পলাশবাড়ী মুক্ত দিবস। ৪০ বছর আগে মুক্তি শেষে শত্রু মুক্ত হয়ে বিজয় এসেছিল পলাশবাড়ীতে। বিজয়ের উলাসে আর জয় বাংলার ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল পলাশবাড়ী আকাশ বাতাস। পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে কত মানুষ নিহত হয়েছে, কত মা বোনের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়েছে তার সঠিক তথ্য কেউ জানে না, দিতে পারেনি। হানাদার বাহিনী কথা বলতো বায়োনেট দিয়ে এবং হাসতো মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ারে মানুষের বুকে গুলি বসিয়ে তাজা রক্ত ঝরিয়ে। মুক্তিযুদ্ধও স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৪০ বছরে নির্দিষ্ট কিছু স্থান ছাড়া বহু গণকবর ও বধ্যভুমি এখন বিসতৃত প্রায়। ইতিমধ্যেই বহু গণকবর ও বধ্যভুমির নাম নিশানা মুছে ফেলা হয়েছে। সেখানে স্কুল, কলেজ, আবাদী জমি, দালানবাড়ী অযত্নে অবহেলায় অনেক গণকবর বন জংগলে ঢাকা পড়ে আজ লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে গেছে।
১৯৭১ সালের ৭মার্চ স্থানীয় পিয়ারী পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যাপক হাসান আজিজুর রহমানের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় তোফাজ্জর হোসেনকে আহ্বায়ক ও ওমর ফারুক চৌধুরীকে সদস্য সচিব এবং মরহুম এম কে রহিম উদ্দিন, মরহুম মেনহাজ উদ্দিন সরকার, আইয়ুব আলী মাষ্টার, আব্দুল বারেক, আলহাজ্ব সাকোয়াত জ্জামান বাবু, মোফাজ্জল হোসেন, স্বর্গীয় রাখাল চন্দ্র বাবু, আব্দুর রহমান, মোস্তাফিজার রহমান, ডাঃ নিজাম মন্ডল, অরজিৎ কুমার, মরহুম আব্দুল ওয়ারেছ, আব্দুল মান্নান, শষিভূষণ রায়, ইয়াকুব আলী, নুরুল মন্ডল, আনছার আলী মাষ্টার, আব্দুল জোব্বার, নওয়াব আলী, হালিম, দেবেন্দ্রনাথ সাহা, ভোলাগাছু, হাফিজার রহমান প্রমুখকে নিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। কমিটির উপদেষ্টা ছিলেন মরহুম আজিজার রহমান এমপি। এই কমিটি ১৪মার্চ ৭১ স্থানীয় ফেন্ডস ইউনিয়ন ক্লাবে একটি শিবির খোলে এবং পাকিস্তানী পতাকার স্থলে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। ১২ মার্চ ঢাকা থেকে রংপুর গামী হানাদার বাহিনীর গাড়ি চলাচলে বাধা সৃষ্টির জন্যে রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। বেরিকেড সরিয়ে হানাদার বাহিনীর গাড়ী রংপুরে গেলেও কমিটির উদ্যোগে সৈন্যদের যাতায়াত বিভিন্নভাবে বিঘ্ন ঘটানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়। ফলে হানাদাররা ক্ষিপ্ত হয়ে কালীবাড়ী হাটের নিরীহ হাটুরেদের উপর বেধড়ক গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে গিরিধারীপুর গ্রামের আব্দুল মান্নান এবং ২জন বাঙ্গালী পুলিশসহ নাম না জানা আরো অনেকে শহীদ হন এবং গিরিধারীপুরের রজব আলী নামের যুবকের পায়ে গুলি লাগে। সে প্রাণে বেঁচে গেলেও বর্তমানে সে অতিকষ্টে রিক্সা চালিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। ২৮ মার্চ সীমান্ত এলাকা থেকে ৫০/৬০ সদস্যের ইপিআর বাহিনী পলাশবাড়ীতে আসে। উভয়দলের সংঘর্ষে ২১ জন শহীদ হন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসর মেজর নিজাম বাঙ্গালী সৈন্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন চক্রান্ত শুরু করে। ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন ফুলবাড়ীতে অবস্থান করছেন শুনে মেজর নিজাম ফুলবাড়ী গিয়ে পাকিস্তানী প্রীতি লুকে রেখে কৌশলে ক্যাপ্টেন আনোয়ারকে দুর্বল করার জন্যে কুপরামর্শ দেয় এবং তা বুঝতে পেরে দূরদর্শী ক্যাপটেন আনোয়ার ২৯ মার্চ সিলেটবাসী সুবেদার আলতাফকে ৬০জন সৈন্যসহ ঘোড়াঘাট প্রেরণের পরিবর্তে পলাশবাড়ীতে অবস্থানের নির্দেশ দেন। সেনাদলকে কাছে পেয়ে পলাশবাড়ীর বীর ছাত্র যুবকসহ সর্বস্তরের জনতা আরো বেশি সাহসী হয়ে ওঠে এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রতিরোধ কমিটি সেনাবাহিনী ও ইপিআর জোয়ানদের সার্বিক সহযোগীতা প্রদান অব্যাহত রাখেন। ৩০মার্চ মেজর নিজামের পাকিস্তানী প্রীতি উন্মোচিত হয়। সে সকল সৈন্যকে ক্লোজড্ হতে ও অস্ত্রজমা দিয়ে বিশ্রামে যেতে বলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর দামাল সন্তানেরা এ চক্রান্ত বুঝতে পারে। সৈনিকেরা বিশ্বাস ঘাতক মেজর নিজামকে হত্যা করে। পরে লেঃ রফিক নেতৃত্বে লাভ করেন। ৩১ মার্চ পলাশবাড়ীতে পাক হানাদাররা আবারো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। বাঙ্গালী ইপিআর ও সেনা বাহিনীর জোয়ানদের সাথে সম্মুখ গুলি বিনিয়ময় হয়। এক সময়ের হানাদার বাহিনী পলাশবাড়ী চৌরাস্তা মোড়ে উপস্থিত হয়। সেখানে ছিলেন লেঃ রফিক। হানাদাররা তাকে জাপটে ধরে তাদের সুবেদার আলতাফের সঙ্গী হাবিলদার মুনছুর গ্রেফতার কারীদের উপর এসএমজি দিয়ে গুলি চালায়। একজন পাকিস্তানী ঘাতক সেনা সদস্য লেঃ রফিককে পিস্তল দিয়ে গুলি করে। তৎসময়ের পাবনার নারিনদা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল আজিজ ও ফাতেমা বেগমের বীর দামাল সন্তান লেঃ রফিক শহীদ হন। নেতৃত্ব পান বেঙ্গল সুবেদার আলতাফ। তিনি পলাশবাড়ী এলাকার মোজাহিদ আনছারদের আহ্বান জানান স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের সাথে যোগ দিতে। কয়েক দিনের মধ্যে ২৫০জন মোজাহিদ আনসার তাদের সাথে যোগ দেন। সুবেদার আলতাফের নেতৃত্বে তারা পীরগঞ্জের আংরার ব্রিজ, সাদুল্যাপুরের মাদরগঞ্জ ও গোবিন্দঞ্জের কাটাখালী ব্রিজসহ পলাশবাড়ী সদরে অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৯৭১সালের ১১জুলাই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মেদের সভাপতিত্বে সামরিক অফিসারদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। পলাশবাড়ী সহ গাইবান্ধা অঞ্চল ছিল গঠিত জেড ফোর্সের অধীনে। পরর্বতীতে সেপ্টেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানির নির্দেশে জেড ফোর্স সিলেট অঞ্চলে চলে গেলে, এ অঞ্চলে গড়ে ওঠে ১১নং সেক্টর এবং নেতৃত্বে দেন মেজর তাহের। ১৪ এপ্রিল কাকডাকা ভোরে সশস্ত্র হানাদার বাহিনী ৩০/৩৫টি কনভয় দিয়ে ঢাকা থেকে পলাশবাড়ীর উপর দিয়ে রংপুরে যায়। ১৫এপ্রিল রাত আটটায় হানাদার বাহিনী আংরার ব্রিজ পাহারারত বাঙ্গালী সৈনিকদের উপর হামলা চালানোর খবর গাইবান্ধা পৌছিলে ক্যাপ্টেন আনোয়ার, প্রশিক্ষক কাজিউল ইসলাম, গাইবান্ধা ট্রেজারী থেকে গুলি সংগ্রহ করে তাদের সাথী অন্যান্য প্রশিক্ষক বীর যোদ্ধাদের নিয়ে দ্রুত পলাশবাড়ীতে ছুটে এসে যুদ্ধে অংশ নেন। গাইবান্ধা মহকুমার (বর্তমানে জেলা) একটি অঞ্জোপাড়া গাঁয়ের নাম কাশিয়াবাড়ী। পলাশবাড়ী উপজেলার কাশিয়াবাড়ী এলাকায় প্রায় ৮০০ গৃহস্থ বাড়ী ছিল। এখান থেকে দুই আড়াই মাইল দুরে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট থানা অবস্থিত। সেখানে ছিল একটি অবাঙ্গালী (বিহারী) কলোনী। এই কলোনীর অবাঙ্গালীরা পাক হানাদার বাহিনীর সমর্থনে বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হানা দেয় কাশিয়াবাড়ী অঞ্চলে। ১১ জুন ৭১ কাশিয়াবাড়ীর সাধারণ মানুষ পাক হানাদার বাহিনী ও অবাঙ্গালীদের অক্রমণে তাড়া খাওয়া হরিনের মতো পালাতে থাকে। কেউ করোতোয়া নদী সাতরিয়ে পালায় আবার কেউ ধান ও পাট ক্ষেতে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু কাশিয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সেক্রেটারী হারেছ মিয়া পালাতে পারেনি। ঘাতকরা তাকে জবাই করে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু হারেছ মিয়াকেই নয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলজার মিয়া সহ নাম না জানা শতাধিক মুক্তিকামী ব্যক্তিকে জবাই করে হত্যা করে মায়ের বুক খালি করে মানুষরূপী নরপশুরা। ধর্ষণ করা হয় ফুলবানু, গিরিবালা সহ বহু মহিলাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে গ্রামটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় নরপশুরা। যারা পালাতে পারেনি তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে প্রায় ১ হাজার লোককে ধরে এনে কাশিয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অপর শক্তঘাটি পলাশবাড়ী থানা সদরের সড়ক ও জনপথ এর ডাক বাংলোয় (সিএন্ডবি) বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিকামী মানুষেদেরকে ধরে এনে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যাযজ্ঞসহ গ্রাম থেকে মহিলাদেরকে ধরে এনে ধর্ষণ অব্যাহত রাখে। শহীদদের গণকবর এই সিএন্ডবি অফিস চত্ত্বরে, গিরিধারীপুর গ্রামের খায়রুলের বাড়ির পুকুর পারে, বৈরী হরিনমারী গ্রামের বাংকারের মধ্যে প্রায় ১০ জন, সদর প্রাইমারী স্কুলের পার্শ্বে ঝাপড় মুংলিশপুর গ্রামে, জামালপুর গ্রাম ও কাশিয়াবাড়ী হাইস্কুলের পার্শ্বে অধিকাংশ গণ কবর রয়েছে। এছাড়াও উপজেলার হোসেনপুর ইউপির আমবাগানে অযত্নে অবহেলায় এই গণকবরগুলো এখনও কালের নীরব স্বাক্ষী হয়ে আছে। সৎকারের কেউ ছিল না বলেই তাদের পবিত্র লাশগুলো কুকুর শৃগালের পেটে যায়। স্বাধীনতার পরবর্তীতে অবশ্য তাদের ছড়ানো ছিটানো হাড়হাড্ডি গুলো কুড়িয়ে একত্র করে কবরস্থ করা হয়েছে। যথাস্থানে যা এখনও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে। কতিপয় কুলাঙ্গার ছাড়া দেশের অধিকাংশ মানুষই একাত্ব ছিলেন ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সাথে। পলাশবাড়ীতে ৬৫জন সাহসী বীর সন্তান প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে, গোলাম রব্বানী, পিতাঃ ফরহাদ রব্বানী, সাঁতারপাড়া, আঞ্জু মন্ডল পিতা ইমান আলী পবনাপুর, আঃ লতিফ, পিতা হেলাল উদ্দিন সরকার ও আবুল কাশেম, পিতা আঃ করিম প্রধান সাতার পাড়া সহ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর বাহিনীর ২৬জন জোয়ান শহীদ হন। ৮ডিসেম্বর ৭১ সকালে বিজয়ী বেশে জয়বাংলা জয় বাংলা শোগানে উচ্চারণ করে যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী হাজার হাজার ছাত্র-যুবক জনতা আনন্দ উৎসবের মধ্যে দিয়ে নিজ নিজ এলাকার মায়ের কোলে ফিরে আসে। আর এভাবেই পাক হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে শত্রুমুক্ত হয় পলাশবাড়ী।
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/ছাদেকুল ইসলাম/গাইবান্ধা