চলনবিলের নিভৃত পল্লী তাড়াশ ও চাটাহের উপজেলার সীমান্ত গ্রাম ডেফলচড়া। এ গ্রামের শাঁখা শিল্পীরা এখনও ধরে রেখেছে প্রায় ২’শ বছরের শাঁখাশিল্পের ঐতিহ্য। দেশী ও আন্তর্জাতিক বাজারে অব্যাহত মূল্য বৃদ্ধির ফলে শাঁখা তৈরির উপকরন শঙ্খ অনেকটা দূষ্প্রাপ্য হলেও নানা চড়াই উৎরাইয়ের মাঝে এখনও টিকিয়ে রেখেছে কুটির শিল্প শাঁখার স্থানীয় বাজার। ৪০টি পরিবারের নারী-পূরুষ মিলিতভাবে জীবিকার উৎস হিসেবে এ পেশায় স্বচ্ছলতার অনেকটাই মূখ দেখতে পেরেছেন। শুধু অলংকার হিসেবেই নয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ের বিষয়টিতে শাঁখার স্থান সর্বাগ্রে। আর এ জন্য হিন্দু প্রধান চলনবিল অঞ্চলে নারীদের জন্য শাঁখার ব্যাপক চাহিদা থাকায় শাঁখাশিল্পীর পরিবার গুলো অনেকটাই আর্থিক স্বচ্ছলতার মূখ দেখেছেন।

শাঁখা শিল্পের গোড়াপত্তন : চলনবিলের  শাঁখাশিল্পের ইতিহাস দেশের অন্যান্য শাঁখা শিল্পের মতই সুপ্রাচীন। ব্রিটিশ গেজেটিয়ার থেকে জানা যায়, চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল এক কালের সমৃদ্ধিশালী জনপদ “হাড়িয়াল নগর” হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল। ইংরেজ শাসনামলে করতোয়া নদীকেন্দ্রিক হাড়িয়াল বন্দরে বাণিজ্য বেসাতির সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠে নানা শ্রেনী পেশার মানুষের আবাস্থল। এর মধ্যে গন্ধবনিক,তিলী,গাড়োয়ান, পট্টজীবি, বারুজীবি ও শাঁখারি সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য। হাড়িয়াল নগরের সন্নিকটে ডেফলচড়া গ্রামে শাঁখারি সম্প্রদায় বসতি স্থাপন করে বংশ পরম্পরায় নান্দনিক কারু শিল্পের ওই কাজটি করে আসছে প্রায় ২’শ ধরে। এতে ওই গ্রামের ৩৫টি পরিবারে প্রায় দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ সূনিপুনভাবে শাঁখা তৈরি করে নিজেদের দক্ষতার দৃষ্টান্ত রেখেছেন। আর এ জন্য চলনবিল এলাকায় ডেফলচড়ার শাঁখা শিল্পীদের তৈরি করা শাঁখার চাহিদা এবং মান এখনও অক্ষুন্ন রয়েছে।

যে ভাবে শাঁখা তৈরি : শাঁখা তৈরির মুল উপকরন শঙ্খ। শঙ্খ কেটে একাধিক রুপান্তর করে নান্দনিক সাঁজে তৈরি হয় পূর্নাঙ্গ শাঁখা। কিন্তু সেই শঙ্খ আহরন বাংলাদেশ কিংবা ভারতেও সম্ভব নয়। আমদানী করতে হয় সুদুর শ্রীলংকার সিংহল থেকে। দেশের টাঙ্গাইল,খুলনা ও ঢাকার কতিপয় আমদানীকারক শঙ্খ আমদানী করার পর ওই শঙ্খ মেশিনে কেটে খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে পৌঁছে যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে।

শাঁখাশিল্পী প্রকাশ ধর জানান, প্রতি বস্তা শঙ্খের দাম ২ হাজার ৫’শ থেকে ৩ হাজার ৫’শ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া টুকরো টুকরো শঙ্খের সমষ্টিতে শাঁখা শিল্পী যখন পূর্নাঙ্গ এক জোড়া শাঁখা তৈরি করে তা গুনগত মানের উপর প্রতিজোড়া ৬০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। ফেরী করে,পাইকারী দরে এবং খুচরা বিক্রির মাধ্যমে ডেফলচড়ার শাঁখা ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে।

রুপ-চর্চায় শাঁখা : শাঁখা তৈরির সময় শাঁখাশিল্পীরা শঙ্খের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে। শঙ্খের প্রতিটি টুকরোই এদের শঙ্খ তৈরির ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখে। যেমনটি মেশীনে শাঁখার তৈরির সময় যে পাউডারের সৃষ্টি হয় তা শঙ্খচুর্ণ হিসেবে বিভিন্ন প্রসাধনী কোম্পানী হরেক নামে রুপ চর্চার জন্য ফের প্রক্রিয়াজাত করে বাজার জাত করে থাকে।

শাঁখার যত নাম তত দাম : ডেফল চড়ার শাঁখা পল্লীর দক্ষ শাঁখা শিল্পী সুষমা রানী নাগ জানান, শাঁখার মুল ক্রেতা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। হিন্দুদের বিয়েতে এবং এয়োত্রী নারীদের মাঙ্গলিক অলংকার হিসেবে আবশ্যক হওয়ায় এর চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। শাঁখারও রয়েছে বিভিন্ন নাম। যেমন- গুরুদক্ষিনা, জাজি,কড়ি,পাটি,কাচ্চা,পিনা,চুত্তা ও চিকন বাওটি। এ ছাড়া সোনায় বাধানো শাঁখারও চাহিদা রয়েছে। নামের সাথে শাঁখার দামেরও হেরফের রয়েছে। আধুনিকতা আর নান্দনিক আলপনায় তৈরি করা ওই শাঁখা হিন্দু ধর্মের নারীদের পছন্দ অনুযায়ী নানা দামে কিনে পরিধান করে। ওই শাঁখা আর্থিক অবস্থা ভেবে ৬০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে।

শাঁখারীদের কথা : মিনতী নাগ জানান, শুরু থেকেই বাড়ীর কর্তার সাথে শাঁখা তৈরি হাতে খড়ি হলেও বংশগত ভাবে এ গ্রামের অনেক পরিবার উপার্জনের জন্য এ শিল্পকে ধরে রেখেছে। তবে আগে এ গ্রামে শাঁখাশিল্পীদের সংখ্যা বেশী থাকলেও এখন কমে এসেছে। অপ্রতুল উপকরন, উপকরনের মূল্য বৃদ্ধি এবং ব্যাংক ঋনের সুবিধা না থাকায় তাদের ব্যবসা তেমনটি প্রসার লাভ করেনি। ফলে ডেফল চড়ার শাঁখা শিল্প চড়াই উৎরাইয়ের মধ্যে এখনও টিকে আছে। তাদের দাবী শাঁখা শিল্পদেক বাঁচাতে এর পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/সুজন সরকার/সিরাজগঞ্জ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here