সঞ্জিব দাস,গলাচিপা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি ::
পটুয়াখালীর গলাচিপায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-আয়ের মানুষের চিকিৎসা সেবার অন্যতম ভরসাস্থল ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু এ হাসপাতালে ডাক্তারের স্বেচ্ছাচারিতায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। গরীব এক মহিলা রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট না দেখে কক্ষ থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে হাসাপাতালের সিনিয়র ডাক্তার মো. মেজবাহ উদ্দিন এর বিরুদ্ধে। জানা যায়, তার রেফার্ডকৃত ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা না করায় আলেয়া বেগম (৪০) নামে এক রোগীর রিপোর্ট দেখেন নাই তিনি। দীর্ঘ সময় বসিয়ে রেখে ওজন ও প্রেশার মাপার রিপোর্ট নাই এ কথা বলে অযুহাত দিয়ে খারাপ আচরণ করে কক্ষ থেকে বের করে দেন বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী। সোমবার দুপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এ ঘটনা ঘটে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগে প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগী চিকিৎসা সেবা নিতে আসে। শুধু গলাচিপা উপজেলা নয়, আশপাশের উপজেলা রাঙ্গাবালী, দশমিনা থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসে। হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রায় প্রতিদিন রোগীদের লম্বা লাইন লেগেই থাকে। হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে রয়েছে বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্র যা দিয়ে এক্সরে, আল্ট্রাসনোগ্রাম বাদে কম খরচে অন্যান্য প্রায় সকল টেস্ট করা হয়। কিন্তু দালালদের খপ্পরে পরে ও চিকিৎসকের পরামর্শে রোগীরা পরীক্ষা করাতে ছুটছেন বেসরকারি ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে। এ কারণে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের দুই-তিন গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করে বেসরকারি ডায়াগনোস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হচ্ছে। এটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রতিদিনের চিত্র। অভিযোগ রয়েছে ডাক্তার মেজবাহ এর কাছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা প্রতিনিয়ত দুর্ভোগের শিকার হয়। হাসপাতালের বহিঃবিভাগে তার কাছে রোগী এলেই প্রয়োজন অতিরিক্ত টেস্ট ধরিয়ে দেন। পরে রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষার জন্য বাইরের বেসরকারি ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে দেন। এর মাধ্যমে কমিশনভিত্তিক এসব বেসরকারী ডায়াগনস্টিক থেকে মুনাফা নিয়ে নিজের পকেট ভারি করে চলেছেন। আবার তার রেফার করা ক্লিনিক ছাড়া অন্য কোন ক্লিনিক থেকে কম খরচে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালে রিপোর্ট দেখেন না তিনি। এ নিয়ে রোগীদের সাথে করেন খারাপ আচরণ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের বহিঃবিভাগে ডাক্তার মেজবাহ উদ্দিন এর কক্ষের বাহিরে থাকে বেতনভুক্ত দালাল। রোগিরা ডাক্তার দেখিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে আসার পর দালালরা রোগীদের হাত থেকে ম্লিপটি ছিনিয়ে নিয়ে দেখে কি কি পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়েছেন। রোগি ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের ভুল বুঝিয়ে কম খরচে ওই পরীক্ষাগুলো করিয়ে দেবেন বলে ফুসলিয়ে নিয়ে যান বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনোষ্টিক সেন্টার গুলোতে। অথচ ওই পরীক্ষাগুলোই নামমাত্র খরচে হাসপাতাল থেকে করা যায়। পরে ওইসব ক্লিনিক থেকে দৈনিক পরীক্ষা প্রতি শতকরা নির্দিষ্ট হারে কমিশন নেন ডাক্তার মেজবাহ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ডাক্তার মেজবাহ উদ্দিন তিনটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চেম্বার করেন। আর এসব ক্লিনিকে তিনি হাসপাতাল থেকে রোগীদের পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে থাকেন।
ভুক্তভোগী গোলখালী ইউনিয়নের আলেয়া বেগম (৪০) অভিযোগ করে বলেন, গত বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) ঠান্ডা, জ্বর ও কাশি নিয়ে হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলেন। পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ১১২ নম্বর কক্ষে ডাক্তার মেজবাহ উদ্দিন এর কাছে যান তিনি। সমস্যার কথা খুলে বললে ডাক্তার তাকে স্লিপে পাঁচটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার (CBC, CXR, RBS, URINE, S. Lipid) কথা লিখে হাসপাতালের সামনে ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে রিপোর্ট করে নিয়ে আসতে বলেন। কক্ষ থেকে বের হতেই ডাক্তারের দালাল তাকে নিয়ে যায় একতা ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে একটি বেসরকারী ক্লিনিকে। কিন্তু ক্লিনিকে অনেক টাকা লাগবে শুনে পরীক্ষা না করেই ডাক্তারের কাছে ফেরত এসে তার কাছে এত টাকা নেই গরীব মানুষ বলে জানান। পরে ডাক্তার স্লিপে গরীব লিখে দিয়ে চারটি টেস্ট কেটে একটি টেস্ট করিয়ে আনতে বলেন। তখন রোগীর মনে বিষয়টি খটকা লাগে তাই তিনি পরীক্ষা না করিয়ে বাড়ি চলে যায়। পরে কিছু টাকা জোগাড় করে সোমবার ২৭ (মার্চ) পরিচিতজনের মাধ্যমে সল্প টাকায় সিকদার ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামক একটি ক্লিনিক থেকে সবগুলো টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট ডাক্তার মেজবাহ উদ্দিন এর কাছে নিয়ে আসেন। তবে সেই রিপোর্ট ডাক্তার মেজবাহ দেখবেন না বলে জানান। তাকে দীর্ঘ সময় বসিয়ে রেখে ওজন ও প্রেশার মাপা নাই বলে খারাপ আচরণ করে কক্ষ থেকে বের করে দেন।
রোগীর স্বজন ফিরোজা বেগম বলেন, আলেয়া বেগম অসহায় গরীব, তার স্বামী মৃত। ডাক্তার মেজবাহ সিকদার ক্লিনিকের নাম দেখেই রিপোর্ট সিরিয়ালের শেষে রাখেন। পরে দীর্ঘ সময় বসিয়ে রেখে রিপোর্ট না দেখেই তাদের বের করে দেন। পরে চিকিৎসা সেবা না পেয়ে ফিরতে হয় বাড়িতে।
এরকম একাধিক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে, বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে লেখালেখি করেছেন অনেক ভুক্তভোগী। কিন্তু তার কোন পরিবর্তন হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডায়াগনস্টিকের ম্যানেজার জানান, ক্লিনিক থেকে ডাক্তারকে প্রতিটি টেস্ট বাবদ শতকরায় ৫০%- ৪০% কমিশন দিতে হয়। যার কারণে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অতিরিক্ত ফি বহন করতে হয় রোগীকে। ডাক্তারকে কমিশন দেয়ায় ক্লিনিক থেকে রোগী কোন ডিসকাউন্ট পায় না।
অভিযোগের ব্যাপারে ডাক্তার মো. মেজবাহ উদ্দিন দাবি করেন, এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। তিনি বলেন, আমি রোগীদের প্রয়োজন অতিরিক্ত টেস্ট দেই না এবং তাদের নির্দিষ্ট ক্লিনিকে যেতেও বাধ্য করি না। রোগীরা পছন্দমতো ক্লিনিক থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আনেন।
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা কাজী আব্দুল মোমিন বলেন, হাসপাতালে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। যদি রোগীদের বাইরের ক্লিনিকে যেতে বাধ্য করা হয় তবে লিখিত অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।