অথিতি লেখক/
তোফায়েল আহমেদ : জেলহত্যা দিবসে অতীতের অনেক স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতা সর্ব জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। জাতীয় ইতিহাসের কলঙ্কিত সেই দিনে আমি ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দী। কি দুঃসহ জীবন তখন আমাদের। ময়মনসিংহ কারাগারের কনডেম সেলে (ফাঁসির আসামিকে যেখানে রাখা হয়) সেখানেই আমাকে রাখা হয়েছিল। সহ-কারাবন্দী ছিলেন ‘দ্য পিপল’ পত্রিকার এডিটর জনাব আবিদুর রহমান। যিনি মাত্র কিছু দিন আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। আমরা দুজন দুটি কক্ষে ফাঁসির আসামির মতো জীবন কাটিয়েছি। হঠাৎ খবর এলো, কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। কারাগারের সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। কারারক্ষীরা সতর্ক। ময়মনসিংহ কারাগারের জেলসুপার ছিলেন শ্রী নির্মলেন্দু রায়। যিনি কিছু দিন আগে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। আমি তার আত্দার শান্তি কামনা করি। চমৎকার মানুষ ছিলেন তিনি। কারাগারে আমরা যারা বন্দী ছিলাম তাদের প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল। বঙ্গবন্ধুও তাকে খুব স্নেহ করতেন। বঙ্গবন্ধু যখন বার বার কারাগারে বন্দী ছিলেন, নির্মলেন্দু রায় তখন কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন। বঙ্গবন্ধুও স্বাধীন বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী হয়ে নির্মলেন্দু রায়কে কাছে টেনে সব সময় আদর করতেন। সেদিন গভীর রাতে হঠাৎ নির্মলেন্দু রায় আমার সেলে এসে বলেন, ‘ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এত রাতে কেন? তিনি বললেন, ‘ঢাকা কারাগারে আপনাদের প্রিয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা কারাগারের চতুর্দিক পুলিশ দ্বারা বেষ্টন করে রেখেছি, জেল পুলিশ ঘিরে রেখেছে। এসপি সাহেব এসেছেন আপনাকে নিয়ে যেতে।’ আমি বললাম, না, এভাবে তো যাওয়ার নিয়ম নেই। আমাকে যদি হত্যাও করা হয় আমি এখান থেকে এভাবে যাব না। পরবর্তীকালে শুনেছি সেনাবাহিনীর এক মেজর সেই জেলখানার সামনে এসে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নির্মলেন্দু রায় বলেছিলেন, ‘আমি অস্ত্র নিয়ে কাউকে কারাগারে প্রবেশ করতে দেব না।’ আমাকে রক্ষা করার জন্য কারাগারের চারপাশে সেদিন যারা ডিউটি করছিলেন তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠী ১৯৭৩-এ যার চাকরি হয়েছিল- সেই ওদুদ, নেতৃত্ব দিয়েছিল কারাগার রক্ষা করার জন্য। আমি নির্মলেন্দু রায়ের কাছে ঋণী।
জেলখানার এই নিষ্ঠুর হত্যার খবরে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অতীতের অনেক কথাই ভাবতে শুরু করলাম। ছাত্রজীবন থেকে আমি জাতীয় চার নেতাকে নিবিড়ভাবে দেখেছি। তাদের আদর-স্নেহ আর রাজনৈতিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ হয়ে জীবন আমার ধন্য হয়েছে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট যেদিন জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয়, সেদিন আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। যার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছি, যার জন্ম না হলে এ দেশ স্বাধীন হতো না, তাকে বাংলার মাটিতে এভাবে জীবন দিতে হবে- এটা আমরা কখনো ভাবিনি। মনে পড়ে ‘৭৪-এর ২৩ ফেব্রুয়ারির কথা। ইসলামিক সম্মেলনে লাহোর গিয়েছিলাম। লাহোরে দেখা হয় মিয়ানওয়ালি জেলের প্রিজন গভর্নর হাবীব আলীর সঙ্গে। মিয়ানওয়ালী জেলে কারারুদ্ধ বঙ্গবন্ধুকে যিনি দেখাশোনা করতেন। সেই হাবীব আলী আমাদের কাছে এসে বলেছিলেন, ‘তোমরা গর্বিত জাতি। জাতি হিসেবে তোমরা গর্ব করতে পার। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে সেলের সামনে তোমাদের নেতার জন্য আমরা কবর খুঁড়ে শেখ মুজিবকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কবরে যেতে চান, না প্রধানমন্ত্রিত্ব চান।’