কালাম আজাদ, কক্সবাজার:
সাজার মেয়াদ শেষ হলেও যুগের অধিক সময় ধরেই কক্সবাজার জেলা কারাগারে আটক রয়েছে মিয়ানমারের ৩৯ নাগরিক। এদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। এসব বিদেশী বন্দি বছরের পর বছর কারাগারে আটক থাকায় যেমন তাদের মানবাধিকার লঙ্গিত হচ্ছে তেমনি ভাবে ব্যায় হচ্ছে সরকারের অর্থ। মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইট্স ফাউন্ডেশন বি.এইচ.আর.এফ বৃহত্তর চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার সভাপতি এডভোকেট জিয়া হাবীব অহসান, সেক্রেটারী এডভোকেট মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিনের নেতৃত্বে মানবাধিকার টিমের তথ্যনুসন্ধানকালে কক্সবাজার জেল সুপার মোজাম্মেল হকের দেওয়া তথ্যে এ সংবাদ পাওয়া গেছে।
বছরের পর বছর বন্দী ৩৯ বিদেশী নাগরিকের আশু মুক্তির ব্যাপারে কোন কার্যকর ব্যবস’া গৃহীত না হওয়ায় গভীর উৎকন্ঠা প্রকাশ করেছেন এ সংগঠনটি। তারা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস’া নিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি এবং আনর্-জাতিক রিফুজি সংক্রান- সংস’ার আশু হস-ক্ষেপ কামনা করেছেন।
দেশবরেণ্য মানবাধিকার নেত্রী এডভোকেট এলিনা খানের নেতৃত্বাধীন উক্ত মানবাধিকার সংগঠন বি.এইচ.আর.এফ নারী ও শিশু কারাবন্দীদের মানবাধিকার সংক্রান- তথ্যানুসন্ধান চালাতে গিয়ে তাদের তদন- টিমের কাছে এ ধরণের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে বলে জানিয়েছেন এডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান। মায়ানমারের এসব নাগরিক বিভিন্ন অভিযোগে সাজা ভোগ করা শেষ হওয়া কিংবা অব্যাহতি আদেশ পাওয়া স্বত্বেও তারা দীর্ঘদিন যাবৎ মুক্তির প্রহর গুনছে। তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর আইনী জটিলতার কারনে অনির্দিষ্ট কালের জন্য তাদের কারাভোগ করে যেতে হচ্ছে।
এতে একদিকে যেমন কারাকর্তৃপক্ষ খরচান- হচ্ছে অপরদিকে এসব বন্দী মানুষগুলোর মানবাধিকার চরমভাবে লংঘিত হচ্ছে। উভয় দেশের সরকারী পর্যায়ে বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা অত্যন- জরুরী মর্মে দাবী করেছে মানবাধিকার সংগঠনটি। এসব বন্দীদের মধ্যে ১ জন নারী ও ১জন শিশু রয়েছে। অনেকে শিশু অবস’ায় কারাগারে গিয়ে বর্তমানে প্রাপ্ত বয়সে পদার্পন করেছেন। এ ঘটনাকে তারা আন-র্জাতিক মানবাধিকার সনদ ও আইনের চরম লংঘন মর্মে অবহিত করে তারা। মানবাকিার সংগঠনটি এ ব্যাপারে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক মন্ত্রণালয় টঘঐঈজ এর সরাসরি হস-ক্ষেপ কামনা করেন।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায় যে, এসব আটক ব্যক্তিরা পাসপোর্ট আইন, ফরেনার্স এ্যাক্ট, স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্ট সহ দন্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় গ্রেপ্তার হয়। মায়ানমারের আকিয়াব, কেনডন, ইয়ানগুন প্রভৃতি জেলার বিভিন্ন থানা এলাকার এসব বাসিন্দার সুষ্পষ্ট নাম ঠিকানা থাকা স্বত্বেও ঐ দেশের সরকার তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করছে। ফলে কারাকর্তৃপক্ষ তাদের নিয়ে মারাত্বক অসুবিধায় পড়েছে।
