ডেস্ক নিউজ :: ইরাকের বাগদাদ বিমানবন্দরে ড্রোন থেকে মিসাইল ছুড়ে ইরানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা ও সবচেয়ে প্রভাবশালী সামরিক কমান্ডার কাসেম সোলেমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বকে যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিলেন বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দাবি, মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে নয়, বরং যুদ্ধ ঠেকাতেই যুক্তরাষ্ট্র এ পদক্ষেপ নিয়েছে। গত শুক্রবার মিসাইল হামলায় সোলেমানির ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব শেষ হলো’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। পক্ষান্তরে ডেমোক্র্যাটরা এ ঘটনার পেছনে ট্রাম্পের ‘নির্বাচনী দুরভিসন্ধি’ থাকার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে নতুন করে আরো সাড়ে ৩ হাজার মার্কিন সেনা রওনা দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে।

কী করবে জাতিসংঘ : ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইনে বৈধতা পাবে কিনা, কী করবে এখন জাতিসংঘ, এ ঘটনার কী ধরনের বদলা নিতে পারে ইরান, তা নিয়ে সঙ্গত কারণেই নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক মহলে। বিচারবহিভর্‚ত এ হত্যাকাণ্ড বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, সোলেমানি ও অন্যদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তা পুরোপুরি বেআইনি। এ ঘটনায় জাতিসংঘের অবস্থান কী হবে তা বলা মুশকিল। বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে উঠলে ভেটো ক্ষমতার কারণে কোনো আলোচনাই এগোবে না। এদিকে সংবাদমাধ্যমে ট্রাম্প চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে বলেছেন, ভারতে নাশকতার ছকেও কাসেম সোলেমানির মদদ ছিল। ইরানে বসেই তিনি দিল্লি ও লন্ডনে হামলায় মদদ দেন। গত বছর অক্টোবর মাসে পেন্টাগনের টার্গেট ছিল আইএস জঙ্গিপ্রধান আবু বকর আল বাগদাদি। নতুন বছরের শুরুতেই টার্গেট হন ইরানের অন্যতম শীর্ষকর্তা কাসেম সোলেমানি। দুটি ক্ষেত্রেই ‘সাফল্য’ মিলেছে। কয়েক দিন আগেই বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলার জন্য সোলেমানিকে দায়ী করে ট্রাম্প বলেন, সম্প্রতি ইরাকে রকেট হানায় এক মার্কিন নাগরিকের মৃত্যু ঘটে। গুরুতর জখম হন আরো চার মার্কিন নাগরিক। বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসেও হামলার পেছনেও ছিল তারই হাত। নিজের বুক ঠুকে ট্রাম্প দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে তা অনেক আগেই করা উচিত ছিল। তা হলে অনেকের জীবন বাঁচানো যেত। তার দাবি সম্প্রতি ইরানে বিক্ষোভকারীদের দমনপীড়ন করা হয় নিষ্ঠুর সোলেমানির নেতৃত্বে। তাতে কয়েক হাজার নিষ্পাপ মানুষকে অত্যাচার করা হয়, অনেককে মেরেও ফেলা হয়।

‘ভয়ঙ্কর শাস্তি’ ঘোষণা ইরানের : সোলেমানি হত্যার ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে দেখছে ইরান। দেশটির শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে এসেছে রক্তের বদলা নেয়ার অঙ্গীকার। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আল খামেনি বলেছেন, ‘অপরাধীদের’ জন্য অপেক্ষা করছে ‘ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ’। প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের মুক্ত দেশগুলো সন্ত্রাসী আমেরিকার এ জঘন্য অপরাধের সমুচিত জবাব দেবে।
এদিকে, ৬২ বছর বয়সী জেনারেল সোলেমানির মৃত্যুতে ৩ দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছে ইরান। অভিজাত কুদস ফোর্সের নেতৃত্ব তুলে দেয়া হয়েছে এ বাহিনীর উপপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল ঘানির হাতে। তিনি বলেছেন, মার্কিনিদের যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই কঠিন শাস্তি দেয়া হবে। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পর্যবেক্ষকরা এসব নিয়ে বলছেন, সোলেমানি হত্যার বদলা নেয়ার অনেক পথই খোলা আছে ইরানের সামনে। বিবিসির সাংবাদিক জেরেমি বোয়েন বলেন, সমর কৌশলে ক্ষুরধার মস্তিষ্ক ছিল সোলেমানির। ফলে তাকে কখনো হত্যা করা হলে কী করতে হবে তেমন পরিকল্পনাও হয়ত তিনি তৈরি করে রেখে গেছেন।