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কবরের ভয় আমাকে দেখিও না। আমি তো জানি আমাকে তোমরা হত্যা করবে। আমি এও জানি যে, বাংলার দামাল ছেলেরা হাসিমুখে জীবন দিতে পারে। পৃথিবীর কোনো শক্তি নাই, সেই বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখতে পারে।’ মিনতি করেছিলেন এই বলে যে, ‘আমাকে হত্যা করে এই কবরে নয়, আমার লাশটি আমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় পেঁৗছে দিও। যে বাংলার মাটিতে আমি লালিত-পালিত, বর্ধিত হয়েছি, সেই বাংলা মায়ের কোলে আমি চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে চাই।’ দুর্ভাগ্য আমাদের, পাকিস্তানিরা যে নেতাকে হত্যা করতে পারেনি; অথচ সেই নেতাকে বাংলার মীরজাফর ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে জীবন দিতে হয়েছে সপরিবারে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকে জাতীয় চার নেতাসহ আমরা ছিলাম গৃহবন্দী। ১৫ আগস্টের পরদিন আমার বাসভবনে খুনিরা এসে আমাকে তুলে রেডিও স্টেশনে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে আমার ওপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়। পরবর্তী সময়ে জেনারেল শফিউল্লাহ এবং সদ্যপ্রয়াত আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্নেল শাফায়াত জামিল (তিনি তখন ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার), তাদের প্রচেষ্টায় রেডিও স্টেশন থেকে আমাকে বাড়িতে আমার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। মায়ের কথা আজ ভীষণভাবে মনে পড়ে। আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মা বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। মায়ের শরীরের ওপর দিয়েই আমাকে টেনে নিয়েছিল ঘাতকের দল। পর দিন শাফায়াত জামিল এবং তৎকালীন মেজর সাখাওয়াত হোসেন (পরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব. এবং নির্বাচন কমিশনার) এসে আমার সঙ্গে কথা বলেন। আমার ওপর যে অমানুষিক নির্যাতন হয়েছে শাফায়াত জামিল তার নিজের লেখা বইতে সেসব উল্লেখ করেছেন। আগস্টের ২২ তারিখ জাতীয় চার নেতাসহ আমাদের অনেক বরেণ্য নেতাকে গ্রেফতার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়েছিল গুলি করে হত্যা করার জন্য। যে কোনো কারণেই হোক ঘাতকের দল শেষ পর্যন্ত হত্যা করেনি। পরে নেতাদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রয়াত মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রদ্ধেয় নেতা জিল্লুর রহমান এবং আমাকে বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে খোন্দকার মোশতাক আমাদের ভয়ভীতি দেখান। আমরা যদি তাকে সহযোগিতা না করি, তাহলে আমাদের, বিশেষত আমাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তুমি কবরের উপর দিয়ে হাঁটছ। যদি তোমার বাড়িতে প্রবেশ করে তোমাকে হত্যা করে, সেই দায়িত্ব আমি নেব না।’ আমি উত্তর দিয়েছিলাম, আমাদের দায়িত্ব দয়া করে আপনাকে নিতে হবে না। আমাদের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল তা উপেক্ষা করে আমরা খুনি মোশতাকের সব প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। গৃহবন্দী অবস্থা থেকে সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ জিল্লুর রহমান, আমাকে ও জনাব আবদুর রাজ্জাককে একই দিন গ্রেফতার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোণে অবস্থিত পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ৬ দিন বন্দী রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এর পর আমাকে ও আবিদুর রহমানকে ময়মনসিংহ কারাগারে এবং জিল্লুর রহমান ও প্রিয় নেতা রাজ্জাক ভাইকে কুমিল্লা কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
