“মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পিতা-মাতা ও দু’ভাইকে হারানোর প্রতিদান হিসেবে পেয়েছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া এই চিঠি। আজো পাইনি শহীদ পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি। তাতেও কোন দুঃখ নেই। মৃত্যুর পূর্বে যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যেতে পারি, তাহলে মরেও শান্তি পাবো”। স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া তিনটি চিঠি হাতে নিয়ে আবেগআপ্লুত হয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন, বরিশালের গৌরনদী পৌর সদরের টিকাসার মহল্লার বাসিন্দা ঋষিকেষ দেবনাথ (৭৫)। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি (ঋষিকেষ) তার পিতা-মাতা ও দু’ভাইকে হারিয়েছেন। দীর্ঘ ৪০ বছরেও শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি না পাওয়ায় ক্ষুব্দ ঋষিকেষের পরিবার।

অশ্রুসিক্ত নয়নে বৃদ্ধ ঋষিকেষ দেবনাথ বলেন, ওরা (স্থানীয় রাজাকারদের উপস্থিতিতে পাকসেনারা) চোখের সামনে আমার বাবা ও এক ভাইকে গুলি করে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে। আমার মা ও বাড়ির অন্যান্য মহিলাদের ওপর চালিয়েছে অমানবিক নির্যাতন। বড়ভাইকে ধরে নিয়ে বস্তা বন্দি করে ব্যানেট দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তার লাশ পর্যন্ত আমরা পাইনি। তিনি আরো বলেন, যুদ্ধচলাকালীন ১১ জৈষ্ঠ বিকেলে আমার সেজভাই রামেস্বর দেবনাথকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় তৎকালীন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাশেম মোল্লা, কনষ্টবল হাবিব ও স্থানীয় কতিপয় রাজাকাররা। তারা আমার ভাই রামেস্বর দেবনাথকে উপজেলা পরিষদের সম্মুখের একটি গাছের সাথে রশি দিয়ে বেঁধে রাখে। পরবর্তীতে গৌরনদী কলেজে পাকসেনাদের স্থায়ী ক্যাম্পে খবর দেয়া হলে পাকসেনারা আসার পর ভাইকে রক্ষার জন্য আমার বাবা দেবেন্দ্র কুমার দেবনাথ ও মা চন্দ্রাবতি দেবনাথ ছুঁটে গিয়ে পাকসেনাদের পায়ে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেন। বাবা-মা বলেছিলেন, তোমরা আমাদের মেরে ফেলো, তবুও দয়াকরে আমার ছেলেকে ছেড়ে দ্যাও। কিন্তু কোন কিছুতেই নরপশুদের মনগলেনি। তারা আমার বাবাকেও বেঁধে মায়ের ওপর চালায় অমানবিক নির্যাতন। আমরা বাড়িতে লুকিয়ে থেকে সবকিছুই প্রত্যক্ষ করি। প্রথমে নরপশুরা বাবা-মায়ের সম্মুখেই আমার ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। পরে গুলি করে হত্যা করা হয় আমার বাবাকে। পরবর্তীতে দু’জনের লাশই পাশ্ববর্তী খালের পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। ওইসময় আমার মা প্রানে বেঁচে গেলেও স্বামী ও পুত্র শোকে সে পাথর হয়ে যায়। এ ঘটনার মাত্র ১৫দিন পরেই আমার বড়ভাই রাধা গোবিন্দ দেবনাথকে পাকসেনারা গৌরনদী গার্লস হাইস্কুলের ব্রীজের ওপর থেকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে বস্তাবন্দি করে গৌরনদী কলেজের পাকসেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে ব্যানেট দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে লাশ গয়নাঘাটার খালে ভাসিয়ে দেয়া হয়। স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে আমরা এ খবর জানতে পারি। ওইসময় ওসি কাসেম মোল্লা ও কনষ্টবল হাবিবের নেতৃত্বে স্থানীয় কতিপয় রাজাকাররা গৌরনদীতে হিন্দু নিধন অভিযান শুরু করেছিলো। তারই ধারাবাহিকতায় তারা টিকাসার গ্রামের গৌর কুন্ড, সুধীর বণিকসহ অসংখ্য হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকজনকে হত্যাসহ বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। আমরা প্রাণ বাঁচাতে বাড়ি-ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলাম। এ সুযোগে স্থানীয় রাজাকার ও লুটারেরা আমাদের ঘরের মেঝের মাটি খুঁড়ে পর্যন্ত সবকিছু লুটপাট করে নেয়। বাবা ও দু’ভাই পাকসেনাদের হাতে নিহত ও মা চন্দ্রাবতি দেবনাথ নিজেই নির্যাতিত হবার পর শোকে কাতর হয়ে মা মাত্র একমাসের ব্যবধানে মারা যান। আমরা তার সৎকার করতে না পেরে অতিগোপনে দাফন করেছিলাম।

এসবের বিনিময়ে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে (১৯৭৩ সনে) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ পরিবার হিসেবে আমাদের তিনটি চিঠির মাধ্যমে সমবেদনা জ্ঞাপন করে প্রত্যেক শহীদের জন্য দুই হাজার টাকা করে অনুদান প্রদান করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হবার পর আর কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। তাই শহীদ পরিবার হিসেবেও আর আমরা স্বীকৃতি পাইনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাক্ষরিত ও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিলো, প্রিয় বোন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য স্বামী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সহিত জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশ প্রেমিকের স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন। ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যান তহবিল’ থেকে আপনার পরিবারের সাহায্যার্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহাকুমা প্রশাসনের নিকট দুই হাজার টাকা চেক প্রেরিত হল। আমার প্রাণভরা ভালবাসা ও শুভেচ্ছা নিন। ইতি-শেখ মুজিব।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/মামুনুর রশিদ/বরিশাল

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here