেরও নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স কিংবা কোনো গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা। তা হলে কিভাবে চলছে এসব যান? আনাড়ি এবং অবৈধ এসব গাড়িচালকদের জন্য প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা। এর ফলে প্রতিদিন অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করছে কিংবা অকালে চলে যেতে হচ্ছে পৃথিবী থেকে। নছিমন গাড়িগুলোর লাইসেন্স না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটার পর ড্রাইভারকে খুঁজে বের করা দুরূহ। মূলত মফস্বল এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ এই নছিমন-করিমন। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। দুর্ঘটনা বৃদ্ধির কারণ হিসাবে ড্রাইভার ও পথচারীদের অসচেতনতাকে দায়ী করা হলেও অবৈধ যান চলাচল বন্ধে পুলিশ প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সব থেকে অবাক ব্যাপার আমাদের এলাকায় পুলিশও এই গাড়িতে পেট্রোল ডিউটি করে! বর্তমানে সড়ক মহাসড়কে একচেটিয়া দখলে নিয়েছে নছিমন করিমন, আলমসাধু, ভটভটিসহ অন্যান্য যন্ত্রদানব। পুলিশের পক্ষ থেকে এ সব যানবাহন উচ্ছেদে আইনী পদক্ষেপ গ্রহণের যে কথা তা রহস্যজনক ভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদমতে, শুধু উত্তরাঞ্চলেই চলাচল করছে প্রায় ৪০ হাজার নছিমন-করিমন। প্রতিদিন প্রতিটি গাড়ি থেকে চাঁদা উঠছে ১০ টাকা। সে হিসাবে প্রতি বছর উত্তরাঞ্চল থেকেই ১৪ কোটি টাকা আসে। নিয়মিত এ মাসোহারা ছাড়াও চুক্তিবদ্ধ এলাকার বাইরের গাড়ি হলে টাকা দিয়ে রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। গ্রামের গাড়িয়াল-মৈশালরাও এখন নছিমন-করিমন চালায়। ফলে অহরহ ঘটে দুর্ঘটনা। প্রধান সড়কগুলোতে নছিমন-করিমন বিরোধী অভিযান পরিচালনার কথা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে এর কার্যক্রম। ভ্রাম্যমাণ আদালত কর্তৃক এই অভিযান পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও কার্যত এর সুফল পাওয়া যায়নি। তাই অবৈধ ও পরিবেশ বিধ্বংসী নছিমন-করিমন, আলমসাধু. ভটভটি অবাধ চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা যেন পিছু ছাড়ছে না। অবস্থাদৃষ্টে আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। এ অবস্থায় দেশের উচ্চ আদালত এসব পরিবহন মহাসড়ক সড়ক থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে। এ নির্দেশ আদৌ কার্যকর হয় কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
হাইকোটের্র নির্দেশই বড় কথা নয়। আমাদের আইন মানতে হবে। আর না মানলে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে অনেক বেশি কঠোর হতে হবে। জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। এজন্য সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। নছিমন-করিমন চলাচল বন্ধ না করলে দুর্ঘটনা কিছুতেই কমানো যাবে না। পথ পিচ্ছিল করে রাখলে পড়ে গিয়ে কোমরতো ভাঙ্গবেই। ঠিক তেমনই এসব ধিরগতি ত্রটিপূর্ণ যান সড়কে থাকলে দুর্ঘটনা ঘটবেই। আর এ জাতীয় যান বন্ধ করা না গেলে আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। অতীতে দেখেছি, বড়কোন দুর্ঘটনা ঘটলে এসব যানবাহন বন্ধের দাবিতে যতবার আন্দোলন হয়েছে সরকার ততবার এগুলোকে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্তের পর পরই নছিমন মালিকরা জোট বেঁধে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারস্থ হয়। যাদের আইন করে এটা বন্ধ করার কথা তারাই এগুলোকে চলতে দিতে প্রশাসনের কাছে সুপারিশ করে। আর প্রশাসনের এক শ্রেণীর লোকজন কখনই চায় না নছিমন-করিমন চলাচল বন্ধ হোক। কারণ এটা তাদের কাছে দুধেল গাভীর মতো। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা মাস গেলেই এখান থেকে তাদের পকেটে আসে। এভাবে রক্ষকরাই ভক্ষকের ভূমিকা পালন করায় মহাসড়ক ক্রমেই ভয়াল হয়ে উঠছে। ফলে অকালে মূল্যবান জীবন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই অতিদ্রুত এসব অবৈধ যান বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। হাইকের্টেও নির্দেশনার পাশাপাশি সর্ব ক্ষেত্রে পরিবহন আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।