খৃষ্টধর্মে আছে-মানুষের মৃত্যু নেই আছে শুধু রূপান্তর ও পূর্নজ্জীবন মৃত্যু প্রতিটি মানুষকে স্পর্শ করবে পবিত্র আল কোরআনে একথার উল্লেখ আছে। আর পবিত্র গ্রন্থ গীতায় আছে জন্ম মৃত্যু-পূর্ণজ্জম অবধারিত এ নিয়ে অনুতাপের প্রয়োজন নেই। কিন্তু তার পরেও কিছু কিছু মৃত্যু মানুষের অনুভূতিকে নাড়া দেয়। সময় সেখানে স্থীর হয়ে দাড়ায়। ঘড়ির কাটাগুলো স্তব্ধ হয়ে যায়। বহু মানুষের কষ্ট একত্রিত হয় এবং সেই কষ্ট সেই বেদনা, সমস্ত দেশকে বিশেষ কিছু স্থানকে কিছু সময়ের জন্য হলেও প্রচন্ড ভাবে প্রভাবিত করে, আলোড়িত করে।

মিঃ স্যামসন এইচ চৌধুরীর মৃত্যু এমনই একটা মৃত্যু যা সমস্ত পাবনা জেলা সহ সমস্ত দেশের তথা সমস্ত বাঙ্গালী জাতির জন্য একটি বেদনাদায়ক ও অপুরণীয় ক্ষতির কারণ সমৃদ্ধ একটি মৃত্যু। বাংলার শিল্প বাণিজ্য তথা সমগ্র সামাজিক জগতের একটি উজ্জল মহান ব্যক্তির পতনের মত।

জন্ম ঃ ১৯২৫ সালের ২৫শে সেপ্টম্বর, ফরিদপুর জেলার আরাকান্দি গ্রামে। মৃত্যু ৫ই জানুয়ারী ২০১২ সালে, সিঙ্গাপুরের বিশ্ববিখ্যাত রাফ্যেল হাসপাতালে, বাংলাদেশ সময় সকাল ১০.১৫ মিঃ। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বৎসর মাত্র।

একজন বাঙ্গালী হিসাবে এই বয়সে তাঁর তিরোধন স্বাভাবিক হলেও পাবনা সহ সারাদেশের মানুষ, ও তার অসংখ্য ভক্ত, গুণাগ্রহীরা, তার মৃত্যুকে স্বাভাবিক ভাবে মানতে চাইছেনা। হয়তো এটা তাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মানের বহিঃপ্রকাশ। সেই কারণেই তার এই হঠ্যাৎ বিদায়ের খবর পাবনা সহ সারা দেশের মানুষের মধ্যে নীরব শোকের ছায়া নেমে আসে। যেটা খুবই একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আমরা ব্যাথিত, আমরা আহত, আমরা দুঃখিত, আমরা সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহতাল্লার কাছে তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত ও শান্তি কামান করছি। আমরা প্রার্থনা করছি ঈশ্বরের কাছে তার আত্মার শান্তির জন্য। পৃথিবীতে বহু মানুষ আসে যায় পৃথিবীতে রেখে যায় তাদের অনেক মহান সৃষ্টি, মহান কৃর্ত্তী, মহান অনেক কর্মের উদাহরণ।

আমরা সাধারণ মানুষরা তাদের এই সমস্ত মহান কর্মযজ্ঞের মধ্যে খুজে পাই তাদের মহত্ব বা বিশালত্বের কথা।

মিঃ স্যামসন এইচ চৌধুরীকে হয়তো আমরা অনেকেই সেই রকম মহান মানুষের কাতারে ফেলতে চাইবো না। কিন্তু আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে তার বিস্ময়কর জীবন আচার ও জীবন যুদ্ধের মাঝে খুজে পাওয়া যায় সেই সমস্ত মহা মানুষদের সমস্ত উপাদান যেটা আমার কাছে একটি বিস্ময়কর ব্যাপার ও সেই সাথে বিশেষ ভাবে শিক্ষনীয়। তার বিচিত্র জীবনের সাফল্য গাঁথা যার শুরু খুবই সাধারণ ভাবে। এবং এখানেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তার জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া।

একজন মানুষ খুবই সাধারণ ঘরে জন্মগ্রহণ করে শুধুমাত্র নিজের সাধনা, একাগ্রতা, পরিশ্রম, স্বঅর্জিত শিক্ষা, ন্যায়পরায়নতা, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, যোগ্য লিডারশীপ প্রদানের মাধ্যমে দেশে ও দেশের সিমানা ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে সফল ব্যবসার পতাকা সমুন্নত রেখে সর্বক্ষেত্রেই সাফল্যের শ্রেষ্ঠ স্থানে পৌছে যাওয়ার ব্যাপারটিকে আমরা আমাদের শিক্ষার আমাদের অনুকরণের, আমাদের সাফল্যের প্রত্যাশার আইকন হিসাবেই চিহ্নিত করতে পারি। এখানেই আমরা পাই একজন ব্যাতিক্রমি মহান স্যামসন এইচ চৌধুরী।

