হোসেইন জামাল

হোসেইন জামাল :: করোনা পরবর্তী বিশ্বে আমাদের ভালো ভাবেই টিকে থাকতে হবে। কিন্তু উপায় কী। যদি দিনরাতের হিসেব করি, আমেরিকা ও কানাডা আমাদের চেয়ে প্রায় একদিন পিছিয়ে। অথচ আমাদের রপ্তানির সিংহভাগ এরকম কয়েকটি দেশে হয়ে থাকে। আমেরিকা আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস। তবে আমরা রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি করি। মানে আমরা সব সময় মাইনাসে আছি।

করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা এই মাইনাস আরো বেড়ে যাবে। একমাত্র রপ্তানির প্রবাহ বাড়ানো ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। এদিকে রপ্তানিকারকদের বরাবরই একটা অভিযোগ আছে। সেটা হল- রপ্তানিকারক দেশগুলোর থেকে আমরা তিনদিন পিছিয়ে আছি।

তাই আমাদের প্রাপ্য অর্ডারগুলোও পাচ্ছি না। এগুলো ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশে চলে যাচ্ছে। কারণ হল শুক্রবার ও শনিবারের সরকারি ছুটি। রপ্তানির যা কিছু করতে হবে ওই তিনদিনের ঝামেলা মাথায় রেখেই সামলাতে হবে। তাই আর্জেন্ট অর্ডারগুলো হাতছাড়া হয়ে যায়। যার কারণে প্রায় প্রতিদিনই অন্তত একটি পোশাক কারখানায় বন্ধ হচ্ছে!

এছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বলতে একটা কথা আছে। সেই বাণিজ্যিক হিসেবে আমরা পিছিয়ে থাকি। যেমন, বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসে গার্মেন্টস শিল্প থেকে। বর্তমানে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি করা হয়।

এর মধ্যে রপ্তানিকৃত যে মাল বৃহস্পতিবার শুরু শিপিং করা হল, তার পেমেন্ট হাতে পেলাম সোমবার। এর মধ্যে ডলারের দামের হেরফের হতে পারে। কিন্তু আমাদের পেমেন্ট পেতে হবে বৃহস্পতিবারের ডলারের দামে। এর মধ্যে যদি শুক্রবার ও শনিবার খোলা থাকতো, তবে পেমেন্ট দ্রুত পাওয়া সম্ভব হতো। ক্ষতির পরিমাণও কমে যেতো অনেকাংশে।

রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস বন্ধ হচ্ছে দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটির ফাঁদে পড়ে। এজন্য ছুটির দিন কাটছাঁটের আবেদন অনেক দিন থেকে চলে আসছে। তবে সরকারের কাছেও মোক্ষম জবাব আছে। সরকার বলছে, আমরা তো আর তেল উৎপাদনকারী দেশ নয়। তেল কিনে চলতে হয়!একদিন বন্ধ রাখলে পাক্কা তিনশ কোটি টাকা বেঁচে যায়!

টাকা বাঁচার কথা বাদ দিলাম, আমিও দুইদিন ছুটি রাখার পক্ষে। তার একটা বাস্তব উদাহরণ দেই। একটি ছোট ওষুধ কোম্পানি অনেক চেষ্টার পরও মাসিক গড় বিক্রি এক কোটি টাকার বেশি করতে পারছিল না। এভাবে কেটে গেল অনেকগুলো বছর, কিন্তু কোনো বুদ্ধিই কাজে লাগছিল না। বিক্রির হাল-অবস্থা দীর্ঘকাল অপরিবর্তিত ছিল।

অবশেষে দূরদর্শী মালিক সপ্তাহে দুইদিন ছুটি ঘোষণা করলেন। ব্যস, তাতেই কাজ হলো। পরের মাসেই বিক্রি এক কোটি টাকা অতিক্রম করল; আজও তা অব্যাহত আছে। সঙ্গত কারণেই কোম্পানির নাম প্রকাশ করলাম না; কিন্তু ঘটনা সত্য।

অধিকাংশ মালিকপক্ষ মনে করেন- বেশিক্ষণ অফিসে আটকে রাখলেই বুঝি বেশি কাজ আদায় করে নেওয়া যায়। এটা যে কত বড় ভুল ধারণা সেটা যদি বুঝতেন, তাহলে হয়ত সপ্তাহে তিনদিন ছুটিরই বন্দোবস্ত করতেন।

কেউ যদি প্রত্যেক দিন ৩-৪ ঘণ্টা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করেন, তার টেবিলে কোনো কাজ আটকে (pending) থাকার কথা নয়। যাদের টেবিলে ফাইলের স্তূপ জমে থাকে, তারা সেটা ইচ্ছে করেই করেন! তারা মালিককে দেখানোর জন্য অনেক রাত পর্যন্ত অফিসেও থাকেন, কিন্তু আসলে কাজ করেন সবার চেয়ে কম!