মায়ানমারের যেসব নাগরিক সাজা ভোগের মেয়াদ শেষে রিলিজ হওয়ায় কথা তাদের মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন বন্দী হচ্ছেন সুলতান আহমদ (২৩), পিতা- মৃত এয়াকুব আলী, গ্রাম- জুপরাং, থানা- বোচিডং, জেলা- কেন্ডন, মায়ানমার। তিনি বান্দরবান পার্বত্য জেলায় জি.আর ১১/৯৮ মামলায় ২৮/০৪/১৯৯৯ ইং গ্রেপ্তার হয়ে লামা থানা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত কর্তৃক ১৯৪৭ সালের ফরেনার্স এ্যাক্ট এর ১৪ ধারায় ৫০০ টাকা জরিমানা ও ছয় মাসের কারাদন্ড সাজা প্রাপ্ত হন। ২৬ এপ্রিল ৯৯ ইং থেকে সাজা ভোগ করে ৯ সেপ্টেম্বর ৯৯ সালে তিনি মুক্তি পাওয়ার কথা। অথচ বন্দীটি ০৯/৯/৯৯ থেকে অদ্যাবধি প্রায় ১২ বছর বা একযুগেরও বেশি সময় কারা ভোগ করে যাচ্ছেন। এভাবে আকিয়াব জেলার মুংডু থানাধীন মায়াদী গ্রামের আবুল হোসাইনের পুত্র হাফেজ আহমদ (২১) এর সাজার মেয়াদ ১৮/৭/০১ তারিখ শেষ হয়। সে পাসপোর্ট আইনের ৩(৩) ধারায় ৩ মাসের কারাদন্ড ভোগ করার পরও অদ্যাবধি প্রায় ১০ বছর যাবৎ কারাভোগ করে আসছেন। উলা মিয়ার পুত্র কারাবন্দী মোঃ জালাল (৩০) ৩১/১০/০৫ইং তারিখ মুক্তি পাওয়ার কথা, একইভাবে খলিলুর রহমানের ছেলে আবদুর রহিম (৩৮)’র ২২/০৬/০৬ইং, কালা মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ ইউছুফ আলী (৩৮)’র ৩১/০৭/০৭ইং, মৃত ছৈয়দ করিমের ছেলে বশির আহমদ (৩৪)এর ৩০/০৬/০৮ইং, মরহুম আব্দুর রহমানের ছেলে নুর আলম (৩০)এর ২৪/০৬/০৭ইং, মৃত জালাল আহমদ’র ছেলে শাহ মিয়া (১৫) এর ২৪/০৬/০৭ইং, মৃত কাশিম এর আবুল হাশিম (২৫)এর ৩০/০৬/০৮ইং, ছরি হোছাইনের ছেলে মোহাম্মদ রফিক (২২)এর ৩০/০৬/০৮ইং, মৃত হামেদ হাছান এর ছেলে মোহাম্মদ হোছাইন (২৩)এর ৩০/০৬/০৮ ইং, ট্যাং চংক এর ছেলে টিং অং (৪৬)এর ১৮/১২/০৭ইং, মৃত তাচেং এর ছেলে লা-লো (৪৬)এর ১৫/০৮/০৮ইং, মৃত শত্রু রাখাইনের ছেলে মং তোয়া অং রাখাইন (২৯), এর ২৯/৭/০৮ইং, কালা পুতুর ছেলে আনোয়ার ইসলাম (৩৪)এর ৩০/০৯/০৯ইং, চৌং রাখাইনের কিয়ং গাফ রাখাইন (২৬)এর ০৮/০১/০৮ইং, আবুল জাফরের ছেলে মোহাম্মদ সেলিম (২০)এর ২৮/০৬/১০ইং, মৃত ইউছুপ আলীর ছেলে আলী আকবর (২০)এর ২৬/০৩/০৫ইং, মৃত আবু বক্কর এর ছেলে আবু তৈয়ব (২৭), এর ২৮/০৬/১০ইং, আব্দুল হোছাইনের ছেলে সোনা মিয়া (৩৫) এর ২৮/০৬/১০ইং, আমান উল্ল্যার ছেলে আবুল কালাম (৩৩), এর ২৮/০৬/১০ইং, আবুল হাশেমের ছেলে নুর ইসলাম (২৮)এর ২৮/০৬/১০ইং, মোঃ ওয়ায়িচের ছেলে মোহাম্মদ রফিক (২৯)এর ২৮/০৬/১০ইং, মোঃ শুভ আলম (২৬), পিতা- বদি আলম ২৮/০৬/১০ইং, রহমতআলী (২৬), পিতা- মোঃ মনির আলম ২৮/০৬/১০ইং, নুর মোস-ফা (২৫), পিতা- আনু মিয়া, ২৮/০৬/১০ইং, মোঃ রফিক (২৭), পিতা- ছৈয়দ আলম, ২৮/০৬/১০ইং,আবুল হোছাইন (২৭), পিতা- কালামিয়া ২৮/০৬/১০ইং, চাই চাই মার্মা (৪০), ১৯/১১/০৯ইং, রশিদ উল্লাহ (২৭) ২৭/০১/১০ইং, আমান উল্লা (২৫) ২৭/০১/১০ইং, আরাফাত উল্লাহ (২৫) ২৭/০১/১০ইং, মোহাম্মদ সেলিম (৩২) ২৬/০৫/১১ইং, আজগর হোছাইন (৪৫) ২০/০৪/১১ইং, লেদু মিয়া (৪৮) ২০/০৪/১১ইং, মহিলা হাজতী সায়েদা ওয়াই (২০) ০৩/০৮/২০১০ ইং তারিখে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল।
চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত ডবলমুরিং থানার জিডি নং- ৪০৩, তাং- ০৮/০৬/২০০৯ ইং এই মহিলাকে ০৮/০৮/২০১০ ইং তারিখে মুক্তির আদেশ দিলেও সে আজও মুক্তি পায়নি। একইভাবে উপলা খুমি (২৭), ০১/১১/১০ইং ও হাই ট্যোং (৪৫) পিতা- লেই চ্যুং ১০/০২/১০ইং মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল কিন’ দূর্ভাগ্য জনকভাবে উপরের উল্লেখিত ৩৯ জন মানব সন-ান আজ কক্সবাজার জেলা কারাগারে বছরের পর বছর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশায় মুক্তির প্রহর গুনছেন। বিষয়টি রাষ্ট্রের উর্ধ্বতন মহলকে অবহিত করে আসছিল কারাকর্তৃপক্ষ কিন’ এর কোন সুরাহা করতে পারেনি তারা।
৩৯ জন কারাবন্দীকে মুক্তির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস (বি.এস.আর.এফ) এর পক্ষ থেকে এর প্রধান নির্বাহী এডভোকেট এলিনা খান মহামান্য উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করার প্রস-ুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র।