ময়মনসিংহে কারারুদ্ধকালে জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পাই। দুঃসংবাদটি শুনেই মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতীয় চার নেতার সঙ্গে কত স্মৃতি আমার। ‘৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা দেন, তখন তাজউদ্দীন ভাই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। ছয় দফা দেওয়ার পর ফেব্রুয়ারির ১৮, ১৯ ও ২০ তারিখ হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে_ সম্ভবত ১৯ তারিখে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু মানুষ চিনতে ভুল করতেন না। তিনি যোগ্য লোককে যোগ্য স্থানে বসাতেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে প্রথম সহসভাপতি, মনসুর আলী সাহেবকে অন্যতম সহসভাপতি, কামরুজ্জামান সাহেবকে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করেছিলেন। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাজউদ্দীন ভাই পরম নিষ্ঠার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। ছয় দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যখন গ্রেফতার হন, তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীন ভাইসহ অসংখ্য নেতা-কর্মী কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। বঙ্গবন্ধু সারা দেশে ছয় দফার সমর্থনে জনসভা করেন এবং যেখানেই যান সেখানেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। খুলনায় জনসভা শেষে তাকে গ্রেফতার করা হয়; সিলেটে জনসভা, সেখানেও গ্রেফতার; ময়মনসিংহে গেলেন, গ্রেফতার হলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে আইয়ুব খান থামাতে পারেনি। পরিশেষে ৮ মে, নারায়ণগঞ্জের জনসভা শেষে ধানমন্ডির বাসভবন ফেরামাত্রই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে আমরা ৭ জুন হরতাল পালন করেছিলাম। সফল হরতাল শেষে এক বিশাল জনসভায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম যে ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা আজো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাঙালির ছয় দফা তথা স্বাধিকার কর্মসূচির বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে অপূর্ব সুন্দর বক্তৃতা করেছিলেন। তিনি অনলবর্ষী বক্তা ছিলেন। তাজউদ্দীন ভাই একজন দক্ষ সংগঠক ছিলেন এবং কামরুজ্জামান সাহেব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের এমএনএ হিসেবে পার্লামেন্টে বাঙালির দাবি তুলে ঐতিহাসিক ভাষণ দিতেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের এই জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বারংবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে।
ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সময় তাজউদ্দীন ভাইসহ অনেক নেতাই জেলে ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাইরে ছিলেন। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মরহুম আহমেদুল কবীরের বাসভবনে ডাকের সভা চলছিল। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ১১ দফা দাবি নিয়ে জাতীয় নেতাদের কাছে গিয়েছিলাম। আমি যখন ১১ দফা ব্যাখ্যা করছি তখন ন্যাপ নেতা মাহমুদুল হক কাসুরি বলেছিলেন, ‘You have included Sheikh Mujib’s six points in toto, so questions of acceptence does not come.’ তার এই বক্তব্যের পর আমি ইংরেজিতে যা বলেছিলাম তার অর্থ : আমরা বাঙালি, কীভাবে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয় আমরা জানি। আপনারা সমর্থন না করলেও এই ১১ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রিয়নেতা শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্ত করব। আমার এই দৃপ্ত উচ্চারণের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমাকে বুকে টেনে নিয়ে পরম আদরে বলেছিলেন, ‘তোমার বক্তব্যে আমি আনন্দিত ও গর্বিত।’ আজ সেসব কথা ভাবলে চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। জাতীয় নেতাদের এমন পিতৃসুলভ আচরণ, সন্তান হিসেবে বিবেচনা করে আমাদের যেভাবে বুকে টেনে নিতেন- আজ সেসব দুর্লভ। মহৎ হৃদয়ের নেতাদের যার যা প্রাপ্য, বঙ্গবন্ধু তাদের তা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখব, তিনি তৃণমূলের কর্মীকে নেতা বানিয়েছেন; ইউনিয়নের নেতাকে থানার নেতা; থানার নেতাকে জেলার নেতা; জেলার নেতাকে কেন্দ্রের নেতা এবং কেন্দ্রীয় নেতাকে জাতীয় নেতা বানিয়ে নিজেকে উন্নীত করেছিলেন জাতির জনকে। তার কাছে কর্মীদের কাজের মূল্য ছিল; দক্ষতার মূল্য ছিল; যোগ্যতার মূল্য ছিল। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে মতিয়ুর, মকবুল, রুস্তম, ড. শামসুজ্জোহা, সার্জেন্ট জহুরুল হকের রক্তের বিনিময়ে আমরা জাতীয় নেতাদের কারাগার থেকে মুক্ত করেছিলাম। তাজউদ্দীন ভাইসহ অনেক নেতাই মুক্তি পেয়েছিলেন ১২ ফেব্রুয়ারি। আর বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছিলেন ২২ ফেব্রুয়ারি। ১৪ ফেব্রুয়ারি পল্টনে ছিল ডাকের মিটিং। বক্তা হিসেবে নুরুল আমীনের নাম যখন ঘোষিত হলো, তখন মানুষ ঘৃণাভরে সেই নাম প্রত্যাখ্যান করল। সভাস্থলে মানুষ দাবি তুলল আমাকে যেন মঞ্চে তুলে নেওয়া হয়। আমাকে তখন মঞ্চে তোলা হলো। এখনো মনে পড়ে, আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ওপর বক্তৃতা করে বলেছিলাম, সে দিন বেশি দূরে নয়, যে দিন আমাদের প্রিয় নেতা আপনাদের মাঝে ফিরে আসবেন। বলেছিলাম, “শপথ নিলাম, শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করব; শপথ নিলাম, শপথ নিলাম- মা-গো তোমায় মুক্ত করব।” আজ ভাবতে কত ভালো লাগে, ঊনসত্তরের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ লক্ষাধিক মানুষের সামনে কৃতজ্ঞ জাতির পক্ষ থেকে বাংলার মানুষের নয়নের মণি শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে, হাতিয়ার তুলে নিয়ে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ প্রাণ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত করেছিলাম।
‘৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এবং কামরুজ্জামান সাহেব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে কে কোন পদে পদায়িত হবেন বঙ্গবন্ধু তা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। ‘৭০-এর নির্বাচনে আমিও মাত্র ২৭ বছর বয়সে এমএনএ হয়েছিলাম। ‘৭১-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি, পার্লামেন্টারি পার্টির মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু মুজিব সংসদ নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপনেতা আর প্রাদেশিক পরিষদে নেতা নির্বাচিত হলেন মনসুর আলী সাহেব। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে মনসুর আলী সাহেব হবেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। এ জন্য মনসুর আলী সাহেবকে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক পরিষদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সেটআপ করা ছিল। কিন্তু ১ মার্চে পূর্ব-ঘোষিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন ইয়াহিয়া কর্তৃক একতরফাভাবে স্থগিত হলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম পর্ব। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে সর্বাত্দক স্বাধীনতা ঘোষণার পর শুরু হয় অসহযোগের দ্বিতীয় পর্ব। বিশ্বে এমন অসহযোগ কখনো দেখেনি কেউ। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড সূচারুরূপে পরিচালনা করেছেন অসহযোগের প্রতিটি দিন। এ সময় লালমাটিয়ায় আমাদের প্রয়াত নেতা খুলনার মোহসীন সাহেবের বাসভবনে বসে আমরা কত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। বঙ্গবন্ধু যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন জাতীয় চার নেতার সঙ্গে পরামর্শক্রমে। বঙ্গবন্ধু এমন এক নেতা ছিলেন, তার অবর্তমানে কে কোথায় কি কাজ করবেন এটা তিনি আগেই নির্ধারণ করতেন। আমরা ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখব, ২৫ মার্চ রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণার পর যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলো, তখন বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে জাতীয় চার নেতাই আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়ে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে মুজিবনগর সরকার পরিচালনা করেন। মুজিবনগর সরকারে বঙ্গবন্ধু নেই, কিন্তু অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং কামরুজ্জামান সাহেব স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ১৬ ডিসেম্বর দেশকে হানাদারমুক্ত করেন।
