“সামিয়া আমাদের ক্ষমা করো”মিলন কর্মকার রাজু :: “ সামিয়া আমরা ক্ষমা চাচ্ছি, তুমি আমাদের ক্ষমা করো। আমরা জানি ওই পৃথিবীতে গেলেও তোমার কোমল হৃদয় আমাদের ক্ষমা করে দিবে। কিন্তু আমরা পাপী। তোমার ক্ষমার যোগ্য নই আমরা। কারন আমরা তোমায় নিরাপত্তা দিতে পারিনি। তোমার অকাল মৃত্যু আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরন হচ্ছে। এই রক্তের স্রোত বহমান না থাকায় তোমাকে দেখাতে পারছি না।

অথচ তোমার লাশ যে আন্ধারমানিক নদীতে দীর্ঘ প্রায় ৫২ ঘন্টা জোয়ার-ভাটায় এ মোহনা থেকে অন্য মোহনায় ভেসে চলেছিলো সেখানে হাজার হাজার মানুষের চোখ ছিলো। কিন্তু তোমার ছোট্র দেহ আমাদের সেই দৃষ্টিতে পড়েনি। এ অপরাধ আমাদের”।

কলাপাড়ার হাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিলো সামিয়া। নতুন বছরে স্কুলে যাবে তাই নতুন পোষাক, স্কুল ব্যাগ ও জুতাও কিনেছিলো সামিয়ার জন্য তার বাবা-মা। কিন্তু সেই সব এখন আর পড়া হয়নি। সামিয়ার সেই পোষাক, ব্যাগ বুকে নিয়ে  কেঁদেই চলছে তার বাবা-মা।

পুলিশ, কোষ্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস তোমাকে “সন্ধান” করেছে এ দাবি তাদের। কিন্তু তারা তোমার সন্ধানের চেয়ে ব্যস্ত ছিলো ঘাতক ট্রাকটি উত্তোলনে। যে ঘাতক ট্রাক তোমার প্রান কেড়ে নিয়েছে এ ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি। কি কারনে এই দূর্ঘটনা ঘটেছে তার জন্য গঠিত হয়নি কোন তদন্ত কমিটি। কিন্তু কেন.. এই প্রশ্নের উত্তর তোমার অসুস্থ্য মা-বাবা, তোমার কাছের প্রিয় দাদী কিংবা চাচা বা বোনেরা যেমন বলতে পারছে না, তেমনি আমরাও জানি না কেন..?

মঙ্গলবার রাত আনুমানিক সাড়ে ৮টা। যে রাক্ষুসে নদী তোমাকে ভাসিয়ে নিয়েছিলো সেই আন্ধারমানিক নদীই তোমার লাশ ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। আমরাও আশা করিনি তুমি দীর্ঘ ৫২ ঘন্টা যুদ্ধ করে বেঁচে থাকবে। অপেক্ষায় ছিলাম কখন তোমার হাসিমাখা আদুরে মুখ না হোক অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়া মুখটি দেখতে পাবো। তোমার পরিবারের মতো আমরাও অপেক্ষায় ছিলাম তোমার মৃতদেহের ।

সওজ’র নিয়ম অনুযায়ী ফেরির এক কিলোমিটারের মধ্যে কোন নৌকা-ট্রলার ভেড়ানো যাবে না। কিন্তু এই আইন প্রয়োগ হয়নি। তিনটি তাজা প্রান এক ঘাতক ট্রাক চালকের অসাবধানতায় কেড়ে নিয়েছে গত রোববার সন্ধায় যাত্রী বোঝাই খেয়া নৌকার উপর পড়ে খেয়া ডুবিতে। কিন্তু এখনও সেই ফেরির পাশেই প্রতিদিন ভেড়ানো হচ্ছে খেয়া নৌকা।

ওই ফেরিঘাট থেকেই প্রতিদিন অন্তত অর্ধশত ট্রলার-নৌকা ছেড়ে যাচ্ছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। কিন্তু আইন প্রয়োগ হচ্ছে না। এর দায় কার..?

ফিরে যাই রোববার রাতে। রাত যখন পৌনে ১২ টা তখন আন্ধারমানিক নদীর প্রায় ৩০ ফুট নিচ থেকে উদ্ধার করা হয় সেই ঘাতক ট্রাকটি। ঘটনাস্থলে উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু যে ইট বোঝাই ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে তিনটি প্রান ঝড়ে গেছে নদীর নিচে পড়ে থাকা সেই ইট উঠিয়ে দেখা হয়নি কেউ চাপা পড়ে আছে কিনা।

সামিয়া তুমি আমাদের ক্ষমা করো। তোমার জন্য কলাপাড়ার গোটা এলাকার মানুষ আজ কাঁদছে। তোমাকে খুঁজে পেতে নিঃস্বার্থভাবে অনেক স মানুষ খুঁজেছে নদীর এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। স্থানীয়রাও নদীর তলদেশে তোমাকে খুঁজেছে তোমাকে তুলে দিতে তোমার বাবা-মায়ের কোলে। হোক না মৃত। কিন্তু আমরা সেখানেও ব্যর্থ।

আমরা হাসপাতালে তোমার মা রুবি ও বাবা সেলিম সরদারের আর্তনাদ শুনেছি তোমাকে ফিরে পাওয়ার জন্য গত দুইদিন ধরে। আমাদের বিশ্বাস তোমাকে বাঁচাতে গিয়েই তারা আহত হয়েছে। কিন্তু ঘাতক ট্রাক তোমাকে চিরবন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়েছে। এই পৃথিবীতে বাবা-মা ও পরিবারের সাথে কিছু সুখের মুহুর্ত ছাড়া আর কিছুই তোমার দেখা হয়নি। মাত্র ছয় বছর বয়স তোমার।

ভালো করেছে তুমি আমাদের ছেড়ে, যে পৃথিবীতে কোন,নিয়ম-কানুন নেই। আইন থাকলেও বাস্তবায়ন হয়না সেই পৃথিবী ছেড়ে তুমিই ভালোই করেছো। কারন বেঁচে থাকলে হয়তো তোমাকে আরও অনেক কষ্ট পোহাতে হতো।

তোমার একটা ভাই হবে এই সংবাদ তুমি পেয়েছিলে। কিন্তু আগত সেই ভাইয়ের মুখটা তুমি দেখতে না পারার হতাশা নিয়ে চলে গেলে। চলে গেছো না, আমাদের দায়িত্বহীনতায় আমরা তোমাকে মেরে ফেলেছি। এজন্য তুমি আমাদের ক্ষমা করো না।

কখনও না। কোনদিনও না। তুমি আমাদের অভিশাপ দেও। তোমার শিশু মনের অভিশাপে অভিশপ্ত হয়ে যদি পারি এই অনিয়মকে দূর করতে। যারা এই আইন কানুকে দেখেন, প্রয়োগ করেন তারা যদি আর একটু দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন হয়তো তোমার জীবনের বিনিময়ে বেঁচে যাবে আরও অনেক জীবন। তুমি ক্ষমা করো সামিয়া, জানি না এটা বাস্তবায়ন হবে কিনা।

উল্লেখ্য, মঙ্গলবার রাতে কলাপাড়ার হাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী সামিয়ার মৃতদেহ নীলগঞ্জ খেয়াঘাটে থেকে নদীতে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করে স্থানীয় খেয়া নৌকার মাঝি আক্কাস হাওলাদার।

লেখকঃ ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম এর কলাপাড়া প্রতিনিধি।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here