ইরান যা করতে পারে : ইরানের সম্ভাব্য একটি লক্ষ্যস্থল হতে পারে সিরিয়ায় ছোট ছোট মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো। এসব ঘাঁটির কোনো কোনোটি ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী পপুলার মবিলাইজেশন ইউনিটের আওতার মধ্যেই অবস্থিত। আর যুক্তরাষ্ট্র তার সেনা সরিয়ে নেয়ায় এসব ঘাঁটির অবস্থা এখন অনেকটা দুর্বল। সিরিয়া ছাড়াও উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশগুলো, বিশেষ করে বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবও ইরানের হামলার লক্ষ্যস্থল হতে পারে। একই রকম ঝুঁকিতে রয়েছে কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের আল উদেদ ঘাঁটিও। তবে অধিকাংশের ধারণা, পাল্টা হামলার জন্য উপযুক্ত সময় ও স্থানের অপেক্ষায় থাকবে ইরান। আপাতত সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কন্টিনজেন্টগুলো এর শিকার হতে পারে। বিভিন্ন দেশে মার্কিন স্বার্থ ও নাগরিকরা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এই পরিস্থিতি এমন কী চলতে পারে বছরের পর বছর ধরেও। ইরান এমন একটি বার্তা দিতেই চাইবে যে, মার্কিন নাগরিকরা বিশ্বের কোথাও নিরাপদ নয়।

ট্রাম্পের আত্মপক্ষ সাফাই : এদিকে হামলার পক্ষে সাফাই গেয়ে ফ্লোরিডার অবকাশযাপন কেন্দ্র মার-আ-লগোতে ট্রাম্প বলেন, বিশ্বের এক নম্বর সন্ত্রাসী কাসেম সোলেমানিকে হত্যায় মার্কিন বাহিনী নির্ভুল অভিযান চালিয়েছে। মার্কিন ক‚টনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর ভয়াবহ ও নির্মম হামলার পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু আমরা আগেই বিষয়টি টের পেয়ে তাকে ধরে ফেলি ও সরিয়ে দিই। গত শুক্রবারের ওই হামলায় চরমে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে উত্তেজনা। ইরাকের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সোলেমানি হত্যার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মিলিশিয়া বাহিনীর কনভয়ে ফের বিমান হামলার খবর দিয়েছে। বাগদাদের উত্তরে ক্যাম্প তাজির কাছে ওই হামলায় ইরানপন্থি পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সের (পিএমএফ) ৬ জন নিহত হয়েছে খবর দিলেও পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

কেন এমন ঝুঁকি নিলেন ট্রাম্প? বিবিসি জানায়, সোলেমানি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের নজরে ছিলেন বহু বছর ধরে। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ও বারাক ওবামাও তাকে হত্যার পরিকল্পনা নেড়েচেড়ে দেখে পরে পিছিয়ে গেছেন। ফলে ট্রাম্প কেন এখন সেই পথে হাঁটলেন, সেই প্রশ্ন চলে এসেছে সামনে। এমন একটি সময় তিনি বেছে নিলেন যখন নিজের দেশের কংগ্রেসে তার অভিসংশনের প্রস্তাব পাস হয়ে গেছে। পরবর্তী নির্বাচনের আগে এক বছরেরও কম সময় রয়েছে তার হাতে। আর এসব কারণে বাগদাদের ঘটনার পেছনে ট্রাম্পের ‘রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি’ থাকার কথা বলছেন ডেমোক্র্যাটরা। গার্ডিয়ানের সাংবাদিক জুলিয়ান বার্গার বলেন, ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার ঘটনা বারাক ওবামার দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের প্রচারে বড় বিষয় হয়ে উঠেছিল। ট্রাম্পও হয়তো সেরকম কিছু চেয়ে এমন কাজে জড়ালেন। তবে হামলার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সম্ভাবনার পাশাপাশি পরিণতির কথাও ট্রাম্পকে ভাবতে হয়েছে। সোলেমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিখুঁত ইন্টেলিজেন্স ও অব্যর্থ হামলা চালানোর সক্ষমতার প্রমাণ দিতে পেরেছেন ট্রাম্প। পাল্টা কিছু করার আগে এটাও ইরানকে ভাবতে হবে।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি আসন্ন : এদিকে এ নিয়ে এ মুহূর্তে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা নাকচ করে দিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে চীন বা রাশিয়ার মতো শক্তিকেও এ জটিলতায় জড়াতে হবে। তবে আপাতত এ নাটকে তারা মুখ্য চরিত্র নয়।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here