বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় এক মাসে বারো জন মানুষ বাঘের হাতে মারা যাওয়ার পর বনের আশেপাশের গ্রামগুলোতে তীব্র আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এসব ঘটনা ঘটেছে সুন্দরবনের পশ্চিম অংশে এবং সেখানকার একটি এলাকাতেই বাঘের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন আটজন।
বন বিভাগের কর্মীরা জানিয়েছেন, বেশীরভাগ মৃত্যু ঘটেছে একটিমাত্র বাঘিনীর হাতে।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মনে করেন, আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোন পরিস্থিতি এখনো হয় নি।
বন ছেড়ে লোকালয়ে বাঘ চলে এলে তা আবার জঙ্গলে ফেরত পাঠাতে গঠিত টাইগার রেসপন্স টিমের সদস্য ছিলেন কওসর আলী মোড়ল।
বনের তিন কিলোমিটার ভেতরে মাছ ধরতে যাওয়া একটি দলে তিনি ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছেলে সেরাজুল ইসলাম, যিনি জানান যে তাঁর সাহসী পিতা একটি শব্দ শুনে একা সামনে এগিয়ে যান এবং এরপর তিনি বাঘের কবলে পড়েন।
”শব্দ শুনে আমরাও লাঠিসোঁটা নিয়ে সেখানে হাজির হলাম। কিন্তু আমরা গিয়ে দেখি তিনি মারা গেছেন, আর তাঁর মুখ ও ঘাড় থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে।” বিবিসি বাংলাকে বলেন সেরাজুল ইসলাম।
ঐ ঘটনার পর কওসর আলী মোড়লের গ্রাম মীরগাঙ্গে বাঘের আতঙ্ক বেড়েছে। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঐ গ্রামের লোকজন সন্ধ্যের পর আর বাড়ি থেকে বের হন না।
এক অবস্থা সুন্দরবনের পাশের আরেকটি গ্রাম গোলাখালিতেও। ঐ গ্রামের জামির হোসেন বলছিলেন যে বাঘের ভয়ে মানুষের জীবনযাত্রাই পাল্টে গেছে।
তিনি বলেন, আমরা এতটাই ভয় পাচ্ছি যে সন্ধ্যের পরপর ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করছি, আর খুলছি পরের দিন সূর্য্য ওঠার পর।
প্রতিদিনই বাঘ লোকালয়ে ঢুকছে বলে জানান জামির হোসেন। তিনি বলেন, দিন দুয়েক আগে বাঘের তাড়া খেয়ে গ্রামের দু’জন বাসিন্দা মাছের ঘেরে লাফিয়ে পড়ে জীবন বাঁচান। এ পর্যন্ত বাঘ গোটা চল্লিশেক ছাগল খেয়েছে।
চল্লিশ-বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী বলেন যে গত ৩৫ বছর যাবৎ তিনি গোলাখালিতে বাস করছেন, কিন্তু এর আগে তিনি লোকালয়ে বাঘের এত আনাগোনা দেখেন নি।
সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগের বন কর্মকর্তা জহিরউদ্দিন আহমেদ জানান, জানুয়ারি মাস থেকে শুরু করে ও পর্যন্ত ১২ জন মানুষ বাঘের হাতে মারা যান এবং এদের সবারই মৃত্যু ঘটেছে বনের ভেতরে।
এর মধ্যে বনের খুলনা অংশের একটি এলাকা, যেটি ৪০ নম্বর কমপার্টমেন্ট নামে পরিচিত, সেখানেই মৃত্যু ঘটেছে আটজনের।
তবে এসব মৃত্যু মানুষখেকো বাঘের হাতে ঘটেনি বলে মনে করেন মিঃ আহমেদ।
তিনি বলেন, ঐ বাঘিনীটি বাচ্চা সহ সেখানে অবস্থান করছে। কেউ বাচ্চাটির ক্ষতি করতে পারে বলে এটি ভয় পাচ্ছে। তাই বাওয়ালীরা এটির আক্রমণের শিকার হচ্ছে।
সুন্দরবনে মাত্র এক মাসে বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও তাকে খুব বেশি অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন না বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা।
ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলছেন, ২০১০ সালে সুন্দরবনে বাঘের হাতে মৃত্যু ঘটেছে ৩৭ জনের, আর ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৪।
তিনি বলেন, এই সংখ্যা যদিও এখনো অনেক বেশি, তারপরও গত ১০০ বছরের পরিসংখ্যানের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে যে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা সম্প্রতি খুব একটা বাড়েনি বা কমেনি।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি আরো বলেন, ২০০৮-৯ সালে টাইগার রেসপন্স টিমের সদস্যরা লোকালয়ে বেরিয়ে আসা বাঘ আবার জঙ্গলে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। আর জঙ্গলে বাঘের হাতে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা কোন বছরে হয়তো কিছুটা বেড়েছে, আবার কোন বছর আবার কমেছে।
সুন্দরবনের কর্মকর্তারা জানান, বাঘের হাতে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঠেকাতে বনের যে অংশে বাচ্চা নিয়ে বাঘিনীটি অবস্থান করছে, সেখানে বাওয়ালীদের যাওয়া আপাতত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/স্টাফ রিপোর্টার