মিঃ স্যামসন এইচ চৌধুরী তার জীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত করেন। আতাইকুলাতে তার ডাক্তার বাবার দোকানে বসে ঔষধ বিক্রয় থেকে ই-সন নামে ছোট্ট ঔষধ কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করে বাই সাইকেলের মাধ্যমে ঔষধ সরবরাহ করা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ভারতীয় নৌ বাহিনীতে রাডার অপারের হিসাবে কাজ করা, ১৯৪৬ সালে পাবনা হেড পোষ্ট অফিসে চাকুরী নেওয়া ও ছেড়ে দেওয়া, পরবর্তীতে পাবনা শহরে ৪ জন বন্ধুর সহযোগীতায় ১৯৫৮ সালে পাবনা শহরের শালগাড়িয়া এলাকায় মাত্র ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ওষুধ তৈরীর কাজ শুরম্ন করেন। চার বন্ধু মিলে যে ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরম্ন করেছিল তার নাম ছিল স্কয়ার ফার্মা। মাত্র ১২ জন কর্মচারী বা শ্রমিক নিয়ে ১৯৫৮ সালে একটি ছোট কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তার জীবনের গতিশীলতা ও উচ্চ আকাংখার স্বপ্নের প্রতিফলন দেখা যায়। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে তার সর্বশেষ প্রচেষ্টা তাকে আর পিছনে ফিরতে দেয় নাই। তিনি এগিয়ে গেছেন। ১৯৫৮ সালে পাবনা সহ উত্তরবঙ্গে অনেক ঔষধ কারখানা থাকলেও তার কঠোর পরিশ্রম, একাগ্রতা ও নিষ্ঠার কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই স্কয়ার ফার্মা সমস্ত কোম্পানীকে টপকিয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। যা আজকে ১২ জন শ্রমিক থেকে ২৮ হাজারে নিয়ে গেছে। ঔষধের মান বিশ্ব সেরা পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অর্জন করেছেন বহু আন্তরজার্তিক স্বীকৃতি যার জন্য তার সাথে আমরাও জাতি হিসাবে গর্বিত কারণ বহিঃবিশ্বে স্কয়ার আজকে একটি পরিচিত ব্যান্ড। যার মালিক একজন বাংলাদেশী বাঙ্গালী এবং এটাকেও আমরা মনে করি আমাদের জাতিগত অর্জন। তবে সবচেয়ে মজার এবং উল্লেখ করার মত বিষয় হচ্ছে স্কয়ার গ্রুপ শুধু ঔষধ শিল্প নয় পরবর্তীতে যেখানেই হাত বাড়িয়েছেন সেখানেই সাফল্য। মনে হয় সাফল্যের সোনার কাঠি যেন মিঃ স্যামসন এইচ চৌধুরীর হাতের মুঠায়। এখানেই তার অসামান্য কৃতিত্ব। যার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে মিডিয়া জগৎ। মাছরাঙ্গা টিভি।

স্যামসন এইচ চৌধুরীর সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে পরিছন্ন ব্যবসার উদাহরণ তিনি যেমন অনেকবার বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ করদাতার সম্মান পেয়েছেন। তার পরিচালিত সমস্ত স্থাপনায় পরিছন্ন ম্যানেজম্যান্ট এর একটি উদাহরণ যেটা সারা বিশ্বের জন্য একটি পরিচ্ছন্ন মডেল হতে পারে। বলা হয়ে থাকে-ভারতের টাটা গ্রুপের সাথে স্কয়ার গ্রুপের একটি অভিন্ন মিল আছে আর তা হচ্ছে টাটা গ্রুপের রেকর্ড হচ্ছে তাদের কোনও কারখানায় কখননো শ্রমিক অসন্তোষ দেখা যায় নাই। যেমনটি আমরা স্কয়ার গ্রুপে দেখি। এবং এটা সারা বিশ্বে একটি ভালো ব্যবস্থাপনার উৎকৃষ্ট নজির। যা বিশ্বের বহ বহুজার্তিক কোম্পানীতে ম্যানেজমেন্টের নজর কাড়ে।

তাই পরিশেষে বলতে ইচ্ছে করে আমাদের স্কুল কলেজের পাঠ্য তালিকায় অনেক মহান বা বিখ্যাত মানুষের জিবনী পড়ানো হয়, সেই ক্ষেত্রে আমাদের সামনের কিছু মানুষ যাদের কর্মময় জীবন, তাদের জীবন যুদ্ধের বর্ণনা, তাদের বড় হওয়া বা সাফল্যের সোপান, তাদের বড় হওয়ার মূল চালিকা শক্তি জানতে পারলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক শিক্ষা নিতে পারে ও তাদের ব্যক্তিগত জীবনে প্রয়োগ করতে পারে।

সর্বশেষ ঃ আমি পাবনাবাসী, আমার বাড়ীর সীমানার সাথে স্কয়ার কিন্ডার গার্ডেন স্কুল। আমার একটি আবেদন স্কয়ার কিন্ডার গার্ডেন স্কুলের নাম একটু পরিবর্তন করে স্যামসন চৌধুরীর নাম যুক্ত করা হলে আমরা স্কয়ার গ্রুপের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। সেই সাথে পাবনা শহরের একটি রাস্তার নামকরণ তার নামে হওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here