সোহানুর রহমান ::
আজ থেকে ৫০ বছর আগে স্টকহোমে মানব পরিবেশ বিষয়ক জাতিসংঘ সম্মেলনের জন্য সমবেত হওয়ার মধ্য দিয়ে পরিবেশ বাঁচানোর অন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। প্রথম জাতিসংঘ আলোচনার টেবিলে আনা হয়েছিল স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অধিকার। পরিবেশের সাথে মানুষের মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কিত বিশ্বের প্রথম সম্মেলন ১৯৭২ সালে সুইডেনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সম্মেলনের ৫০ বছর উৎযাপন উপলক্ষে আজ থেকে (২রা জুন) সুইডেনে শুরু হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন স্টকহোম+৫০। ঠিক ১৯৭২ সালের মত, মানুষের এবং পৃথিবীর সুবিধার জন্য জলবায়ু, পরিবেশ এবং উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার একটি ঐক্যতানের সুর বাঁধতে বিশ্ব রাজনীতির হাওয়া বদলে দিতে পারে স্টকহোম+৫০ সম্মেলন।
এই সম্মেলনটিই হতে পারে প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাণ-বৈচিত্র্য ও জলবায়ুর সাথে আমাদের সম্পর্ককে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে অগ্রগামী হওয়ার দিগন্ত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি উদযাপন করার সময়ে আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা একটি টেকসই ভবিষ্যতের জন্য তার অঙ্গীকার পূরণ করছে না। বিশ্ব নেতারা ১৯৭২ সালে স্টকহোম সম্মেলনে অংশ নিয়ে যেসব অংগীকার করেছিল তা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে ৷ আমরা বর্তমানে পরিবেশ ও জলবায়ু পরির্বতন সংক্রান্ত মানবসৃষ্ট যে প্রধান তিনটি সংকটে বাস করছি তা সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে বিশ্ব নেতারা একই ভাবে বারংবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
স্টকহোম সম্মেলনের অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও বিশ্ব আগে যেখানে ছিল আজও সেখানেই পরে আছে। বরং সংকট আরো ঘণীভূত হয়েছে। পরিবেশ নিয়ে সফল বনভোজন হয়েছে, ফেস্টিভ্যাল হয়েছে। তবে আদতে ভয়াবহ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণের উদ্ধগামী রেখচিত্র এতটুকু রোধ করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য দূষণকারীদের কাছ থেকে ন্যয্যি হস্যা নিশ্চিত করা যায়নি। মোদ্দাকথা হচ্ছে, দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর পদক্ষেপ এবং ক্ষতিপূরণ পরিশোধ ছাড়া সব জলবায়ু ও পরিবেশ সম্মেলন অর্থহীন, ফলশুন্য!
এবার আসি স্টকহোম সম্মেলনের গোড়ার কথায়। ১৯৭২ সালে, ১২২টি দেশের প্রতিনিধিরা কীভাবে বৈশ্বিক পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তা পুনর্লিখন করে যা স্টকহোম ঘোষণা এবং মানব পরিবেশের জন্য কর্ম পরিকল্পনা হিসাবে পরিচিতি পায়। সম্মেলনটির সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট ফলাফলগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি প্রতিষ্ঠা লাভ। তবে এই সম্মেলনেই রাষ্ট্রগুলো ‘স্বাধীনতা, সমতা এবং জীবনের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা লাভ, এমন পরিবেশে যা মর্যাদা ও কল্যাণকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, স্টকহোম পরিবেশ সম্মেলনের ২০তম বার্ষিকীতে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত হয় ধরিত্রী সম্মেলন। এই সম্মেলনে ১৭২টি দেশের দুই হাজার ৪০০ প্রতিনিধি অংশ নেন। ১২ দিন ব্যাপি আলোচনা আর বিতর্কের মধ্য দিয়ে ২৭টি নীতিমালা নিয়ে ঘোষণা করা হয় ‘রিও ডিক্লারেশন’। গৃহীত হয় আটশ পৃষ্ঠার এজেন্ডা-২১। শুধু তাই নয়, এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে স্বাক্ষরিত হয় জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক জাতিসংঘ রূপরেখা (ইউএনএফসিসিসি), যা ১৯৭টি সদস্য দেশের সম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। আরো সিদ্ধান্ত হয় কাজের অগ্রগতি মূল্যায়নে প্রতি বছর আয়োজন করা হবে ‘কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ’ বা কপ সম্মেলন। প্রথম কপ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ধরিত্রী সম্মেলনের ৩ বছর পর ১৯৯৫ সালে জার্মানির বার্লিন শহরে। ২০১৫ সালে কপ২১ অনুষ্ঠিত হয় ফান্সের প্যারিস শহরে, গৃহীত হয় প্যারিস জলবায়ু চুক্তি।