সাপ্তাহিক ছুটি দুইদিন করা হলে প্রথমত অফিসের খরচ (শনিবারে বিদ্যুৎ, পানি, এসি ইত্যাদি) কমবে। দ্বিতীয়ত, কর্মীদের পিছুটান কমে যাবে। সত্যি কথা বলতে কি, শুক্রবার একদিনে পরিবারের সব কাজ গুছিয়ে শেষ করা যায় না; দিনের বেশ খানিকটা সময় ধর্মীয় কারণে ব্যয় হয়। তারপর বাজার করা, কাপড় ধোয়া ইত্যাদি আবশ্যকীয় কাজ থাকে; সামাজিক অনুষ্ঠানেও যেতে হয়। সেই অর্থে শরীরের বিশ্রাম আর হয় না।

ছুটি দুইদিন হলে মানুষ সকল পারিবারিক ও সামাজিক প্রয়োজন মিটিয়ে বাকি পাঁচদিন পূর্ণ উদ্যমে কোম্পানির কাজে মনোনিবেশ করতে পারবেন। ফলে কর্মীদের উৎপাদন ক্ষমতাও বহুগুণ বেড়ে যেতে বাধ্য। এমনকি প্রত্যেককে বছরে একবার LFA-সহ টানা দুই সপ্তাহের ছুটিতে পাঠানো উচিত।

মোট আউটপুট এখনকার চাইতে বেশি বৈকি কম হবে না। সর্বোপরি ভালো কর্মীদের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। সপ্তাহে একদিন ছুটি বাড়লে কর্মীদের চাকরির প্রতি দায়িত্ব ও মায়া বহুগুণ বেড়ে যায়।

সমগ্র বিশ্বে সপ্তাহে দুইদিন ছুটিই প্রচলিত। এমনকি জাপানে দুপুরে খাওয়ার পর কর্মীদের অফিসেই আধাঘণ্টা ঘুমানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। এতে করে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা কমেনি, বরং বেড়েছে। পাশ্চাত্য বিশ্ব এখন সপ্তাহে তিনদিন ছুটির যৌক্তিকতা নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়েছে।

তবে আমরা তিনদিন ছুটি চাই না। দুইদিনই থাকুক, তবে অবশ্যই শুক্রবার ও শনিবার ছুটি নয়। এটা হওয়া উচিত সোমবার ও মঙ্গলবার। কারণট বলি, আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায় কোমর বেঁধে আমাদের কাজ করতে হবে। ফাঁকিবাজি করলে চরম মূল্য দিতে হবে।

তাই রপ্তানিতে পিছিয়ে থাকা তিনদিনের গ্যাপ কমাতে হবে। যেহেতু আগেই বলেছি আমেরিকার ও কানাডার মতো কয়েকটি দেশ আমাদের রপ্তানির প্রধান দেশ। এদের সাথে আমাদের সময়ের পার্থক্য কমপক্ষে ১০ ঘন্টা। অর্থ্যাৎ এরা আমাদের চেয়ে ১০ ঘন্টা পিছিয়ে আছে। আমাদের শুক্রবার সকাল ১০টা হলে এদের বৃহস্পতিবার রাত ২টা।

তাই আমাদের সোমবার ছুটি হলে ওদের রবিবারে ছুটির সঙ্গে অনেকটাই সমন্বয় হয়ে যাবে। আর আমাদের মঙ্গলবার ছুটি হলে মাত্র একদিনের ছুটির গ্যাপ হবে। ফলে রপ্তানিতে সমস্যাও খুব একটা হবে না। করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে এটা করা খুবই দরকার।

তবে প্রশ্ন হলো, আমরা মুসলিম প্রধান দেশ। শুক্রবার জুমার নামাজ আছে। এদেশে এরশাদের আমলে কিন্তু রবিবার ছুটির দিন ছিল। পরে এরশাদের পতনের আন্দোলন শুরু হলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমর্থন পেতে শুক্রবার ছুটির দিন ধার্য করা হয়। এটা ছিল একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত।

পরবর্তী সরকারগুলো এই হঠকারী সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারেনি। ১৯৯৬ সালের ২৯ মে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা শনিবারকেও সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করে। ওই সময় বিএনপি অনেক সমালোচনা করলেও ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে চুপসে যায়। আসলে সবাই উন্নয়নের বিপক্ষে অবস্থান নিতে রাজি, তবে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মন ভাঙতে রাজি নয়।

বর্তমান বিশ্বে ভালো ভাবে বাঁচতে গেলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। বিশ্বের সাথেও তাল মিলিয়ে চলতে হবে। এজন্য শুক্রবার জুমার নামাজের সময় দেড় ঘন্টা ছুটি দেওয়া যেতে পারে। এই দেড় ঘন্টার জন্য তিনদিন অপচয় করে হাজার কোটি টাকা নষ্ট করাটা বিলাসিতা নয় কী?

 

 

 

 

লেখকঃ ব্যাংকার এবং সাবেক গণমাধ্যমকর্মী। 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here