‘৭১-এ মুজিবনগর সরকারে তাজউদ্দীন ভাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কি সুন্দর-সূচারুরূপে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। আমাদের যে চারজনকে মুজিব বাহিনীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও আমাকে। আমাদের চারজনের কাজ ছিল তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে বসে পরিকল্পনা গ্রহণ করা। আজকে আমার সেসব কথা মনে পড়ে। তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে আমি বর্ডারে বর্ডারে ঘুরেছি, একসঙ্গে কাজ করেছি। আমি থাকতাম কলকাতায় মুজিব বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে, মণি ভাই আগরতলায়, সিরাজ ভাই বালুর ঘাটে, আর রাজ্জাক ভাই মেঘালয়ে। ভারত সরকারের যত সাহায্য-সহযোগিতা সেসব আমার কাছে আসত। আমি আবার সেগুলো এই তিন নেতার কাছে পাঠিয়ে দিতাম।
দেশ স্বাধীনের পর আমি এবং রাজ্জাক ভাই শত্রুমুক্ত প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরেছিলাম ১৮ ডিসেম্বর। ২২ ডিসেম্বর চার নেতা ফিরে এলেন। বঙ্গবন্ধু এলেন ১০ জানুয়ারি। ২২ তারিখ আমরা বিমানবন্দরে মুজিবনগর সরকারের জাতীয় চার নেতাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলাম। ১১ জানুয়ারি তাজউদ্দীন ভাইয়ের বাসভবনে বঙ্গবন্ধু সমস্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাবেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং; সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্প; তাজউদ্দীন আহমদ অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী; ক্যাপ্টেন মনসুর আলী যোগাযোগমন্ত্রী এবং কামরুজ্জামান সাহেব ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৪ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হওয়ার। মাত্র ২৯ বছর বয়সে আমি মন্ত্রীর পদমর্যাদা পেলাম। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে থেকেছি শেষ দিন পর্যন্ত। ‘৬৯-এর পর থেকেই বঙ্গবন্ধু আমাকে কাছে কাছে রাখতেন। অফুরন্ত স্নেহ-আদর-ভালোবাসা পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। যা কোনো দিন ভোলার নয়। আমি শুধু জাতির জনকের সানি্নধ্যই পাইনি; জাতীয় চার নেতার ঘনিষ্ঠতা-সাহচর্যও পেয়েছি।
যে আদর্শ-উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে এবং ৩ নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে কায়েমি স্বার্থবাদীরা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। আজ আমরা মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনাকে আবার ফিরিয়ে এনেছি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করেছি। জেলহত্যার বিচারকার্য সমাপ্ত হয়ে কারও কারও ফাঁসির আদেশ হয়েছে। এরপর জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার সর্বশেষ যে মহৎ কর্মটি আমাদের বাকি আছে, সেটি হচ্ছে- স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করা। ইতোমধ্যে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি এবং বিচারিক কার্যক্রম অব্যাহত আছে। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী-রাজাকারদের রক্ষা করার জন্য দেশ-বিদেশে শুরু হয়েছে নানামুখী ষড়যন্ত্র। আজ জেলহত্যা দিবসে সারা বাংলার মানুষের কাছে আমার একটিই আবেদন- আমরা যেন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি।
লেখক : সংসদ সদস্য; সভাপতি, শিল্প মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।