ঐতিহাসিক স্টকহোম পরিবেশ সম্মেলন ও ধরিত্রী সম্মেলনের পর একে একে আরও ২৬টি শীর্ষ জলবায়ু বৈঠক প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী। যেখানে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে পরিবেশ বিজ্ঞানী, অধিকারকর্মীসহ লাখ লাখ প্রতিনিধি জমায়েত হয়েছেন। হাজার হাজার ঘণ্টা ধরে আলোচনা-বিতর্ক, দরকষাকষি হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ‘পৃথিবীকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য’ করার লক্ষ্যে সুমিষ্ট প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি দিয়েছেন বিশে^র হর্তাকর্তারা। ‘ঐতিহাসিক’ অনেকগুলো চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। যার বড় প্রমাণ স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে সদ্য অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ২৬। আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তি, পরিবেশ নীতি ও জাতীয় পরিবেশ আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগের পাশাপাশি মাথা পিছু কার্বন নির্গমণ হার কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও সে কথায় কর্ণপাত করছে কে? বিজ্ঞানের কথা না শুনে, পুঁজিবাদী দেশগুলো জলবায়ু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। যদিও এটি ছিল তাদের একটি ঐতিহাসিক দায়। যে দায়ভার উপেক্ষা করা মানে মানবতা, জীববৈচিত্র্য এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে এক ধরনের অপরাধ সংগঠিত করা। তাদের নির্গমনই আমাদের এই একমাত্র বসবাসযোগ্য গ্রহকে গভীরে সংকটে ফেলেছে।
সময় ফুরিয়ে আসছে। আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় থাকলেও এর সঠিক ব্যবহার না করে বিশ্ব নেতারা কালক্ষেপণ করেছেন। কিন্তু ফাঁকা গাল ভরা বুলি এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা লংঘন করার দিন শেষ। কারণ, এখন বিলম্ব মানেই ঠায় মৃত্যু! ‘একটাই মাত্র পৃথিবী।’ এখানকার পরিবেশ কলুষিত হলে দ্বিতীয় আর কোন পৃথিবীতে যাওয়ার সুযোগ নেই আমাদের। তাই পৃথিবী বাঁচানোর শেষ সুযোগ হচ্ছে স্টকহোম+৫০ সম্মেলন।
মানবাধিকার এবং পরিবেশের মধ্যে একটি নিগুঢ় সংযোগ রয়েছে । তাই স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অধিকার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে অর্জন করতে স্টকহোম+৫০ হচ্ছে একটি মোক্ষম হাতিয়ার। কারণ, স্টকহোম ঘোষণার প্রথম দফায় স্বাস্থ্যকর পরিবেশকে ‘জীবনের অধিকার’ এবং ‘মৌলিক মানবাধিকার’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে দু:খের বিষয় হচ্ছে, এই অধিকারটিকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বিশ্বের ৪৯ বছর লেগেছে।

তবে আমরা বর্তমান ব্যর্থ নেতাদের মত স্টকহোম+১০০ সম্মেলনে অংশ নিতে চাইনা, যারা তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মমের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আমাদের লক্ষ্য ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই, পরিচ্ছন্ন এবং বাসযোগ্য পরিবেশ রেখে যাওয়া। বিশ্ব নেতাদের উচ্চাকাংক্ষা এবং মিষ্টি কথাবার্তাকে কর্মে পরিণত করা এবং একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসাবে একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আমরা বদ্ধপরিকর।