নিজস্ব প্রতিবেদক: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন এবং ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর সাথে সামঞ্জস্য করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে সংশোধনের অঙ্গীকার করেছেন। এ প্রেক্ষাপটে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দ্য রুরাল পুয়র (ডর্‌প) ১২ মে ২০২৪ তারিখ জাতীয় প্রেসক্লাবে “টাঙ্গাইল জেলার বিড়ি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, জীবিকা ও জীবনমান” শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকাশনা অনুষ্ঠান আয়োজন করে।
উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব ড. মো: জিয়াউদ্দীন, অতিরিক্ত সচিব, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব মো: আখতারউজ-জামান, যুগ্মসচিব এবং সমন্বয়ক, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, এবং জনাব ড. গাজী মো: সাইফুজ্জামান, মহাপরিচালক, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মো: আজহার আলী তালুকদার, অতিরিক্ত সচিব (অবসরপ্রাপ্ত) ও নির্বাহী উপদেষ্টা, ডরপ।

প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে টাঙ্গাইল জেলার বিড়ি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার উপর তামাকের কুপ্রভাব সংক্রান্ত একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন জনাব মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান, উপ-নির্বাহী পরিচালক, ডর্‌প। উপস্থাপনায় উল্লেখ করা হয় যে গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭ অনুযায়ী দেশে ১৫ বছর ও তদূর্ধ বয়সী তামাক পণ্য ব্যবহারাকারীর সংখ্যা ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ। পরোক্ষ ধূমপায়ীর সংখ্যা ৩ কোটি ৮৪ লক্ষ। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীর হার ২০.৬%। তামাক ব্যবহারের ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসারসহ নানাবিধ রোগে মানুষ আক্রান্ত হয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য (২০১৮) অনুযায়ী দেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে প্রতিবছর ১ লক্ষ ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়।

গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য উপস্থাপনায় দেখা যায়, অধিকাংশ বিড়িশ্রমিক তাঁদের বর্তমান পেশায় কর্মরত থাকায় অসন্তুষ্ট এবং বিড়ি কারখানায় কাজ করা ছেড়ে দিতে চান। এর পেছনে কারণ হিসেবে অনুন্নত জীবনমানকে দায়ী করেছেন ৫৩%, কাজের অতিরিক্ত চাপ ৬১%, স্বাস্থ্যঝুঁকি ৬২%, কাজের অপর্যাপ্ততা ৬৮% এবং কম মজুরিকে অসন্তোষের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ৯৫% বিড়িশ্রমিক। ৮২% শ্রমিক বিড়ি শিল্পে অসন্তুষ্ট এবং বিকল্প ও স্থিতিশীল কর্মসংস্থানের চেষ্টা করে চলেছেন। উদ্বিগ্ন হওয়ার মত বিষয় এই যে ৫৮% শ্রমিকই বিড়ি কারখানায় কাজ করার স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে অবগত নন। গবেষণায় অংশ নেয়া শ্রমিকদের ৮৫% ভোগেন শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগে। শতভাগ বিড়িশ্রমিক জানিয়েছেন যে তারা তাঁদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে এই পেশায় যুক্ত করতে চান না এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য তারা সরকারের দাবি জানিয়েছেন।

গবেষণার ফলাফল বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণের উদ্যোগের যথার্থতাকে সমর্থন করে বলে দেখা যায়। এই লক্ষে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ যে বিষয়গুলো প্রস্তাব করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- অধূমপায়ীদের সুরক্ষার জন্য সকল প্রকার পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্ত করা, তামাক পণ্যের প্রচার বন্ধ করার জন্য বিক্রয় কেন্দ্রে তামাক পণ্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, ই-সিগারেট বা ইমার্জিং হিটেড টোব্যাকো প্রডাক্ট আমদানি, উৎপাদন, ব্যবহার ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা, তামাক পণ্যের সকল প্রকার খুচরা ও খোলা বিক্রয় বন্ধ করা ও সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৫০% থেকে বাড়িয়ে ৯০% করা।

গবেষণা ফলাফল উপস্থাপনের সময় ডর্‌প বিড়ি শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কিছু প্রস্তাবনা ও সুপারিশমালা তুলে ধরে এর মধ্যে অন্যতম জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকায় এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশা থেকে বিড়ি শ্রমিকদের বাঁচাতে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া; শিশুশ্রম রোধে বিদ্যমান আইন ও বিধিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা; সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় বিড়ি শ্রমিকদের জীবিকা নির্বাহের জন্য বিশেষ প্রকল্প চালু করা; বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য বিশেষ এবং সহজলভ্য ঋণ সুবিধা এবং বিড়ি শ্রমিকদের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধি প্রশিক্ষণ প্রকল্প হাতে নেয়া।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে জনাব ড. মো: জিয়াউদ্দীন, অতিরিক্ত সচিব, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বলেন, “এই গবেষণা থেকে এটা স্পষ্ট যে বিড়ি শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের অবস্থা শোষণমূলক। ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদেরও তাদের পিতামাতার সাথে বিড়ি তৈরির প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত করা হচ্ছে। শ্রমিকদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না। সিংহভাগ বিড়ি শ্রমিক তাদের কাজ নিয়ে অসন্তুষ্ট এবং বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলে তারা বিড়ি কারখানায় কাজ ছেড়ে দিতে চান।”

তিনি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দি রুরাল পুয়র-ডর্‌পকে বিড়ি শ্রমিকদের দুর্দশা এবং উত্তরণের উপায় এই গবেষণার মাধ্যমে নীতিনির্ধারকদের কাছে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ জানান।

তিনি বিড়িশ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও জীবনমান উন্নয়নে উপস্থাপিত সুপারিশগুলোর সাথে শতভাগ সহমত জানান এবং অধীনস্ত দপ্তর ও মন্ত্রণালয় এগুলো বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

“একটি আশার কথা হলো, বিড়ি উৎপাদনের মত অমানবিক কাজে যুক্ত থেকেও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিড়ি শ্রমিকদের ৮১% চান সকল তামাকপণ্যের কর ও মূল্য উচ্চহারে বৃদ্ধি করা হোক,” বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জনাব মো: আখতারউজ-জামান, যুগ্মসচিব এবং সমন্বয়ক, তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারকে সামনে রেখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং আমরা আশাবাদী যে তামাকের প্রাদুর্ভাব অচিরেই দেশ থেকেই বিদায় নেবে।”

ডর্‌প বিগত ১৯৮৭ সাল থেকে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচীর সাথে জড়িত এবং মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রবর্তনকারী সংস্থা হিসাবে সমধিক পরিচিত। এরই ধারাবাহিকতায় ডর্‌প বর্তমানে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও তামাক কর বৃদ্ধি বিষয়ে কাজ করছে এবং সরকারের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here