“আমি তখন খোকসাবাড়ীর বাজার এলাকায় বাবা-মার সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রুটি বানানোর কাজে সাহায্য করছিলাম। হঠাৎ রাজাকাররা পাক বাহিনীকে আমাদের চিনিয়ে দেয়। তখন পাক বাহিনী অতর্কিত হামলা চালিয়ে আমাকে ও সাথে আরো দু’জন যুবতীকে চুলের মুঠি ধরে আমাদের উপর উপর্যুপরি ধর্ষন চালায়। এক পর্যায়ে আমরা অজ্ঞান হয়ে পড়ি। এসব কথা শুনে আমার স্বামী আমাকে গ্রহণ করেনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের পুনঃবাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর আমাদের খোঁজ খবর আর কোন সরকার নেইনি।”এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতির বর্ণনা দিলেন একাত্তরের বীরঙ্গনা রাহেলা বেগম।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এ আজ বিজয় ও স্বাধীনতার ৪০ বছর উদ্যাপন উপলক্ষে ইতিহাস বিভাগের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে “বীরাঙ্গনার জবানীতে একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি” শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরেন। এ সময় বীরাঙ্গনা আছিয়া বেগম ও বীরঙ্গনা রাহেলার স্মৃতিচারণে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের নির্মম অত্যাচার ও করুণ কাহিনী সমবেত সকলকে শিহরিত করে। সবাই অসহ স্মৃতি ও নির্মম অত্যাচারের কথা শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। সকলে সমন্বরে সেই সকল রাজাকার, আল-বদর বাহিনীসহ সকল যুদ্ধাপরাধীদের অনতিবিলম্বে বিচারের জোর দাবি জানান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ক্যাপেন্ট এ. বি. তাজুল ইসলাম (অবঃ) এম.পি. বলেন, “বীরাঙ্গনা আছিয়া বেগম ও বীরঙ্গনা রাহেলা বেগমসহ আড়াই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাবদ বর্তমান সরকার খেতাবের ক্রমানুসারে যথাক্রমে ৮, ১০, ১২ ও ১৪ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে যা আগামী বছর থেকে কার্যকর করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের এবং সন্তান না পাওয়া গেলে তাদের নাতি-নাতনীদের জন্য চাকুরীর কোটা রাখা হয়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও মুক্তিযুদ্ধ চর্চা কেন্দ্র-এর আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবু মোঃ দোলোয়ার হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের অববহিত পরে ২৩ হাজার নির্যাতিত নারীর গর্ভপাত করা হয়েছিল। যাদের স্বামীরা তাদের গ্রহণ করেনি, তাদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুনঃবাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। এসময় তিনি যমুনা নদীর পাড়ে সিরাজগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের ওপর তার গবেষণালব্ধ আরো নির্মম কাহিনী ব্যক্ত করেন।
একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বীরাঙ্গনা আছিয়া বেগম বলেন, পাক বাহিনী তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। দুই ভাইকে হত্যা করেছিল। ছোট্ট শিশু সন্তানকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তাকে ধর্ষণ করেছিল। তিনি এখন অন্যের বাড়ীতে ঝিয়ের কাজ করছে। সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কোন সাহায্য সহযোগিতা করেনি।
সভাপতির বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশের আনাচে কানাচে বীরঙ্গনা রাহেলা ও আছিয়া বেগম-এর মত একাত্তরে অসংখ্য নির্যাতিত নারী রয়েছেন, যাদের খোঁজ খবর আমরা জানি না। তাঁদের খুঁজে বের করে ‘বীরমাতা’ উপাধি দিয়ে পুনঃর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।”
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিনগণ, বিভাগের চেয়ারম্যান, শিক্ষকগণ, ছাত্রছাত্রী, কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/রাশেদুজ্জামান/জাবি