হোসেইন জামাল

হোসেইন জামাল :: ব্যাংকে চাকরি করা হারাম। এটা সুদের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ রকম বহু চমকপ্রদ কথা বলে ওয়াজের মাঠ গরম রাখেন মৌলভীরা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, শুধু মাঠ গরম রাখার জন্য এমন কিছু প্রসঙ্গ তাদের টেনে আনতে হবে। শ্রোতাদের মধ্যে সাড়া ফেলে দিতে হবে।

এক মাঠ গরম রাখতে পারলে আরেক মাঠের দখল নেওয়া সম্ভব। আজকের পরিচিত আগামী দিনের আর্থিক সমৃদ্ধি। এমন মৌলভীদের সঙ্গে টিভি সংবাদকর্মীদের একটা জায়গায় মিল আছে। সেটা হল-কাটছাঁট। অর্থ্যাৎ যেটা আমার জন্য সুবিধাজনক আর জনগণ খাবে, তা প্রকাশ করতে হবে।

জনগণকে খাওয়াতে গিয়ে আপনি যে আংশিক সত্য উপস্থাপন করছেন বা পরের অংশ বা আরো প্রাসঙ্গিক তথ্য প্রকাশ করছেন না, তা কী ন্যায়সঙ্গত? কারণ আমরা যারা আপনার কথাগুলো আপ্তবাক্যের মতো গিলছি, বিনা প্রশ্নে মেনে নিচ্ছি, সেই আমরা তো সঠিক তথ্য পাচ্ছি, তাই না।

আমি মনে করি, যে বিষয়ে ওয়াজ করা হয়, তার ইনস এন্ড আউট বলা উচিত। কথার মধ্যে ফাঁক-ফোঁকর রেখে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ রাখা কি ঠিক। এই ধরেন সূরা আলে-ইমরানের ১৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, তোমরা চক্রাকার সুদ খেয়ো না। আল্লাহকে ভয় করো।

মৌলভীরা এখানে ‘চক্রাকার’ সুদের কথা বলেন না। বলনে, শুধু সুদের কথা। আর বাংলাদেশের কোন ব্যাংকে চক্রাকার সুদের ব্যবস্থা নেই। এখানে চক্রাকার সুদ মানে সুদের সুদ, যা চক্রবৃদ্ধি আকারে বাড়ে। ব্যাংকে এমন ব্যবস্থা থাকলে বহু ঋণগ্রহীতা সারা জীবনেও ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারতো না।

আবার সূরাহ বাকারাহ’র ২৮০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ঋণগ্রহীতা যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তাকে চাপ দিয়ো না, বরং তার স্বচ্ছলতা ফিরে আসা পর্যন্ত অবকাশ দাও। এমন বিষয়ে তো ওয়াজ কখনো শুনিনি। এটা নিয়ে ওয়াজ করলে ব্যাংকগুলো তো নতুন একটা বিষয় জানতো, মানুষের উপকার হতো। যদিও ব্যাংকগুলো এমন ঋণকে মন্দঋণ হিসাবে সমপরিমাণ অর্থ প্রভিশনে রেখে দেয়।

আবার একই সূরাহর ২৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, হে ঈমানদারগণ, তোমরা যখন পরষ্পরের সাথে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণের চুক্তি করবে, তখন তা লিখে রাখো। তোমার মধ্যে যে কোন একজন লেখক সুবিচারের ভিত্তিতে চুক্তিনামা লিখে দিবে। যাকে আল্লাহ তায়ালা লেখা শিখিয়েছেন, সে যেন অস্বীকৃতি না জানায়। কি কি শর্তে ঋণ নেওয়া হচ্ছে, তা স্পষ্টভাবে লিখবে, কোনকিছু যেন বাদ না পড়ে। আর দুইজন পুরুষ স্বাক্ষী রেখো। পুরুষ না পেলে একজন পুরুষের বদলে দুইজন নারীকে স্বাক্ষী রাখবে।

উপরোক্ত আয়াতের বিষয় নিয়ে কখনো কি আলোচনা হয়েছে, আমার জানা নেই। তবে এই আয়াত দ্বারা বর্তমান ঋণের বিষয়গুলো কি বোঝানো হয় না? যেখানে ব্যাংকের সাথে গ্রাহকদের চুক্তি হয় এবং তা লিখিত। সাথে দুইজন পুরুষ স্বাক্ষী থাকে। এক্ষেত্রে ব্যাংকারগণ হলেন একজন লেখক, যিনি লেখাসহ অন্যান্য কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক নেন।

ব্যাংকের লাভের হিস্যা ব্যাংকারগণ পায় না, যে বোনাসের কথা বলা হয়, তাও অনেক কাঠখড় পোড়ানো মানে সরকারের সঙ্গে দেন-দরবারের পর হাতে আসে। এটা যারা জানেন না, তারা তার কষ্টের হিসাব বুঝবেন না। আবার চুক্তিতে যদি কোন গলদ না থাকে, তবে লেখক চুক্তির কোন বিষয়ের জন্য দায়ী নন। এটা পুরোপুরি ব্যাংক ও তার গ্রাহকের বিষয়। তাহলে এখানে ব্যাংকারগণ কি পবিত্র কুরআনের সূরাহ বাকারাহ’র বর্ণিত সেই লেখক?

যদি লেখক হন, তবে সুদের দায়ভার কার? আর নির্দিষ্ট সময়ের ঋণের চুক্তির ব্যাপারে আল্লাহ যা বলেছেন, সেটা যদি ঠিক থাকে, তবে ব্যাংক থেকে গ্রাহককে ঋণ প্রদানের পর তার কাছ থেকে আসল ও যে মুনাফা আদায় করা হয়, তা সূরাহ আলে ইমরানে বর্ণিত সেই চক্রাকার সুদ নয়?

যদি না হয়, তবে চক্রাকার সুদ কী। আর সেটা কারা প্রদান করে। আর সূরা বাকারাহ’র ২৮২ আয়াতে বর্ণিত চুক্তিভিত্তিক নির্দিষ্ট মেয়াদের ঋণের সুদ আসলে কী? এটা যদি প্রদেয় ঋণের মুনাফা হয়, তবে কি এটা বলা যাবে ব্যাংকে চাকরি করা হারাম?

আমি মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের এক সরিষা পরিমানও বুঝি না। বাংলা অনুবাদ পড়ে যা বুঝতে পেরেছি তা লিখলাম। ভুলভ্রান্তির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। তবে কোন ইসলামি পন্ডিত যদি উপরোক্ত বিষয়ের সঠিক জবাব দেন, তবে ব্যাংকে চাকরিরত দেড় লক্ষাধিক ব্যাংকারের মনে শান্তি আসে।

আর যদি না পারেন, তবে অনুরোধ, আংশিক ওয়াজ করবেন না। ইসলামের ঝান্ডা যখন হাতে নিয়েছেন, তখন মানুষকে সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করুন। এতে আমার আপনার সবার দুনিয়া ও আখিরাতের মঙ্গল হবে। আল্লাহ আমাদের সঠিক তথ্য বোঝার তৌফিক দান করুন। আমিন….

 

 

 

লেখকঃ ব্যাংকার এবং সাবেক গণমাধ্যমকর্মী।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here